মহাবীরের নাম 'বর্ধমান মহাবীর' হয়েছিল কীভাবে?

চৈত্রের শুক্লা ত্রয়োদশী তিথির রাত। বৈশালীর আকাশে তখন স্বমহিমায় জ্বল জ্বল করছে উত্তর-ফাল্গুনী নক্ষত্র। সেই নক্ষত্রের আলোমাখা শুভলগ্নে রাজা সিদ্ধার্থ আর রানি ত্রিশলার ঘর আলো করে জন্ম নিলেন মহাবীর।

আমরা তাঁকে 'মহাবীর' বলছি বটে, তখনও কিন্তু তাঁর কোন নামকরণ হয়নি; তখন তিনি নেহাতই এক সদ্যোজাত শিশুপুত্র। জন্মের পর পরই স্বর্গ থেকে দেবরাজ ইন্দ্র এলেন তাঁকে দেখতে। দেখে তাঁর ভারি সাধ হল সাত সাগরের জল দিয়ে এই ভাবী তীর্থঙ্করকে স্নান-অভিষেক করানোর। বিস্তার করলেন মায়া। অমনি তাঁর মায়ায় রাজা-রানি ও রাজপুরীর সকলে ঘুমিয়ে পড়লেন।

শুধু মায়ানিদ্রা এল না মহাবীরের চোখে, তাঁর মুখে তখন শুধু ইন্দ্রকে প্রশ্রয়দায়ী এক চিলতে সরল হাসি। অভয় পেয়ে মায়ের কোল থেকে নবজাতক মহাবীরকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে মেরু পর্বতের শিখরে গেলেন ইন্দ্র।

তারপর তাঁর আহ্বানে দেবতারা ও দেবকন্যারা সমবেত হলেন সেখানে। তাঁর আদেশে দেবকন্যারা সোনার কলসি কাঁখে নিয়ে সংগ্রহ করে আনলেন একে একে সাত সাগরের জল। প্রথমটায় খুব উৎসাহ দেখালেও এবার ধীরে ধীরে দেবতাদের নানারকম দ্বিধা জাগতে শুরু করল, যেমন—দেবরাজের শখে সদ্যোজাত শিশুটিকে সাত সাগরের জলে স্নান করানোটা কি ঠিক হবে? ঐ জলরাশি শিশুটি কি গায়ে সইতে পারবে?

আসলে, দেবতারা তখনও চিনতে পারেননি মহাবীরকে, জানতেও পারেননি পরমেশ্বরের মহাবীরজাতকের রহস্য। সে-রহস্য জানতেন শুধু ইন্দ্র। তিনি মুচকি হাসলেন। তখন রহস্যটি নিজেই জানাতে চাইলেন মহাবীর। তিনি তাঁর পায়ের বুড়ো আঙুল দুটি দিয়ে চাপ দিলেন মেরু পর্বতের শিখরভূমিতে। আর অমনি প্রবলভাবে কম্পিত হতে শুরু করল সেই পর্বতশিখর। মনে হল যেন সৃষ্টির প্রলয়কাল উপস্থিত!

হঠাৎ সেই প্রলয়কারী কম্পনে দেবতারা এবং দেবকন্যারা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলেন। অমনি তাঁরা দেবরাজের শরণ নিলেন! দেবরাজ বরাভয় দান করে তাঁদের ইশারা করলেন মহাবীরের দিকে। তখন তাঁরা অবাক হয়ে দেখলেন, এই প্রবল কম্পনের মাঝেও ইন্দ্রের আনা সদ্যোজাত শিশুটি কিন্তু অচঞ্চল-স্থির, মুখে তিতিক্ষার হাসি। তখন ক্রমে দেবতারা উপলব্ধি করতে পারলেন শিশুটি কোন সাধারণ শিশু নন। বুঝলেন, দেবতাদের সংশয় ঘোচাতে তাঁদের বোধির জন্যই তাঁর এই লীলা।

উপলব্ধির এমন স্তরে এসেই তাঁরা সমবেতভাবে এই আশ্চর্য জন্মবীর শিশুটির বন্দনা করতে লাগলেন, সংশয় প্রকাশের জন্য ক্ষমা চাইতে লাগলেন। আর ঠিক তখনই মেরু পর্বতের সেই লীলাকম্পন একেবারে থেমে গেল।

এই কম্পনে পৃথিবীর কোন ক্ষতি হল না, নেতিবাদী সংশয়ী ও দ্বিধাগ্রস্থের মনে শুধু ইতিবাচক পরিবর্তন এল। সেই সঙ্গে ইন্দ্র এবার দেবতাদের জানালেন যে, ভোগবাদী ও সংশয়বাদী মানুষের মনে ত্যাগের আচরণ ও অহিংসার তরঙ্গের মধ্য দিয়ে জাতিকে মুক্তির পথ দেখাতেই এই শিশুরূপে ধরায় আবির্ভুত হয়েছেন পরমশক্তিধর স্বয়ং পরমেশ্বর। এই অবতারে ইনি অস্ত্র না-ধরেও শুধু প্রেম আর ত্যাগ দিয়েই জয় করবেন ত্রিভুবন। তাই আমি এঁর নাম দিলাম, 'মহাবীর'।

তখন দেবতারা হর্ষধ্বনি আর বন্দনা করতে করতে মহাসমারোহে সাত সাগরের জল ও পুষ্প দিয়ে মহাবীরের অভিষেক সম্পন্ন করলেন। তারপর তাঁকে ফিরিয়ে দিলেন মায়ের কোলে।

Mahabir-jayanti-01

তখন সকাল। রাজা সিদ্ধার্থের পুত্রজন্মের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত রাজ্যে। সঙ্গীত, নৃত্য ও আনন্দ উদযাপনের নানাবিধ আয়োজনে রাজ্যজুড়ে শুরু হল নন্দ উৎসবের মতো বর্ণাঢ্য এক উৎসব। গরীব প্রজাদের দান করার জন্য রাজা খুলে দিলেন রাজকোষ। দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য দলপতি ও রাজা এই আনন্দ সংবাদ পেয়ে আসতে লাগলেন শুভেচ্ছা জানাতে, পাঠাতে লাগলেন বাহুমূল্য ভেট।

এই সময় একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটল, যে-সব রাজারা ক্রমাগত এতদিন সিদ্ধার্থের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, যাঁরা তাঁর বশ্যতা কিছুতেই মেনে নিচ্ছিলেন না; সেই সব রাজারা উপহার সামগ্রী নিয়ে হাজির হলেন মহাবীরকে দেখতে। সমস্ত শত্রুতা ভুলে বন্ধুতার হাত বাড়িয়ে সিদ্ধার্থের সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক তৈরি করে নিলেন। অনেকেই স্বেচ্ছায় স্বীকার করে নিলেন বশ্যতা।

মহাবীরের জন্মের পর এভাবেই দেখতে দেখতে বেড়ে উঠল সিদ্ধার্থের রাজ্যের পরিধি। বিনা যুদ্ধে, বিনা রক্তপাতে, হিংসা ও হানাহানি ছাড়াই পরের রাজ্য আপন হল। রাজ্যজুড়ে বিরাজ করতে লাগল অসীম শান্তি আর অগাধ সুখ। এই বৃদ্ধি দেখে রাজা ও রানি তাঁদের পুত্রসন্তানের নাম রাখলেন, 'বর্ধমান'। এই ভাবে দেবদত্ত ও পিতৃদত্ত দুই নাম মিলে মহাবীরের নাম হল, 'বর্ধমান মহাবীর'।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...