'শিব পুরাণ'-এর কথকঠাকুর সূত তাঁর শ্রোতা ঋষিদের কাছে শিবরাত্রিতে নিশিজাগরণ ও দীপদানের মাহাত্ম্য বিষয়ে একটি গল্প বলেছিলেন। সেই গল্পটিই এখন স্মরণ করব, শুনুন :
এক ছিলেন বামুন, আর ছিলেন তাঁর বামনি। তাঁদের ছিল দু'টি ছেলে সুনিধি ও বেদনিধি। বামুন-বামনির যেমন দেব-দ্বিজে ভক্তি ছিল, ধর্মে-কর্মে মন ছিল, শাস্ত্র-অশাস্ত্র জ্ঞান ছিল; তেমনটি ছিল বড় ছেলে সুনিধিরও। কিন্তু, ছোট ছেলে বেদনিধি ছিল যেন প্রহ্লাদকুলে দৈত্য।
বেদশাস্ত্রে অগাধ পাণ্ডিত্য থাকলেও তার চরিত্র একেবারেই ভালো ছিল না। কুলে কালি দিয়ে নিত্যিদিন চার বেলা নগর-নাচনির ঘরে গিয়ে ফূর্তি করে কাল কাটাত। তাই বাপে-মায়ে-পোয়ে দিনরাত অশান্তির অন্ত ছিল না। তাতেও শোধরানোর সদিচ্ছা বেদনিধির কোনদিন জাগল না। এবং, তারই জেরে একদিন এক মারাত্মক কাণ্ড ঘটে গেল।
বামুন বহু শাস্ত্রে পণ্ডিত হওয়ায় রাজার খুবই প্রিয় ছিলেন।
কোন একটা কারণে (পুরাণকার কারণটি বলেননি) খুশি হয়ে রাজা বামুনকে একদিন একটি সুন্দর সোনার চুড়ি উপহার দিলেন। বামুনও খুশি হয়ে সেই উপহার মাথায় করে বাড়ি ফিরে গিন্নিকে রাখতে দিলেন। গিন্নিও অমন রাজকীয় সোনার চুড়ি পেয়ে আহ্লাদে আটখানা হয়ে সিন্দুকে তুলে রাখলেন। এটি আবার আড়াল থেকে বেদনিধি দেখে ফেলল।
দেখে, তারও আনন্দের সীমা রইল না। চুড়িটি নাচনিকে দিতে পারলে, সারাজীবন নাচনি তার বাঁধা হয়ে থাকবে। ফলে, সে সেটি চুরি করল এবং নাচনিকে গিয়ে নিবেদন করল। নাচনিও চুড়ি পেয়ে তৎক্ষণাৎ হাতে পরে লাস্যের নাচ নাচতে শুরু করল।
সেদিন রাজধানীতে উৎসব। আয়োজন হল নাচগানের। আরও আরও অনেক নগর-নাচনিদের মতো বেদনিধির নাচনিটিও গেল রাজদরবারে নাচতে। নাচ দেখতে দেখতে রাজার হঠাৎ চোখ পড়ে গেল তার হাতের সোনার চুড়িটির ওপর। অমনি ভ্রু কুঁচকে উঠল। তাঁর দেওয়া উপহার, বামুন নিজের কাছে না-রেখে অন্যকে উপহার দেয় কী করে? এ যে রাজ-উপহারের অপমান!
নাচ শেষ হতেই নাচনিকে একান্তে ডাকালেন রাজা। তারপর জিজ্ঞেস করলেন যে, ওই চুড়ি নাচনি পেল কোথায়? নাচনি প্রথমে আসল ব্যাপার চেপে রেখে বলল যে, সে নাকি স্যাকরাকে দিয়ে বানিয়ে নিয়েছে!
নাচনির মুখে অমন বেমালুম মিথ্যে শুনে অমনি রাজা রেগে অস্থির হয়ে উঠলেন। কোন স্যাকরা? ডাকো তাকে! নাচনির কথা মিথ্যে প্রমাণিত হলে চরম শাস্তি দেওয়ার হুমকি দিতেই ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে নাচনি গড়গড় করে সত্যিটা বলে ফেলল। বলে ফেলল যে, রাজপ্রিয় বামুনের ছোট ছেলে বেদনিধি তাকে চুড়িটি দিয়েছে!
রাজা বড় বিচক্ষণ মানুষ। সত্যিটা শুনে খানিক শান্ত হলেন। নাচনির হাত থেকে চুড়িটি নিয়ে তাকে ছেড়ে দিলেন। তারপর ডাকালেন তাঁর প্রিয় বামুনকে।
বামুন এসে হাতজোড় করে দাঁড়াতেই রাজা শান্ত গলায় বললেন, ওহে ব্রাহ্মণ, তোমাকে সেদিন যে সোনার চুড়িটি উপহার দিয়েছিলাম, সেটি একবার নিয়ে এসো তো, সামান্য প্রয়োজন আছে।
বামুন তেমনি হাতজোড় করেই 'যথা আজ্ঞা মহারাজ!' বলে বাড়ির পথে রওনা দিলেন।
বামুন বাড়িতে এলেন। স্ত্রীকে চুড়িটি বার করে দিতে বললেন। কিন্তু, সিন্দুক খুলেই চোখ সটান কপালে উঠল স্ত্রীর। চুড়িটি নেই!
স্ত্রী সমস্ত সিন্দুক ওলটপালট করে আঁতিপাঁতি খুঁজলেন, নাহ্, নেই নেই নেই! একথা শুনেই বামুনের তো আত্মারাম প্রায় খাঁচাছাড়া হল। মহারাজ এবার গলা কাটেন, না নোলা কাটেন, কে জানে! দিশাহারা হয়ে বামুন বামনিকে যা নয় তাই বলে কথা শোনালেন। বামনিও বামুনের কী হবে ভেবে, কেঁদে ফেললেন। তারপর মাথা ঠাণ্ডা করে দু'জনে মিলে কত খুঁজলেন; কিন্তু হারানো চুড়ি ফিরে পেলেন না।
তখন বামুন কী আর করেন, যা হবে তা হবে ভেবে, অপরাধীর মতো মাথাটি নীচু করে মহারাজের কাছে হাজির হলেন। ওদিকে বামনি বামুনের কিছু হয়ে গেলে তাঁর কী হবে ভেবে ফের পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসলেন।
বামুন মহারাজের কাছে নতজানু হয়ে বসলেন। বললেন, আমি বড় অপরাধ করে ফেলেছি, মহারাজ! আপনার দেওয়া উপহার হারিয়ে ফেলেছি!
মহারাজ তখন সোনার চুড়িটি বের করে বললেন, দেখ তো তোমার হারানো উপহার এটা কি না?
বামুন মুখ তুললেন। দেখলেন। অবাক হলেন। হ্যাঁ, মহারাজ, এটাই তো আপনার দেওয়া সেই অমূল্য উপহার! কোথায় পেলেন, আপনি?
তখন মহারাজ নাচনির কাছ থেকে শোনা সমস্ত ঘটনা শোনালেন বামুনকে। বললেন, তুমি আমার প্রিয়জন, চাইনা তোমার কোন ক্ষতি হোক। তবে, যে কুসন্তান রাজ-উপহারের মর্যাদা দেয় না, সে রাজাকে সম্মান দেবে কেমন করে! তাই হে ব্রাহ্মণ, পুত্রকে যদি সৎপথে না আনতে পারো, তবে তাকে ত্যাগ করো। নয়তো সে তোমার এবং সমাজের চরম বিপদের কারণ হতে পারে!
বামুন লজ্জিত তো ছিলেনই, এবার নিজেকে আরও অপরাধী ভেবে বার বার ক্ষমা চাইলেন মহারাজের কাছে। ছেলের জন্য তাঁর সামাজিক সম্মান আগেই ক্ষুন্ন হতে শুরু করেছিল, এবার ক্ষুন্ন হল রাজ-সম্মানও!
রাজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ক্ষোভে-দুঃখে-রাগে অস্থির হয়ে বাড়ি ফিরলেন বামুন। বাড়ি ফিরে যত নষ্টের গোড়া অবাধ্য বেদনিধিকে চোখের সামনে পেয়ে তাঁর মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। তিনি খড়ম খুলে মারতে মারতে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাকে বাড়ি থেকে বার করে দিলেন। বললেন, এ জন্মে যেন তোমার মতো কুলাঙ্গারের মুখ দেখতে না হয়!
বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে বেদনিধি গেল নগর-নাচনিটির ঘরে। কিন্তু, রাজার ভয়ে নাচনিও তার আপন রইল না। তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল। সে জানত, বসুন্ধরায় কেউ কোত্থাও না-থাকলেও, তার নাচনি আছে। আজ সেই নাচনির ঘরেও তার জায়গা হল না! বাপের হাতে বিতাড়িত হয়েও তার যতটা না দুঃখ হয়েছিল, তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি কষ্ট হল নাচনির কাছে বিতাড়িত হয়ে।
ঘর-বারে কোথাও আশ্রয় না-পেয়ে বেদনিধি এবার দু'চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল। কী করবে ভেবে না পেয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে লাগল। নগর ছাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল অনেক অনেক দূরের লোকালয়ে। দিন কেটে রাত হল। হেঁটে হেঁটে অবসন্ন তো হলই, খিদেয়ও অস্থির হয়ে উঠল সে। অথচ সঙ্গে কানাকড়ি নেই, এ-রাজ্যে ভিক্ষা করা মানা, চুরি করবার সুযোগটিও নেই।
এমন সময় হঠাৎ পুজোর নৈবেদ্য নিয়ে ঢাক বাজিয়ে একদল মেয়ে-পুরুষকে মন্দিরের দিকে যেতে দেখল সে। তাদের হাতের নৈবেদ্য দেখে অস্থির খিদে চনচন করে উঠল। সুযোগ পেলে সেগুলোই খাবার প্রত্যাশা নিয়ে সে তাদের পিছু নিল।
মন্দির প্রাঙ্গণ আলোয়-ফুলে সেজে রয়েছে। আজ মহা শিবরাত্রির পুজো। সারারাত ধরে পুজোর জন্য বিকেল থেকেই শুরু হয়েছে ভক্তকুলের ভিড়। রাজপ্রহরীদের প্রহরাও রয়েছে। মন্ত্র আর পূজারীর 'ববম ববম' ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠছে চারিদিক। শুরু হয়ে গেছে প্রহরে প্রহরে পুজো।
সারাদিনের অনাহারে ক্লিষ্ট বেদনিধি প্রাঙ্গণের একটি কোণায় খাবারের অপেক্ষায় চোখের পাতাজোড়া ঠায় খুলে বসে রইল। প্রহরের পর প্রহর কাটতে লাগল। খিদের পরত চড়তে চড়তে ধৈর্যের বাঁধও তার ভাঙতে লাগল। সুযোগ পেলেই এবার সে চুরি করবে, ছিনিয়ে খাবে!
সুযোগ এল তৃতীয় প্রহরের পর। ভক্তেরা পুজো করে যে-যেখানে পারল মন্দিরের প্রাঙ্গণে শুয়ে পড়ল। তারা আর জেগে থাকতে পারছিল না। ভাবল, এখন তো শুয়ে পড়া যাক, চার প্রহরে উঠে না-হয় আবার পুজো দেবে। তারা ঘুমিয়ে পড়তে প্রহরীরাও নিজেদের মধ্যে গল্পগুজবে মত্ত হয়ে অন্যমনস্ক হল।
সেই সুযোগে ক্ষুধার্ত বেদনিধি অস্থির হয়ে উঠে দাঁড়াল। পা টিপে টিপে হাজির হল গিয়ে গর্ভগৃহের মধ্যে। দেখল, সলতে পুড়তে পুড়তে দীপ প্রায় নিভে এসেছে, নৈবেদ্যগুলোও ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। শিবলিঙ্গের গায়েও অন্ধকারের ছায়া পড়েছে।
সে নিজের কাপড় ছিঁড়ে সলতে পাকিয়ে দীপে সংযোগ করতেই দীপালোক উজ্জ্বল হল। শিবলিঙ্গের গায়ের অন্ধকার দূর হল, নৈবেদ্যের সাজানো থালাগুলিও স্পষ্ট দেখা যেতে লাগল। তখন সে চুপি চুপি শব্দ না-করে একটি থালা তুলে গর্ভগৃহের বাইরে বেরিয়ে এল।
কিন্তু, চুপিসাড়ে প্রাঙ্গণ থেকে বেরোতে গিয়ে অন্ধকারে শুয়ে থাকা এক ভক্তের গায়ে তার পা পড়ে গেল। অমনি ভক্তটি ধড়মড় করে জেগে উঠে 'চোর', 'চোর'-বলে চেঁচিয়ে উঠল। বেগতিক বুঝে বেদনিধি ছুটে পালাতে গেল। কিন্তু, পারল না। ভক্তের চিৎকারে সচকিত হয়ে উঠল প্রহরীরাও। তাদের ছোঁড়া বল্লম সোজা তার পিঠে এসে বিঁধল। তাতেই বেদনিধি মুখ থুবড়ে পড়ল। ছিটকে পড়ল হাতের থালা। ধুলোয় ছড়িয়ে পড়ল আহার। অতৃপ্ত খিদে নিয়ে বেদনিধি রক্তে ভেসে সেই যে পড়ল, আর উঠল না। মারা গেল।
বেদনিধি মারা যেতেই তার আত্মাটি নিয়ে যেতে একইসঙ্গে হাজির হল যমদূত এবং শিবদূতেরা। দুই দূতদলই একে অপরদের দেখে অবাক। যমদূতেরা বলল, ওহে, শিবদূতেরা তোমরা এই পাপী-অনাচারী-ব্যাভিচারী লোকটার আত্মা নিতে এসেছ কেন? এটাকে অনন্ত নরকে পাঠাতে আমরাই নিয়ে যাবো! শিবদূতেরা বলল, তা কেন? শিবরাত্রিতে দীপ দিয়ে সমস্ত রাত জাগন্ত ও উপবাসী থেকে মন্দিরে অবস্থান করে ওর সমস্ত পাপ নষ্ট হয়েছে। এর স্থান এখন শিবলোকে। একে আমরাই নিয়ে যাবো!
দু'পক্ষই চাইছে বেদনিধির আত্মা নিয়ে যেতে, কেউ নিজের দাবি ছাড়তে নারাজ। ফলে, জমে উঠল কাজিয়া। সমাধানের জন্য তারা হাজির হল যমরাজার দরবারে।
সব শুনে যম বললেন, শিবদূতেরা ঠিকই বলেছে, লোকটা মহাপাপিষ্ঠ হয়েও শিবরাত্রিতে অজান্তে উপবাস, রাত্রিজাগরণ ও দীপদান করে পূর্ণব্রতের পুণ্য লাভ করে পবিত্র হয়ে উঠেছে। শিবরাত্রি ব্রতের এমনই মাহাত্ম্য। তাই বলা হয়, শিবরাত্রি ব্রতের চেয়ে মহান ব্রত আর কিছু হয় না। তোমরা শান্ত হও, এখন আমি দেবাদিদেবের ইচ্ছেয় বেদনিধিকে জীবনদান করব।
শিবের ইচ্ছেয় যম বেদনিধিকে শুধু জীবনদানই করলেন না, তাঁকে 'ধন্য ধন্য' বলে প্রণিপাত করে কলিঙ্গ দেশের রাজা করে দিলেন।
তারপর দিন কাটতে লাগল। বেদনিধি রাজা হয়ে সুশাসন করে, শিবের মন্দির নির্মাণ করে পুত্রানুক্রমে বহুকাল শিবপুজো ও শিবরাত্রি মাহাত্ম্য প্রচার করে অবশেষে একদিন সশরীরে স্বর্গে গেল।