আজ কালীকথায় আমরা নদীয়ার এক ঐতিহাসিক জনপদে যাবো। সেই জনপদ এককালে ছিল ডাকাতের ঘাঁটি, ডাকাতের নাম রণা; সেই থেকেই এলাকার নাম হয় রানাঘাট। ষোড়শ শতাব্দীতে রাণাঘাটের জঙ্গলে দাঁপিয়ে বেড়াতো রণা ডাকাত। ডাকাত আর কালী পুজো বাংলায় সমার্থক। প্রত্যেক ডাকাতের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে কোন না কোন বিখ্যাত কালী পুজো। রণাও তার ব্যতিক্রম নয়! রণা ডাকাতের পুজো করা কালীই রণা ডাকাতের কালী নামেও প্রসিদ্ধ।
পরবর্তীকালে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র দেবীবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে মায়ের নাম দেন সিদ্ধেশ্বরী কালী। পঞ্চমুণ্ডির আসনে প্রতিষ্ঠিত কষ্টিপাথরের তৈরি কালী বিগ্রহ তিন ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট। মায়ের পদতলে শায়িত শিব মূর্তি শ্বেতপাথরের তৈরি। সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির বাংলার অন্যতম প্রাচীন কালী মন্দির।
আনুমানিক ৩২৫ বছর আগে চূর্ণী নদীর তীরবর্তী অঞ্চল ছিল জঙ্গলময়। গোটা রানাঘাট অঞ্চলে ঘন বনজঙ্গল ছিল। সেই জঙ্গলে থাকত ডাকাত এর দল। ডাকাত দলের সর্দার ছিলেন রনা ডাকাত। ডাকাতি করার আগে তিনি মা কালীকে পুজো করে ডাকাতি করতে বের হতেন। যেহেতু সমস্ত মনের ইচ্ছা সিদ্ধ বা পূরণ করতেইমা কালীর আরাধনা করতেন, তাই তার কালী মায়ের নাম দিয়েছিলেন সিদ্ধেশরী মা। সেখানে ছিল রণা দস্যুর ঘাঁটি। সম্ভবত সেই কারণে স্থানটির নাম রানাঘাট। এই রণাডাকাত ছিল কালীভক্ত ও গরীবদের কাছে দেবতা। জনশ্রুতি রয়েছে যে, সে জঙ্গলে কালী বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে পুজো করত।
সেই দেবীমূর্তিই রূপান্তরিতা হয়ে আজ রানাঘাটের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরীরূপে অর্চিতা হচ্ছেন। যদিও শোনা যায়, জীবদশায় পরবর্তী কালে রনাডাকাত সাধুর সংস্পর্শে আসায়, তার মানসিক ও স্বভাব পরিবর্তন হয়। ডাকাতি ছেড়ে মায়ের সাধনায় মনোনিবেশ করেন। রনা ডাকাতের মৃত্যু হলে মা সিদ্ধেশ্বরী জঙ্গলের মধ্যেই পরে ছিলেন। এরপর নদিয়ার রাজা তিনি স্বপ্নাদেশ পান মা সিদ্ধেশ্বরী মায়ের। জঙ্গলের মধ্যে এরপর ওই স্থানেমায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। সিদ্ধেশ্বরী মায়ের মন্দিরে প্রত্যেক দিন নিত্যপুজো হয়ে আসছে।
আদপে আজ থেকে কত বছর আগে রণাডাকাত বেঁচেছিল, তার কোনও প্রামাণ্য ইতিহাস নেই! তবে জনশ্রুতি বলে ৫০০-৬০০ বছর আগে কোনো এক কালীভক্ত রণা কোনও দেবীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল অথবা কোনও প্রতীক স্থাপনা করে কালী পুজো করত। তবে আজ আর কিছুই নিশ্চিত করে বলা যায় না। জনশ্রুতি রয়েছে যে মহারজ কৃষ্ণচন্দ্র নাকি রণাডাকাতের আরাধ্যা দেবী কর্তৃক স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন যে, দেবী জঙ্গলে বহুকাল অনাদৃতা পড়ে আছেন... কৃষ্ণচন্দ্র যেন তাঁকে এক উত্তম স্থানে প্রতিষ্ঠা করে তাঁর পুজোর ব্যবস্থা করেন। মতান্তরে বলা হয় যে, কোন একসময়ে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর রানাঘাটের জায়গীরে ওই দেবীমূর্তিটি পেয়েছিলেন এবং সেটি রণাডাকাতের আরাধিতা দেবীবিগ্রহ বলে জানতে পেরেছিলেন, তখন তিনি যেখান থেকে মূর্তিটি পাওয়া গিয়েছিল তার কাছেই জঙ্গল পরিষ্কার করিয়ে একটি মাটির ঘর তৈরি করে দেবীকে সেখানে প্রতিষ্ঠিত করেন।
বলাবাহুল্য সেসময় দেবীমূর্তি ছিল মৃন্ময়ী। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বর্ধমান থেকে এক ব্রাহ্মণ বংশকে এনে দেবীর সেবার ভার দিয়েছিলেন।কিংবদন্তি রয়েছে যে, পুরোহিতের ব্যাপারেও দেবীর স্বপ্নাদেশ ছিল। এখন যেখানে মন্দিরটা রয়েছে তখন ঠিক ওই স্থানেই দেবী বিরাজিতা ছিলেন। মহারাজা দেবত্র হিসাবে সমগ্র চত্বরটি সেবাইতদের দান করেন। এছাড়াও দেবীর সেবার জন্য ধর্মপরায়ণ মহারাজা আরও অনেক জমি দেবত্র হিসাবে দান করেছিলেন।
এই দেবীকে সিদ্ধেশ্বরী নামে অবহিত করা হয় যদিও দেবীমূর্তি দক্ষিণাকালিকা বিগ্রহ। সম্ভবত মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র দেবীর এই নামকরণ করেছিলেন। দেবী সিদ্ধিদাত্রী তাই তিনি সিদ্ধেশ্বরী।
আজ কিন্তু আর নিশ্চিত করে জানার উপায় নেই যে, দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তিটি রণাদস্যুর প্রতিষ্ঠিত ও অর্চিত ছিল নাকি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর মূর্তি গড়িয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। মূর্তিটি কিরূপ ছিল অর্থাৎ সিদ্ধেশ্বরী বিগ্রহ বা দক্ষিণাকালীর মূর্তি ছিল কিনা তা আর জানা যায় না। ঐ মৃন্ময়ী মূর্তিকে এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল।সময়টা ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর শাসনকাল।
সেসময় বাংলায় মুসলমানের প্রাধান্য, ইংরাজের উত্থান সবে শুরু হয়েছে। একদিন এক ইংরাজ সাহেব যেকোন কারণে প্রাণভয়ে ভীত হয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য দেবীর পর্ণমন্দিরে ছুটে এসে ঢুকে পড়েছিলেন এবং আত্মত্রাণের জন্য দেবীর চরণ স্পর্শ করে প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। তখন ছিল রাত্রিকাল। ইংরাজটি সে রাত্রে রক্ষা পেয়েছিল কিন্তু অস্পৃশ্যদোষে দুষ্ট হওয়ায়, তখনকার সংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের বিবেচনায় দেবীকে নদীগর্ভে বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল, সেই সঙ্গে দেবীর পর্ণমন্দিরটিও ভেঙে ফেলা হয়েছিল। পরবর্তীতে বারাণসী থেকে কষ্টিপাথরের মূর্তিটি এনে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তখন অবশ্য মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র জীবিত ছিলেন না।
কিন্তু সে সময়কার সেবাইতের চেষ্টায় স্থানীয় ঘটক বংশীয় দুইজন ভক্ত ও জমিদার পাল চৌধুরীদের এক কর্তাব্যক্তির সহায়তায় দেবীর শিলাময়ী মূর্তি কাশীধাম থেকে এনে, কোঠা মন্দির অর্থাৎ চাঁদনী জাতীয় মন্দির বর্তমান মন্দিরের গর্ভগৃহ নির্মাণ করে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তদবধি শিলাময়ী দক্ষিণা কালীর মূর্তিটিই সিদ্ধেশ্বরী নামে রানাঘাটের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসাবে পূজার্চিতা হচ্ছেন। এই মূর্তিটিও প্রাচীন বয়স দুশবছরের কম নয়।
তখনও রানাঘাট আজকের এই জনবহুল শহর নয়! বিরল বস্তি ও জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। মন্দিরের পাশে ছোট একটি মন্দিরে মহাদেব প্রতিষ্ঠিত আছেন। নাটমন্দির অনেক পরে তৈরি হয়, এ ব্যাপারে কতিপয় স্থানীয় লোকের আর্থিক সাহায্য ছিল। নাটমন্দির তৈরি হওয়ার আগে মন্দিরের দক্ষিণপূর্ব কোণে একটি বিরাট অশ্বত্থগাছ ছিল, ঐ গাছটি নাটমন্দির নির্মাণে বা মন্দিরের অন্যবিধ কাজে বাধা সৃষ্টি করেছিল, অথচ বিপদ আপদ ঘটে যাওয়ার ভয়ে কেউই গাছটি কাটছিল না।
তখন একজন বিবাহিত যে তখনও পর্যন্ত নিঃসন্তান ছিল সে ‘যা মায়ের ইচ্ছা’ এই ভেবে গাছটিকে কুঠারাঘাতে কেটে ফেলে। আশ্চর্য তারপর অপুত্রক সেই লোকটির ভাগ্য ফিরে যায় এবং আর্থিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তার একাধিক সুন্দর স্বাস্থ্যবান পুত্র লাভ হয়। লোকটির প্রত্যেক পুত্রই সুপুত্র এবং তারা জীবনে যথেষ্ট উন্নতি করেছিল। শ্বেতমর্মর প্রস্তরে তৈরি দুই ধাপ-বিশিষ্ট পঞ্চভুজ বা পঞ্চকোণ পঞ্চমুণ্ডের আসনোপরি দেবী-বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে সিদ্ধেশ্বরী নাম হলেও দেবী মূর্তিটি সিদ্ধেশ্বরী বিগ্রহ নয়, এই মূর্তি উৎকৃষ্ট কালো কষ্টিপাথর দ্বারা নির্মিত এবং শ্বেতপ্রস্তর খোদিত মহাদেব। প্রতি বৎসর দেবী মূর্তি রং দ্বারা অলঙ্কারিত করা হয়। মূর্তি উচ্চতায় তিন হাত মতো।
মন্দির গৃহ সাবেক আমলের কড়ি বড়গার ছাদ, মর্মর দ্বারা বাঁধান মেঝে রয়েছে। সম্মুখদ্বারাটি যে প্রাচীনকালের তা দেখলেই বোঝা যায়। মন্দিরের সামনে বলিদানের ‘থান’ তারপর নাট, মন্দির, নাট মন্দিরটি দালান জাতীয় সাদামাটা আচ্ছাদিত স্থান শিল্প-বৈশিষ্ট্য বর্জিত। সমগ্র মন্দির চত্বরটি বেশ বড়। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র দেবীর তত্ত্বাবধানের জন্য দেবত্র হিসাবে জায়গা দিয়েছিলেন এখন তা নেই। রানাঘাটের জনসাধারণ ও অন্যান্য দূর দূরান্তরের মানুষ দেবী সিদ্ধেশ্বরীকে অতিশয় জাগ্রত জ্ঞানে শ্রদ্ধাভক্তি করে। দেবী মূর্তি আয়তনয়না ভয়ঙ্করী আবার করুণাময়ীও।
ভক্তবৃন্দ আসেন তবে কালী পুজোর দিন ভিড় হয় বেশী। মায়ের করুণা ও আশীর্বাদ পেতে শুধু রানাঘাট নয় আশেপাশের থেকে বিভিন্ন রাজ্য দেশে বিভিন্ন জায়গা থেকে এমন কি বিদেশ থেকেও পূজো ও মায়ের আশীর্বাদ নিতে ভিড় করেন রানাঘাট সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে। আর প্রত্যেক দিন পুজো হলেও কালীপুজোর দিন দূরদূরান্ত থেকে ভক্ত বৃন্দের ঢল নামে এই মন্দিরে।
নদীয়ায় আরও কয়েকটি সিদ্ধেশ্বরী মন্দির দেখা যায়...নদিয়া জেলার রানাঘাট থানার অন্তর্গত এবং রানাঘাট রেলস্টেশন থেকে ১১ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত হরধাম গ্রাম। নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই গ্রামের পত্তন করেন এবং গ্রামের নামকরণও তাঁর করা। তিনি এখানে রাজপ্রাসাদ, মন্দির ইত্যাদি নির্মাণ করেন। সেই সমস্তই আজ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। কৃষ্ণচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রীর গর্ভজাত একমাত্র শম্ভুচন্দ্রই এখানে অবস্থান করেন এবং তাঁর বংশধররা এখানে বসবাস করতেন। এই শাখা বংশ কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ রক্তসম্পর্কিত। শম্ভুচন্দ্রের মধ্যম পুত্র পৃথ্বীচন্দ্রের স্ত্রী রাধামণি দেবী ১৭৮৫ শকাব্দে অর্থাৎ ১৮৬৩ সালে পঙ্খের অলংকরণযুক্ত একটি দক্ষিণমুখী চারচালা মন্দির নির্মাণ করে চিন্ময়ী নামে কষ্টিপাথরের এক কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
চাকদহ থানার অন্তর্গত সুখসাগর গ্রামে নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র এক চারচালা মন্দির নির্মাণ করে উগ্রচণ্ডী বা সিদ্ধেশ্বরী নামে পাথরের এক কালী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। বহুদিন পূর্বে মন্দিরটি নদীগর্ভে নিমজ্জিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে মূর্তিটি হরধামের চিন্ময়ী মন্দিরে রাখা হয়। আগেই বলা হয়েছে, হরধামের রাজপ্রাসাদ-মন্দিরও আজ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে চিন্ময়ী ও সিদ্ধেশ্বরী কালী মূর্তি নদিয়ারাজ বংশের হরধাম শাখার বংশধর যোগেশচন্দ্র রায়ের বাসভবনে রানাঘাটের ছোটবাজারের কাছে এক শিখরযুক্ত দালান মন্দিরে একটি কাঠের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিতা ও সেখানেই দেবী নিত্য পুজো পান।
কৃষ্ণনগর সিটি জংশন রেলওয়ে স্টেশন থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে হাই স্ট্রীট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রোডের উপরেই আরও এক কালী মন্দির। টোটো করে সহজেই চলে আসা সম্ভব। এই মাতৃ মন্দির নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে। এই মন্দিরের বৈশিষ্ট্য হল যে, এই একই মন্দিরের পাশাপাশি দুইটি গর্ভগৃহে দুইটি কালী মাতার বিগ্রহ অবস্থান করছেন। একটি হলেন সিদ্ধেশ্বরী কালী মাতা, অন্যটি হলেন দয়াময়ী কালী মাতা। এছাড়াও একটি কষ্ঠিপাথর দিয়ে তৈরি শিবলিঙ্গ রয়েছে। দেওয়ালে খোদাই করা ভগবান মহাদেবের নয়নাভিরাম ধ্যানরত মুর্তি দেখা যায়। এছাড়াও একটি গনেশ মুর্তিও মন্দিরে রয়েছে। রাধাকৃষ্ণ, নারায়ণও এই মন্দিরে আছেন। এই মায়ের মন্দিরে নিত্য ভোগের ব্যবস্থা আছে। ভক্তরা সামান্য কিছু দক্ষিণার বিনিময়ে সেই প্রসাদ বসে খেতে পারবেন। মন্দিরের সিদ্ধেশ্বরী মায়ের মুর্তিটি ২৫০ বছরের পুরোনো।