বৈকুণ্ঠে সেদিন কি জানি কেন, লক্ষ্মীর মন বড় উচাটন হল। মনে ভয়ানক আক্ষেপ জাগল তাঁর, তিনি যে স্বামী নারায়ণের নিত্য সেবা, নৈমিত্তিক সাধনায় নিজেকে সমর্পণ করেছেন; তাতে বুঝতে পারেন যে, স্বামী তাঁকে ভালোবাসেন। কিন্তু, ত্রিজগতের সমস্ত কিছুর উপরে তাঁকেই প্রিয় বলে মনে করেন কিনা, সে তো বুঝতে পারেন না! যতই এ-কথা বুকের ভেতর উথাল-পাথাল হতে লাগল, ততই মনের মধ্যে অশান্তি কুল ছাপিয়ে বাড়তে লাগল।
মনের সেই ওঠাপড়া নিয়েই একসময় অনন্ত শয্যায় যোগনিদ্রিত স্বামীর কাছে এলেন লক্ষ্মী। তাঁর পায়ের কাছটিতে বসে পদসেবা করতে শুরু করলেন। তাঁর হাতের স্পর্শে নারায়ণ চোখ খুললেন। চোখ গেল লক্ষ্মীর চিন্তাছন্ন মুখে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিসের চিন্তায় তুমি কষ্ট পাচ্ছ লক্ষ্মী?’ তখন লক্ষ্মী খানিক ইতস্তত করে বুকের ভেতর তোলপাড় হওয়া কথাটা বলেই ফেললেন।
স্মিতমধুর হেসে নারায়ণ বললেন, ‘মানুষের কাছে প্রাণ যেমন প্রিয়, তুমি আমার কাছে ততটাই প্রিয় লক্ষ্মী। কিন্তু সত্যি বলতে কি, সবার চেয়ে সবকিছুর ওপরে প্রিয় যদি কেউ হন, তিনি হলেন একমাত্র সত্যসুন্দর শিব। আর তাঁকে যাঁরা ভক্তিভরে পুজো করেন, তাঁরাও আমার কাছে শিবের সমান প্রিয় হন।’
নারায়ণের কথা শুনে মাথা নীচু করে লক্ষ্মী কয়েক মুহূর্ত মৌন হয়ে রইলেন। তারপর ছলছল চোখ দুটি তুলে নারায়ণকে বললেন যে, তিনিও শিবপুজো করে, শিবভক্ত হয়ে তাঁর কাছে শিব-সমান প্রিয় হয়ে উঠতে চান। তখন লক্ষ্মীর উপর অত্যন্ত প্রসন্ন হলেন নারায়ণ। আলতো হাতে লক্ষ্মীর ছলছল চোখ দুটি মুছিয়ে দিলেন। কানে দিলেন শিবের প্রিয় পঞ্চাক্ষর মন্ত্র ‘নমঃ শিবায়’। শিবলিঙ্গ স্থাপনের উপদেশ দিলেন। আর বললেন নিজের হাতে একশো পদ্ম চয়ন করে নিত্যপুজো করার কথা।
নারায়ণের নির্দেশে বৈকুণ্ঠে স্বয়ং লক্ষ্মী সোনা দিয়ে নির্মাণ করলেন শিবের লিঙ্গরূপ। রত্নময় মন্দির গড়ে সেই লিঙ্গমূর্তি প্রতিষ্ঠাও করলেন। তারপর সরোবরে গিয়ে নিজের হাতে গুনে গুনে চয়ন করলেন প্রস্ফূটিত একশোখানা পদ্ম। এর একটিও কম না, বেশিও না। শুরু করলেন শিবের নিত্য পুজো। এভাবেই কেটে গেল পুরো একটা বছর। এলো বৈশাখ মাস।
সেদিন বৈশাখের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া। প্রতিদিনের মতো পদ্ম চয়ন করে থালায় সাজিয়ে পুজোয় বসেছেন লক্ষ্মী। তাঁর চোখ বন্ধ, তিনি ধ্যানস্থ। সেই সুযোগে ভক্তকে পরীক্ষা করার জন্য শিব পুজোর থালা থেকে দুটি পদ্ম হরণ করে নিলেন। ধ্যানের পর লক্ষ্মী যখন অঞ্জলি দিতে শুরু করলেন, তখন হঠাত তাঁর চোখে পড়ল পুরো একশোটি পদ্ম তো নেই। দুটি পদ্ম কম রয়েছে। ইস, গণনায় এতবড় ভুল হয়ে গেল! এখন পুজো সম্পূর্ণ হবে কি করে! কাউকে কি আরও দুটি পদ্ম সরোবর থেকে তুলে আনতে বলবেন? তাই বা কি করে হয়, নিজের হাতে চয়ন করা পুষ্পে পুজোর যে ব্রত শুরু করেছেন, তা যে ভঙ্গ হবে তাতে! পুজোর মাঝে নিজে আসন ছেড়ে উঠলেও তো শিবের অপমান হবে! এখন উপায়? ব্যাকুল লক্ষ্মী যখন কোনদিকেই কোন দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না, তখনই তাঁর হঠাৎ মনে পড়ে গেল বিষ্ণুর একটি কথা। তিনি একবার লক্ষ্মীর স্তন দুটিকে তুলনা করেছিলেন যুগল পদ্মের সঙ্গে। ভগবান বিষ্ণুর কথা কখনও মিথ্যে হয় না। তাই সেই পদ্মসদৃশ স্তনদ্বয় উৎসর্গ করেই পুজো সম্পূর্ণ করতে চাইলেন লক্ষ্মী। অমনি বাম স্তন কেটে অঞ্জলি দিলেন শিবকে। তাঁর এই বলিদান দেখে শিবের খুব অনুশোচনা হল। মনে হল, পদ্ম দুটি হরণ না করলেই ভালো হত! তাই, লক্ষ্মী যখন তাঁর ডান স্তন কাটতে উদ্যত হলেন তখন মহাদেব আর চুপ করে থাকতে পারলেন না, সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে বাধা দিলেন তাঁকে। বললেন, ‘মা, তোমার স্ত্রীঅঙ্গ ছেদন করে আমায় তুমি অনুতপ্ত করেছ। প্রসন্নও করেছ। বল মা, তুমি কি বর চাও?’ লক্ষ্মী তাঁকে প্রণাম করে বললেন, ‘হে দেবাদিদেব! আশীর্বাদ করুন, আমি যেন আমার স্বামীর সবচেয়ে প্রিয় হতে পারি।’
শিব তখন মৃদু হেসে বললেন, ‘তাই হবে, মা। আমার আশীর্বাদে তোমার অঙ্গও তুমি ফিরে পাবে। আর তোমার এই বলিদানের কথা ত্রিজগতে কেউ কোনদিন ভুলতে পারবে না। কারণ, তোমার ঐ অঙ্গ থেকে ধরায় জন্ম হবে ‘বেল’ নামক বৃক্ষের। তার পত্র হবে আমার ত্রিনয়ন। ফল হবে তোমার কৃত-উৎসর্গ অঙ্গের অনুরূপ। তোমার ‘শ্রী’ নাম স্মরণ করে লোকে এই বৃক্ষকেও ‘শ্রী’ বলে ডাকবে, পাতাকে বলবে ‘শ্রীপত্র’, ফলকে বলবে ‘শ্রীফল'। যতদিন ধরায় চন্দ্র-সূর্য থাকবে, এই বৃক্ষও ততদিন থাকবে। এর পত্রে পূজা পেয়ে আমি হব পরম তুষ্ট।’
শিবের অনুগ্রহে এ-ভাবেই বৈশাখের তৃতীয়া তিথিতে পত্রপুষ্প ও ফল সহ বেলবৃক্ষের জন্ম হল পৃথিবীতে, বেলপত্রও হয়ে উঠল শিব পুজোর আবশ্যিক অর্ঘ্য।
গল্পের উৎস : শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস রচিত, 'শিব পুরাণ'।