বাংলার প্রতিটি নদী, জলাশয় গঙ্গার মতো পবিত্র হয়ে ওঠে বারুণীতে

গঙ্গায় ভেসে যায় কাঁচা আম। বচ্ছরকার ফল মানুষ নিবেদন করেন গঙ্গায়। কোণী, উপন্যাস যাঁরা পড়েছেন তাঁদের কাছে এ জিনিস জানা, চেনা। আদপে বারুণী একটি মহাপুণ্য তিথি। চৈত্র মাসের এই তিথিতে গঙ্গা স্নান করলে মহাপুণ্য অর্জন হয় বলে বিশ্বাস। এ দিন বাংলার প্রতিটি নদী, জলাশয় যেন গঙ্গার মতো পবিত্র হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে পতিতপাবনী।

গঙ্গা হল পুণ্যদায়িনী। পুণ্য লাভের আশাতেই গঙ্গাস্নান করা। বছরে তিন-চারটে তিথিতে গঙ্গাস্নানের বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে, জৈষ্ঠ্যের দশহারা, আশ্বিনের অমাবস্যা মহালয়ায় তর্পণের সময়, পৌষের শেষদিনে মকরের স্থান আর চৈত্র মাসের বারুণী। বাংলা বছরের এটিই শেষ গঙ্গাস্নানের পুণ্য তিথি।

বারুণীর দিন বঙ্গের নানান প্রান্তে অজস্র উৎসব হয়। বর্ধমানের অগ্রদ্বীপে মেলা চলে চৈত্রে, বারুণীর স্নান উৎসবের জন্যই গোপীনাথের মেলা বসে। কৃষ্ণ পক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে এই স্নান হয়। তিথিকে মধু ত্রয়োদশী বলেন কেউ কেউ, এদিন মতুয়ারাও স্নান সারেন ঠাকুরনগরের কামনা সাগরে।

মতুয়াদের কাছে এটি ঠাকুর হরিচাঁদের আবির্ভাব তিথি। কপিলমুনির আশ্রমেও বারুণীর মেলা বসে। কপোতাক্ষের পাড়ে সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির গড়ে সাধনায় বসে আদ্যা শক্তির সাক্ষৎ পেয়েছিল কপিলমুনি। ধ্যানের দ্বারা তিনি গঙ্গাকে কপতাক্ষের সঙ্গমে একত্রিত করেন। তিথিটি ছিল চৈত্র মাসের শতভিষা নক্ষত্রের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী। এখানেও স্নানঘাট আছে। মানুষ পুণ্য লাভের বাসনায় স্নান করেন। এই স্নানের সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গায় আম নিবেদন করার রীতি রয়েছে। কাঁচা আম দেওয়া হয়। কেউ মাথায় আম রেখে ডুব দিয়ে ভাসিয়ে দেন, কেউ কেউ আম ছুড়ে দেন। আম বারুণীর আগে অবধি আম খাওয়া যায় না।

মরসুমের প্রথম ফসল ঈশ্বরকে দেওয়া, এ যে ঐতিহ্য। বছরের প্রথম, প্রথম আম, লিচু এনে আগে ভগবানকে নিবেদন করা হয় তারপর বাড়ির সব্বাই খান। একই জিনিস হয় গুড়ের সময়। নতুন গুড় আগে পৌষ কালী ও মনসা পাবেন, তারপর বাড়ির সব্বাই। আবহমানকাল ধরে চলে আসা নবান্নও তো তাই; মাঠ থেকে ওঠা প্রথম ধান ঈশ্বরকে নিবেদন করার রীতি। তিনিই তো দাতা, তাঁর কৃপায় ফলন, তাই ফসলের প্রথমভাগ তাঁর জন্যেই বরাদ্দ। চৈত্র মানে বসন্ত একেবারে লগ্নে, কাঁচা আম উঠতে আরম্ভ করেছে। সামনে বৈশাখ আসন্ন, গ্রীষ্মের দিন কঠোর, জল কষ্টের দিন। জলের অভাবে কৃষিপ্রধান দেশে চাষের ক্ষতি হতে পারে। তাই মরশুমের প্রথম ফল কাঁচা আম দিয়ে জল উপাসনা। বরুণদেবকে তুষ্ট রাখার বাসনা। বরুণদেবের স্ত্রী হলেন বারুণী। তাঁরা জলের অধিশ্বর, তাঁরা সন্তুষ্ট মানে জলাভাব দেখা দেবে না। তাই নদীকে আম দান করা।

বাঁকুড়ার ওন্দার সানতোড়ে ঘুঁটে বারুণীর মেলা হয়। পুণ্য লাভের আশায় মাথায় ঘুঁটে নিয়ে স্নান করেন মানুষ। স্নান করে এসে মানুষ ফুটকলাই দিয়ে জলাশয়ের পাশের থানে পুজো দেন। এখানে ফুটকলাইয়ের মানত করা হয়। যে সব বাচ্চার মুখে কথা ফোটে না তাদের পরিবারের বড়রা, বাবা-মা-দাদু-ঠাকমারা মানত করেন। মানত পূরণ হলে অর্থাৎ বাচ্চার মুখে কথা ফুটলে বারুণী স্নানের পর ফুটকলাই দিয়ে থানে পুজো দেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...