‘ছন্দে লেখা একটি চিঠি চেয়েছিলে মোর কাছে,
ভাবছি বসে, এই কলমের আর কি তেমন জোর আছে'।
যে দুই তরুণীর আবদারে এই কবিতা-পত্র ' শিলঙের চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁদের অন্যতম হলেন শোভনাসুন্দরী দেবী।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথের পঞ্চম কন্যা শোভনার জন্ম জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। তাঁর বড় হয়ে ওঠার সময় জোড়াসাঁকো বাড়ির ঔজ্জ্বল্য কিছুটা ম্লান হয়ে এসেছিল। যদিও অন্দরবাসিনীদের পড়াশোনা বা সঙ্গীতচর্চা চলেছিল যথা নিয়মে।
লরেটোয় পড়া শোভনার বিয়ে হয়েছিল হাওড়া শিবপুরের ইংরেজির অধ্যাপক নগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
কর্মসূত্রে তিনি ছিলেন রাজস্থানের জয়পুরবাসী। সেখানে গিয়ে নিজের কাজের জগৎ খুঁজে পেলেন শোভনা। রাজস্থানী উপকথা, রূপকথা, প্রবাদ, প্রবচন ইত্যাদি সংগ্রহ করতে শুরু করলেন তিনি। তাঁর কাজের ধরন ছিল যথেষ্ট ব্যতিক্রমী। তিনি শুধু প্রবাদ সংগ্রহ করেননি। রাজস্থানী প্রবাদের সঙ্গে মিল আছে এমন বাংলা প্রবাদ খুঁজে বার করেছেন। শোভনার আগে কোনো ভারতীয় মহিলা লোকজীবনকথা সংগ্রহে এত মনোযোগী হননি। তাঁর সংগ্রহ করা কয়েকটি প্রবাদ হল –
‘প্রবচন।১। নির্বীর ভূমি কব ই জন হোয়।
অর্থানুবাদ: নির্বীর দেশ কখন হয় না।
অর্থ: দেশ কখনও একেবারে বীরশূন্য হয় না।
বীরমাতা রাজস্থানেই এই প্রবচন শোভা পায়।‘
‘শালী ও শাশুড়ী প্রবচন।১। সালী নহী তো সাসু সেহী মসখরী।
।২। সালী ছোড় সাসু সেহী মসখরী।
অনুবাদ।১। শালী নাই তো শাশুড়ীর সঙ্গে ঠাট্টা।
অর্থ।১। শালী নাই বলে কি শাশুড়ীর সঙ্গে ঠাট্টা চলে?’
।২।ঠাট্টার সম্পর্ক ছেড়ে, শাশুড়ীর সঙ্গে ঠাট্টা রীতিবিরুদ্ধ।‘
এইভাবে প্রবাদ সংগ্রহ করে ও বিশ্লেষণ করে শোভনা লোক সাহিত্য সংগ্রাহকের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। সেকালের এক অভিজাত কন্যার পক্ষে যা ছিল অভাবনীয়।
একাধিক রাজস্থানী উপকথা সংগ্রহ করে, অনুবাদ করে ‘পুণ্য’ পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন তিনি। শোভনার সংগৃহীত কয়েকটি উপকথা হল- ফুলচাঁদ (‘ইহা একটি জয়পুরী উপকথা। এইরূপ উপকথা হইতে জাতীয় চরিত্র অনেকটা বুঝা যায় বলিয়া প্রকাশিত হইল।‘), আনাররাণী বা ডালিমকুমারী, লুব্ধ বণিক তেজরাম, লক্ষ টাকার এক কথা, দিলীপ ও ভীমরাজ ইত্যাদি। জয়পুরের লোকশিল্প ডোমলা শিল্পের সঙ্গে পুণ্য’ পত্রিকার পাঠকদের পরিচয় করিয়েছেন শোভনা।
অনুবাদের দিকে ঝোঁক ছিল জোড়াসাঁকো বাড়ির অনেকেরই। শোভনা ও সেই ধারার অনুসরণ করেছেন। ভারতীয় পুরাণ থেকে কাহিনী সংগ্রহ ও অনুবাদ করে প্রকাশ করেছেন তিনি। স্বর্ণকুমারী দেবীর উপন্যাস ‘কাহাকে’ অনুবাদ দিয়ে শুরু। তারপর ‘ইনডিয়ান নেচার মীথস’ নামে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, বেদ, উপনিষদ এবং বিভিন্ন লোককাহিনী থেকে কাহিনী সংগ্রহ করে, ইংরেজিতে অনুবাদ করে ছোটদের জন্য একটি সংকলন করেছিলেন। এরপর প্রকাশিত হল ‘ইনডিয়ান ফেবলস এ্যান্ড
ফোকলোর' ও ‘দি ওরিয়েন্ট পার্লস’ নামের রূপকথা সংকলন। এই বইগুলি প্রকাশিত হয়েছিল লন্ডনের ম্যাকমিলান কোম্পানি থেকে। আর একটি উল্লেখযোগ্য বই ‘টেলস্ অব দি গডস্ অব ইন্ডিয়া’-যেখানে বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, শতপথ ব্রাহ্মণ, কালিদাসের নানান কাব্য, ভবিষ্যপুরাণ এবং মনসামঙ্গল থেকে তিনি যুগল প্রেমের কাহিনী সংগ্রহ করে তার অনুবাদ শুধু নয়, প্রতিটি কাহিনীর উৎস উল্লেখ করে গবেষকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাতেও ভ্রমণকাহিনী সহ নানান নিবন্ধ লিখেছেন শোভনা। ‘ লন্ডনে’, ' য়ুরোপে মহাসমরের পরে’, ‘মহাযুদ্ধের পর প্যারী নগরীতে’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। স্বামী নগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন ইংরেজি ভাষাসাহিত্যের অধ্যাপক। তিনিও কবিতাচর্চা করতেন। শোভনার লেখালেখিতে যে তাঁর উৎসাহ ছিল তা অনুমান করা যায়। দেশে ফেরার পর নি:সন্তান শোভনা লেখালেখির পাশাপাশি হাওড়া গার্লস স্কুলে ইংরেজির শিক্ষকতা করতেন। নিজের একটি গানের স্কুলও ছিল।
তাঁর মৃত্যুর পর নগেন্দ্রনাথ ‘প্রেমাঞ্জলি’ নামে একটি শোকগাথা ছাপিয়ে ছিলেন, যার ভূমিকায় ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘শোভনা’ নামে একটি ছোট্ট কবিতা-
'অস্তরবি- কিরণে তব জীবন- শতদল/ মুদিল তার আঁখি।/ মরমে যাহা ব্যাপ্ত ছিল স্নিগ্ধ পরিমল/ মরণে নিল ঢাকি।‘ জৈষ্ঠ্য ১৩৪৪-তে লেখা এ কবিতা ১৩৪৪-র কার্তিকের ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।।