সতীপীঠঃ বাংলাদেশের ভবানীপুরে আসল শিলা ও সোনার মূর্তিতে রয়েছেন জাগ্রতা মা ‘অপর্ণা’

বাংলাদেশের পাবনা জেলার বগুড়া। এই বগুড়া শহর থেকে চল্লিশ কি.মি দক্ষিণ-পশ্চিমে বয়ে চলেছে পুণ্যস্রোতা করতোয়া নদী। পৌরাণিক কিংবদন্তি অনুসারে স্বয়ং স্বয়ম্ভূ শিবের করতল বা হাতের তালু থেকে জন্ম হয়েছিল এই নদীর। তাই এই নদীর নাম, ‘করতোয়া’ (কর=হাত, তালু=তোয়া)। তাই এই নদী পুণ্যসলিলা। পরম পবিত্রা। এই নদীর তীরেই রয়েছে ‘ভবানীপুর’ নামে এক জনপদ। এই জনপদেই রয়েছে একান্ন সতীপীঠের অন্যতম এক পীঠ। এই পীঠ মহাজাগ্রত পীঠ বলে ভক্তদের বিশ্বাস। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই পীঠস্থানে দেবী সতীর কোন অঙ্গই পতিত হয়নি, একদা অন্য স্থান থেকে দেবীর শিলাভূত অঙ্গ এই স্থানে এনে এই পীঠ নির্মাণ করা হয়েছিল। সেটা কীভাবে সম্ভব হয়েছিল, তা নিয়ে শোনা যায় ইতিহাস ও প্রচলিত কিংবদন্তি মিলেমিশে গড়ে ওঠা এক কাহিনি। কাহিনিটি হলঃ

বাংলায় তখন মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই সময় করতোয়া নদীর তীরে কমলাপুর নামে প্রাচীন একটি জনপদ ছিল। সেখানে বাস করতেন অচ্যুত সেন নামে এক সামন্ত রাজা। রাজা ছিলেন ঘোর শাক্ত। তাঁর আরাধ্যা দেবী ছিলেন, ‘অপর্ণা’। দেবীর পীঠ ছিল কমলাপুরের নিকটে গুলফাপুরীতে। গুলফাপুরী ছিল জঙ্গলবেষ্টিত এক ভূমি। সেখানেই খোলা আকাশের নীচে বৃক্ষতলে ছিল দেবীর পীঠ। আসলে, এই পীঠস্থানের এমন নামের পিছনে রয়েছে দেবী-অঙ্গের অবদান। ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হয়ে এখানে দেবীর গুলফ বা গোড়ালি পতিত হয়ে তা শিলারূপ পেয়েছিল, তাই এই স্থানের নাম হয়েছিল, ‘গুলফপুরী’।  [এই পীঠ সম্পর্কে ‘পীঠনির্ণয়’ তন্ত্রগ্রন্থে স্পষ্টতই বলা হয়েছে—

‘করতোয়াতটে গুলফং বামে বামেশ ভৈরবঃ

অপর্ণা দেবতা তত্র ব্রহ্মরূপা করোদ্ভবঃ।’

শ্লোকটির অর্থঃ ভগবান শিবের করতল থেকে উদ্ভূত করতোয়া নদীর তীরে দেবী সতীর গুলফ পতিত হয়েছিল। দেবী এখানে ‘অপর্ণা’ নামে এবং তাঁর ভৈরব ‘বামেশ’ নামে বিরাজিত।]

যাই হোক, অচ্যুতরাজার ধনদৌলত অঢেল ছিল, কিন্তু সে-সব ভোগ করার জন্য কোন সন্তান ছিল না। রাজা একদিন সে-কথা ভেবেই চিন্তিত মনে বসে ছিলেন। দেবী ভক্তের এই দুঃখের কথা জানতেন, তাই তাঁকে কৃপা করে সমস্যা সমাধানের জন্য সেদিন একজন সিদ্ধ-সন্ন্যাসীকে তাঁর কাছে পাঠালেন। দেব-দ্বিজে রাজার ভক্তির অন্ত ছিল না। দেবীর অনুগ্রহে সন্ন্যাসী তাঁর কাছে এলে তিনি যথোচিত সম্মান দান করে তাঁকে সেবায় তুষ্ট করলেন। তুষ্ট সন্ন্যাসী তখন রাজার দুঃখ নিবারণের জন্য সন্তানলাভের ওষুধ দিয়ে তীর্থে গমন করলেন। যাবার আগে বলে গেলেন, সন্তান যদি কন্যা হয়, তাহলে তার যেন আঠারো বছর বয়স পূর্ণ হলে তবেই বিবাহ দেওয়া হয়, নতুবা ঘোর অনর্থ হবে।

নির্দিষ্ট সময়ে রানি এক কন্যাসন্তানের জন্ম দিলেন। রাজা সেই কন্যার নাম দিলেন, ভদ্রাবতী। ভদ্রাবতী যত বড় হতে লাগলেন, ততই তাঁর রূপলাবণ্য অপরূপ হয়ে উঠতে লাগল। ভদ্রার যখন বছর চোদ্দ বয়স হল, তখন রাজার এক আশ্রিত যুবক কোন কাজে ক্ষণিকের জন্য অন্তঃপুরে আসার অধিকার পেয়ে ভদ্রাকে দেখে মোহিত হল এবং তাঁকে পাওয়ার জন্য নানান ফিকির করতে লাগল। তার এই দুরভিসন্ধির কথা রাজার কানে যেতেই রাজা তাকে অপমান করে রাজ্য থেকে বের করে দিলেন।

আশ্রিত ছেলেটি খুব ধুরন্ধর ও বদ প্রকৃতির ছিল। সে অপমানের প্রতিশোধ নিতে অভিনব এক পন্থার আশ্রয় নিল। সে ইসলামধর্ম গ্রহণ করে ক্রমে গৌড়ের মুসলিম রাজা ফিরোজশাহের প্রিয় হয়ে উঠল। তারপর তাঁর পুত্র বাহাদুরশাহের কানে দিল ভদ্রাবতীর অপরূপ সৌন্দর্যের সংবাদ। সংবাদ শুনে যুবরাজের জাগল বিবাহের আকাঙ্ক্ষা। তিনি প্রস্তাব পাঠালেন অচ্যুতের কাছে।

প্রস্তাব পেয়ে অচ্যুতের মাথায় হাত। তিনি যেন পড়লেন একেবারে শাঁখের করাতের ওপর। কেননা, কন্যার বিবাহ দিলে কন্যার ধর্ম যাবে, অকাল বিবাহের জন্য সন্ন্যাসীর কথামতো ঘোর অমঙ্গল হবে; আবার অন্যদিকে যে-কোন অজুহাতে বিবাহে বাধা দিলেও গৌড়েশ্বরের রোষে চরম সর্বনাশ হবে। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি কন্যার ধর্মরক্ষাকেই সমীচীন বিবেচনা করলেন। মোহন মিশ্র নামে এক সাধকের অভিভাকত্বে থাকা এক ব্রাহ্মণপুত্রের সঙ্গে রাতারাতি আপন কন্যার বিবাহ দিয়ে দিলেন।

ভদ্রাবতীর বিবাহের সংবাদ গৌড়ে পৌঁছতে বিলম্ব হল না। সংবাদ পেয়ে গৌড়েশ্বর রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কমলাপুর আক্রমণের আদেশ দিলেন। বললেন, উদ্ধত অচ্যুতের গড় নিশ্চিহ্ন করে দিতে। গৌড়েশ্বরের আদেশে সেনাপতি কয়েক সহস্র সৈন্য নিয়ে অমনি কমলাপুর আক্রমণ করল। অচ্যুত দেখলেন, বিনাশের দিন আসন্ন। সময় থাকতে এই বিপদ থেকে কন্যা, জামাতা ও ইষ্টদেবীকে রক্ষা করতে হবে। অবিলম্বে তাদের রক্ষার ভার তিনি দিলেন মোহন মিশ্রকে।

যখন গৌড়েশ্বরের সেনা কমলাপুরে হানা দিল, তখনই গোপন জঙ্গলপথে স্বামীসহ ভদ্রাবতী ও দেবী সতীর শিলাভূত গুলফ নিয়ে মোহন মিশ্র নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে পদব্রজে কাশীধামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। করতোয়া নদীর তীর ধরে চলতে চলতে তাঁরা এক সময় পৌঁছলেন ভবানীপুর নামক স্থানে। এই স্থানে এসে মোহনের সাধকমনে অদ্ভুত এক পবিত্রতার অনুভূতি এল। বুঝলেন, এই স্থান দেবীর অবস্থানের জন্য প্রশস্ত। দেবীকে যথাবিহিত আচারে এই মুহূর্তে প্রতিষ্ঠা করলে, তা সকলেই জেনে যাবে এবং সেই খবর ক্রমে শত্রু-সেনাপতি ও সেনাদের কানে গেলে সকলের বিপদ। তাই এখানে দেবীকে প্রতিষ্ঠা না-করে সঠিক সময়ের অপেক্ষায় রাতের অন্ধকারে দৈবীশিলাটি গোপনে মাটিতে পুঁতে রাখলেন। তারপর ভদ্রাবতী ও তার স্বামীকে নিয়ে কাশীধামের নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে আসার জন্য রওনা দিলেন।

ওদিকে সুলতানী সেনার তাণ্ডবে কমলাপুর ধ্বংস হয়ে গেল। অচ্যুত যুদ্ধে নিহত হলেন। দেবীহীন গুলফপুরীও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। তারপর যুদ্ধ শেষে সব যখন শান্ত হল, তখন একদিন মোহন আবার ফিরলেন ভবানীপুরে একা। কিন্তু আঁতিপাঁতি খুঁজেও রাতের অন্ধকারে কোন স্থানে দেবীর শিলাঅঙ্গ পুঁতে রেখেছেন, সেই স্থান আবিষ্কার করতে পারলেন না। তখন মোহন হতাশ হয়ে চোখের জলে বিলাপ করতে লাগলেন। আর তারই মাঝে তিনি যেন এক সময় শুনতে পেলেন দেবীর আদেশ। দেবী বলছেন, এই ভবানীপুরেরই মনোহর চক্রবর্তীকে মোহন যেন দৈবীশিলা অনুসন্ধানের ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন। তাঁকে অনুগ্রহ করেই এই স্থানে তিনি অধিষ্ঠিত হবেন, নিজেই দেখিয়ে দেবেন গোপন শিলার স্থান,  এভাবেই সংঘটিত হবে তাঁর লীলা। দেবীর ইচ্ছার কথা মাথায় নিয়ে চোখের জল মুছে মোহন শান্ত হলেন। তারপর প্রসন্ন মনে গেলেন মনোহরের সন্ধানে।

ভবানীপুরে মনোহর চক্রবর্তী নামে এক শাক্ত সাধক তখন দেবী শক্তির অনুগ্রহ লাভের জন্য কঠোর সাধনা করছিলেন অনেকদিন ধরেই। একটি বেলগাছের নীচে তাঁর পঞ্চমুণ্ডীর আসন। খুঁজতে খুঁজতে মোহন তাঁর কাছে এসে জানালেন দেবীর আদেশ। আদেশ জানিয়ে মোহন চলে যেতেই ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। এক শাঁখারি এসে মনোহরকে জানাল যে, নদীর ধারে আসার পথে একটি বছর নয়ের বিবাহিত মেয়ে নাকি খেলছিল। খেলা ছেড়ে ছুটে এসে তার কাছে শাঁখা চেয়ে পরে। বলে যে, বাবা বেলতলায় জপ করছে, তার কাছ থেকে দাম নিও। শাঁখারির মুখে এমন কথা শুনে মনোহর অবাক। তাঁর তো কোন মেয়ে নেই! তাহলে এ মেয়ে কে! তিনি শাঁখারিকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে যান নদীর ধারের খেলার স্থানে। দেখেন, মেয়ে নেই, কিন্তু তার রাঙা হাতের ছাপ আছে এক জায়গায়। বোঝেন, মেয়ে হয়ে এ মায়েরই কৃপা। আরও অনুগ্রহের আশায় মনোহর চতুর্দিকে চান, যদি দেবীর দেখা মেলে। হঠাৎ মনোহরের চোখ পড়ে করতোয়ার জলে, দেবীর শাঁখা পরা দুই হাত জলের ওপরে উঠেই আবার মিলিয়ে গেল শূন্যে। অনুগৃহীত মনোহর বুঝলেন, দেবীর ইশারা। যেখানে দেবী হাতের ছাপ রেখে গেছেন, সেই স্থান খুঁড়ে তুলে আনলেন দৈবীশিলাখন্ড অর্থাৎ দেবী সতীর শিলাভূত গুলফ। তারপর অচিরেই একটি কুটির তৈরি করে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করলেন আপন সাধনক্ষেত্রের কাছে। দেবী অপর্ণা এভাবে যেহেতু ভবানীপুরে প্রতিষ্ঠিত হলেন, তাই অনেকে স্থাননামে তাঁকে ‘ভবানী’ বলেও ডাকতে শুরু করলেন।

দেবীকে প্রতিষ্ঠার সময় দেবীস্থানের নিকটেই মথুরেশ চক্রবর্তী নামে এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ আবার উদ্ধার করলেন দেবীর ভৈরব শিব ‘বামেশ’কে। তাঁর গাভী প্রতিদিন যেখানে গোপনে পালান থেকে আপনাআপনি দুধ ঝরাত, সেখানকার মাটি খুঁড়েই বামেশকে পেলেন তিনি। বামেশও তাঁদের হাতে প্রতিষ্ঠা পেলেন।

যাই হোক, মনোহর ও মথুরেশই ভবানীপুরে দেবীর প্রথম পূজারী। এখনও তাঁদের বংশধরেরাই দেবীর পূজা চালিয়ে যাচ্ছেন। মনোহরের সময় থেকে এখনও দেবীর প্রকৃত শিলাঅঙ্গকে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। কেন এই গোপনীয়তা, সে-সম্পর্কে সঠিক কথা জানা যায় না। তবে সচরাচর কোন দর্শনার্থী সেই শিলা দেখতে পান না। আবরণের ওপর জেগে থাকে শুধু দেবীর মুখমণ্ডল। এটুকুই ভকজন্রা দেখতে পান। মুখমণ্ডলটি সোনা দিয়ে নির্মিত। আশ্চর্য এক আশ্রয় ও অদ্ভুত এক প্রসন্নতা রয়েছে দেবীর সেই মুখ-মূর্তিতে।

মনোহরনির্মিত কুটিরকে মন্দিরের রূপ দেন পাঠান সেনাপতি রহমত খান। তিনি বেলকাঠ দিয়ে একটি জোড়বাংলা মন্দির তৈরি করে দেন। তারপর রাজা রামকৃষ্ণ রায় ইট দিয়ে জোড়বাংলা নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে রানি ভবানী দেবীর জন্য বারোদুয়ারী বিশাল মন্দির নির্মাণ করিয়ে দেন। বর্তমানে এই দেবস্থান পুকুর ও মন্দির মিলিয়ে প্রায় বারো বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত।

দেবীর নিত্যভোগে অবশ্যই থাকে তালের বড়া ও ছাগলের মাংস। মন্দিরে প্রভাতী বাল্যভোগ, দুপুরে অন্নভোগ এবং সন্ধ্যায় আরতি ও ভোগ নিবেদন করা হয়। এখানে রামনবমী, শারদীয়া দুর্গাপূজা, দীপান্বিতা শ্যামাপূজা, নবান্ন ও মাঘী-পূর্ণিমা খুব ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়। এই সময় বিশেষ পূজা উপলক্ষে প্রচুর ভক্তসমাগম হয়।।...      

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...