শোভা সেন.. এক প্রবাদপ্রতিম অভিনেত্রী

বাংলার দুই প্রবাদতুল্য নাট্যদল "এলটিজি" ও "পিএলটি"র প্রধান চালিকাশক্তি ও অভিনেত্রী ছিলেন তিনি। আমৃত্যু জড়িয়ে ছিলেন এই থিয়েটার দলের সঙ্গে। বৃদ্ধ বয়সে স্মৃতি কখনো কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করতো। তবুও পিএলটি(পিপলস্ লিটল থিয়েটার)র কোনো নতুন নাটক মঞ্চস্থ হলে উপস্থিত থাকতেনই। থিয়েটারের জন্য নিজের বাড়ি বন্ধক দিতেও দ্বিধা বোধ করেন নি তিনি। আজীবন কম্যুনিস্ট ভাবধারার অনুসারী ছিলেন। তাঁর আত্মজীবনীর নাম "স্মরণে বিস্মরণে নবান্ন থেকে লালদুর্গ".. তিনি...প্রবাদপ্রতিম অভিনেত্রী শোভা সেন।

১৯২৩ এ সেপ্টেম্বরে জন্ম তাঁর অবিভক্ত বাংলার (এখনকার বাংলাদেশের) ফরিদপুরে। পিতা ডাক্তার নৃপেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। দেশভাগের আগেই চলে আসেন কলকাতায়। ভর্তি হন বেথুন কলেজে। কিন্তু কৈশোর থেকেই অভিনয়ের প্রতি তীব্র টান। স্কুলে পড়ার সময়েই নাটকে অভিনয় করেছেন। ১৯৪২এ তাঁর বিয়ে হয় দেবপ্রসাদ সেনের সঙ্গে। স্বামীর উৎসাহ এবং প্রশ্রয়েই তিনি ১৯৪৪এ যোগ দেন "ভারতীয় গণণাট্য সংঘে" এবং অভিনয়ের সুযোগ পান "নবান্ন" নাটকে। এই নাটকে অভিনয় করে তিনি ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। বাম রাজনীতিতেও তাঁর এখানেই হাতে খড়ি। এই অভিনয় নিয়েই পরবর্তী সময়ে স্বামীর সঙ্গে মতবিরোধ এবং বিচ্ছেদ। ১৯৬১তে দ্বিতীয় বিবাহ বিখ্যাত নাট্যকার অভিনেতা উৎপল দত্তের সঙ্গে।

সবসময় ছিলেন উৎপল দত্তের পাশে। মূলতঃ শোভা সেনের উৎসাহেই উৎপল দত্ত বাংলা নাটক পরিচালনা এবং অভিনয় শুরু করেন। স্বামী যাতে সারাক্ষণ থিয়েটারে কাজ করতে পারেন সেইজন্য শোভা সেন বহু সিনেমাতেও মায়ের রোলে বা কম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কিন্তু নায়িকা হিসেবে ও যে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৫৬তে "লাক্স" সাবানের বিজ্ঞাপনে যার ক্যাপশন 'তিনি বলে থাকেন "একমাত্র বিশুদ্ধ সাবানই এত শুভ্র হতে পারে"...

নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’, ঋত্বিক ঘটকের ‘নাগরিক’-এর মতো ছবিতে অভিনয়ও করেন তিনি। ১৯৫২ সালে হিন্দি ছবি ‘বাবলা’-য় অভিনয়ের সুবাদে দেশের সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কারও পেয়েছিলেন শোভা।

কিন্তু মঞ্চের শোভা সেন অন্য ব্যক্তিত্ব। ‘‌কল্লোল’‌–‌এ বীর নাবিক যোদ্ধা শার্দূলের বীরাঙ্গনা মা কৃষ্ণাবাই। একই রকম তেজিয়ান চরিত্র ‘‌ফেরারী ফৌজ’‌–‌এ নায়ক অশোকের মা বঙ্গবাসী দেবী।
উৎপলবাবু যখন জেলে যান তখন ‌এলটিজি‌তে ভাঙন ধরলো। অভাব, অনিশ্চয়তার মধ্যেও সংসারের, উৎপল দত্তের নাট্যজীবনের হাল ধরে রেখেছিলেন শোভা। উৎপল বাবু ফিরে আসার পর আরো শক্তিশালী নাট্যদল "পিএলটি" তৈরি করেন। পাশে সহধর্মিনী এবং সহযোদ্ধা শোভা সেন। একের পর এক দুরন্ত নাটক ‘‌সূর্যশিকার’, ‘‌টিনের তলোয়ার’‌, ‘‌ব্যারিকেড’‌, ‘‌দুঃস্বপ্নের নগরী’‌। আর তার প্রতিটিতেই শোভা সেনের দুরন্ত অভিনয়। জার্মানিতে গিয়ে অভিনয় করেছেন। উৎপল দত্তের সঙ্গে গেছেন মস্কো, চীন, ইংল্যান্ড। ২০১০ এ পেয়েছেন "মাদার তেরেসা অ্যাওয়ার্ড"..

তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখতে গিয়ে উৎপল দত্ত লিখেছিলেন, ‘‌ব্যারিকেডে দাঁড়িয়ে তুমি আর আমি/‌লড়ে যাচ্ছি দুই কমরেড।’‌ ২০১৭র তেরোই আগস্ট কমরেড শোভা সেন পাড়ি দিয়েছিলেন এই পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোনো জগতে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...