আঠেরো-পুরাণে গল্পের বিভিন্নতা সত্বেও গণেশের প্রধান যে বারোটি নাম পাওয়া যায়, সেগুলো হল--'গণপতি', 'বিঘ্নরাজ', 'গজানন', 'একদন্ত', 'গণাধিপ', 'দ্বৈমাতুর', 'লম্বমুণ্ড', 'হেরম্ব', 'বিনায়ক', 'চারুকর্ণ', 'পশুপাল' এবং 'শিবনন্দন'। এছাড়া তাঁর আরও অনেক নাম আছে। এখন প্রশ্ন হল, কেন গণেশকে এইসব নাম দেওয়া হল?
প্রথমে আসি 'গণপতি' নামের উদ্ভব প্রসঙ্গে। বেদে জ্ঞানের দেবতার নাম, 'ব্রাহ্মণস্পতি' বা 'বৃহস্পতি'। তাঁকে জ্ঞানী অৰ্থে 'গণপতি' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পুরাণের যুগে যখন শিবের কাহিনি গড়ে উঠল, তখন কল্পিত হল তাঁর ভুতপ্রেত অনুচরদের কথা, তাদের বলা হতে লাগল, 'গণ'। শিব হলেন তাদের অধিপতি ও রক্ষাকর্তা। সেই হিসেবে শিবের নাম হল, 'গণপতি'। আচ্ছা, বেশ। কিন্তু, শিবের নামই যদি 'গণপতি' হয়, তাহলে তাঁর পুত্র গণেশের নাম আবার 'গণপতি' হল কী করে? সেখানেও আছে এক গল্প :
'বরাহ পুরাণ'-এর কাহিনিতে দেখা যায়, একবার দেবতারা নতুন দেবতা সৃষ্টির জন্য শিবকে অনুরোধ করতেই, শিব আকাশব্যাপী এক সুন্দর দেবতার সৃষ্টি করলেন। যেমন তাঁর রূপ, তেমনি তাঁর তেজ। সেই রূপ দেখে পার্বতী মোহিত হয়ে গেলেন। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলেন। কিন্তু, তাঁর সেই মুগ্ধতা দেখে শিবের খুব ক্রোধ হল। ভয়ানক ঈর্ষা হল। তখন তাঁর শরীর থেকে অসংখ্য গণের উদ্ভব হল। ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে তিনি নিজের সৃষ্টিকে সাপের উপবীতধারী, বিশাল উদর ও গজমুণ্ডবিশিষ্ট কদাকার হয়ে ওঠার অভিশাপ দিলেন। অমনি সেই সুন্দর দেবতা কদাকার হয়ে গেলেন। তখন দেবতারা সম্মিলিত রুষ্ট রুদ্র শিবকে স্তবে তুষ্ট করে অনুরোধ করলেন ক্রোধ সংবরণ করতে এবং নবসৃষ্ট দেবতাকে গ্রহণ করতে। ব্রহ্মার অনুরোধে শেষমেশ শিব শান্ত হলেন। দয়াবান হলেন। তখন তিনি নিজেই নতুন দেবতার নাম দিলেন, 'গণেশ'। তাঁকে গণেদের অধিপতি করে নাম দিলেন, 'গণপতি'। মুখ হাতির মতো বলে নাম দিলেন, 'গজানন'। বিশাল উদরবিশিষ্ট হওয়ায় নাম দিলেন, 'লম্বোদর'। এই সৃষ্টি-কাহিনি থেকে জানা যায় যে, গণেশ আসলে শিবরুদ্রেরই আর এক রূপ। তাই শিবের 'গণপতি' নাম, গণেশে আরোপিত হল সহজেই।
গনেশকে 'দ্বৈমাতুর' অর্থাৎ দুই মায়ের সন্তান বলার পেছনেও আছে এক গল্প। 'মৎস্য পুরাণ'-এর গল্প। সেখানে বলা হয়েছে :
পার্বতী একবার গঙ্গায় স্নান করতে গেলেন। স্নান করতে করতে নিজের গায়ের ময়লা দিয়ে খেলাচ্ছলে পুতুল গড়তে গড়তে আনমনে গড়ে ফেললেন গজমুণ্ড বিশিষ্ট এক মানুষের মূর্তি। পার্বতীর সখী সেই মূর্তি হাতে নিয়ে দেখতে গেলেন, কিন্তু, তা হাত ফসকে পড়ে গেল গঙ্গার জলে। অমনি সেই মূর্তি প্রাণ পেয়ে বিশাল আকার ধারণ করে পৃথিবী ব্যাপ্ত করতে চাইল। তখন পার্বতী তাকে কোলে স্থান দিলেন। অমনি সেই বিশাল মূর্তি একটি শিশু হয়ে গেল। পার্বতী তাকে নিজের সন্তান হিসেবে গ্রহণ করে 'পুত্র' সম্বোধন করলেন। আর ঠিক তখনই গঙ্গাও সশরীরে আবির্ভুত হয়ে শিশুটিকে 'পুত্র' বলে সম্বোধন করলেন। কারণ, হাত ফসকে পুতুলটি যে তাঁর গর্ভে ঠাঁই পেয়েই প্রাণ পেয়েছে! তাই গণেশের দুই মা। পার্বতী এবং গঙ্গা। তাই তাঁকে 'দ্বৈমাতুর' বলা হয়।
'বামন পুরাণ'-এর গল্পে আছে গণেশের 'বিনায়ক' নামের ইতিহাস। সেখানে বলা হচ্ছে :
পার্বতী যখন নিজের গায়ের ময়লা দিয়ে গণেশকে সৃষ্টি করলেন, তখন শিব কৈলাসে উপস্থিত ছিলেন না। তিনি ফিরে এসে পুত্রকে দেখে অবাক হলেন। বললেন, 'হে পার্বতী, তুমি নায়ক অর্থাৎ আমাকে ছাড়াই নিজেই পুত্রকে সৃষ্টি করেছ, তাই তোমার পুত্রের নাম দাও, 'বিনায়ক'! এই পুত্র সমস্ত বিঘ্ননাশের কারণ হবে।'
গণেশের চার হাতের পেছনেও গল্প আছে। 'ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ'-এ বলা হয়েছে :
পার্বতী শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী বিষ্ণুর কাছে একবার বর প্রার্থনা করেছিলেন বিষ্ণুর মতোই দেখতে একটি পুত্রসন্তান চেয়ে। পার্বতীর প্রার্থনা পূরণ হয়। চার হাতবিশিষ্ট সুন্দর পুত্রের জন্ম দেন তিনি। সেই পুত্রের মুখমণ্ডল বিষ্ণুর মতোই সুন্দর। কিন্তু, শনির দৃষ্টিতে পার্বতীপুত্রের সেই সুন্দর মুখমণ্ডলসহ মাথা উড়ে যায়। সারা ব্রহ্মাণ্ড খুঁজেও তা আর পাওয়া যায় না। তখন ক্রন্দনরতা পার্বতীর প্রার্থনায় উত্তরদিকে মাথা রেখে শুয়ে থাকা এক সাদা হাতি 'ঐরাবত'-এর মাথা এনে বিষ্ণু সেই পুত্রকে বাঁচিয়ে দেন। তখন হাতির মাথাবিশিষ্ট সেই পুত্রের নাম হয়, 'গজানন'।
কালে কালে গণেশ যেভাবে বুদ্ধি ও জ্ঞানের প্রতীক হয়ে উঠলেন, তার পেছনে ঋগ্বেদের জ্ঞানদেবতা বৃহস্পতির সঙ্গে 'গণপতি' নামের সাযুজ্য যে কাজ করেছে--এ অস্বীকার করা যায় না। 'মহাভারত'-এর লিপিকার হয়ে ওঠার গল্পটি সেই সংযোগেরই ফল। বিভিন্ন সময়ে লেখা আঠেরো পুরাণে গণেশ-নামাবলীর যে-সব ভিন্নতর গল্প পাওয়া যায়, তা থেকে এটা স্পষ্ট যে, গণেশের গজমুণ্ড-লম্বোদর-চতুর্ভুজ-সিদ্ধিদাতা রূপটি একদিনে গড়ে ওঠেনি--তা অনেক যুগের অনেক মানুষের কল্পনার ফসল।