লড়াই। কিছু কিছু মানুষের জীবনে এই শব্দটি আজীবন নানাভাবে পাক খেতে থাকে। বারবার লড়াই কিছু মানুষকে জীবন চেনায়। তারা হারতে জানে না। সব শেষ হওয়ার ইঙ্গিত থেকেই তারা শুরু করতে জানে। তাই তাদের সত্যিরা গল্পের মত হয়। কিন্তু তাতে মিশে থাকে অনেকখানি জীবনবোধ। আর থাকে মাটির গন্ধ।
২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাস। আমরা হয়তো তখন নিশ্চিন্তে ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছি। কিন্তু সৈন্যরা জেগে। দেশের প্রহরী হয়ে। সীমানার কোন প্রান্তে লড়ে যাচ্ছেন তাঁরা। তেমনই এক লড়াইয়ের প্রান্তরের কথা। হঠাৎ করে সেখানে বিস্ফোরণ হলো। একজন সৈন্য হারালেন তাঁর পা। তাঁর বয়স তখন তেইশ বছর। জীবনের যাত্রাপথ প্রায় পুরোটাই বাকি। তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো সেই সৈন্যকে। কিন্তু কোনভাবেই রক্ষা করা গেল না তাঁর পা। বাদ গেলো।
পরিচিত মানুষ, সহকর্মী এবং আত্মীয় পরিজনের সান্ত্বনা, স্তোকবাক্য এই ছিল সঙ্গী সেই আহত যোদ্ধার। কিন্তু ভেতরে যন্ত্রণারা জমে পাথর। লড়াইয়ের ময়দানে থাকা মানুষটা তখন যুদ্ধক্ষেত্র খুঁজছে। ভেতরে ভেতরে।
খোঁজ পেলেন সেনাবাহিনীর বিশেষ প্রশিক্ষণ শিবিরের। যে সমস্ত সৈন্যরা যুদ্ধে তাঁদের মূল্যবান অঙ্গ হারান, তাঁদের জীবনে ইতিবাচকতা ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন বিষয়ে উৎসাহ দেওয়া হয় সেই সংগ্রামীদের। খেলাধুলাও তার অংশ।
জীবনের বাঁক বদল হলো এই প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগদান করে। খেলাধুলোয় উৎসাহ তাঁকে পৌঁছে দিল জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতায়। এমনই সাহসী যোদ্ধা সোমান রানা।
২০০৬ সালের ১লা ডিসেম্বর নিজের ইউনিটের হয়ে কর্মরত অবস্থায় নিজের ডান পা হারান হাবিলদার সোমান রানা। কিন্তু তার পরেই তিনি শুরু করেন প্যারা-অ্যাথলিট হিসেবে নতুন যাত্রা। বর্তমানে এই প্যারা-অ্যাথলিট টোকিও প্যারাঅলিম্পিকসে শট পাট এফ-৫৭ বিভাগে অংশগ্রহণ করছেন।
আপাতত এই ভয়হীন যোদ্ধা প্যারাঅলিম্পিক নডে অনুশীলন করছেন। অনুশীলন কেন্দ্রটি পুনেতে অবস্থিত। একজন আন্তর্জাতিক প্যারা-অ্যাথলিট হিসেবে ভারতের নাম উজ্জ্বল করেছেন সোমান রানা। বর্তমানে তাঁর র্্যাংক সমগ্র বিশ্বে দ্বিতীয়।
শিলংয়ের বাসিন্দা সোমান। মধ্যবিত্ত পরিবার। দিনযাপনের জন্য আর পাঁচ জনের মতই সংগ্রাম করেছে সোমানের পরিবার। তবুও ছেলেকে কখনো নিরুৎসাহ করেননি। বরং প্রতিবন্ধকতা জয় করে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন। সোমানও গর্বিত করেছেন তাঁর পরিবারকে।
২০১৭ সালে প্রথমবার সোমান ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর প্যারা-অলিম্পিক নডে অনুশীলন শুরু করেছিলেন। এই প্যারা-অলিম্পিক নডের অ্যাথলিটরা মোট ২৮টি আন্তর্জাতিক পদক এবং ৬০টি জাতীয় পদক অর্জন করেছে এখনো পর্যন্ত। তাই সরকারও এ বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন। সাহায্য করছেন সকল উৎসাহী যোদ্ধাদের।
এই বছরের শুরুতে বিশ্ব প্যারা-অ্যাথলেটিকস গ্রাঁ পি-তে শট পাট বিভাগে সোনা জয় করেছেন সোমান রানা। এছাড়াও জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে রূপো এবং সোনা দুই-ই পেয়েছেন। দেশ, আন্তর্জাতিক দুই স্তরেই পরিচিত প্রতিযোগী সোমান।
করোনা এবং দীর্ঘ লকডাউনে সোমান রানার অনুশীলন কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবুও হাল ছাড়েননি তিনি। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন খেলার ময়দানে। শুরু করেছেন নিয়মিত অনুশীলন।
বর্তমানে সোমান রানার পাখির চোখ টোকিও প্যারা-অলিম্পিক। ভয়হীন, দুঃসাহসী এই মানুষটির জয়ের জন্য সারা বিশ্ব প্রার্থনা করছে।