শিবরাত্রি ব্রতে রুরুদ্রুহ ব্যাধের উপাখ্যান

শিবরাত্রির রাতে প্রহরে প্রহরে শিবপুজোর ফললাভ ও মাহাত্ম্য নিয়ে 'শিব পুরাণ'-এ একটি গল্প আছে, আজ সেই গল্পটিই সহজ করে বলার চেষ্টা করছি, শুনুন :

রুরুদ্রুহ নামে এক ভিল ছিল। সে কখনও চুরি করে, কখনও বা বনের পশুদের শিকার করে সংসার চালাত। সংসারটি তার নেহাত ছোট ছিল না। বউ ছিল, গুচ্ছের ছেলেপুলে ছিল; আর ছিল বুড়ি মা।

সেদিন শিবচতুর্দশী তিথি, রুরুদ্রুহের মা এসে বলল, বাছা আমার, ঘরে দানাপানিটিও নেই; তুমি চুরিচামারি করেই হোক বা শিকার করেই হোক, কিছু নিয়ে এসো, নইলে ছানাদের মুখেই বা দেব কী, নিজেরাই বা খাব কী!

মায়ের কথা শুনে রুরুদ্রুহ তার ধনুকটি কাঁধে তুলল, তূণভরা তির পিঠে বাঁধল, ছোট্ট একখানা ভিস্তি ট্যাঁকে গুঁজে বনের দিকে রওনা দিল। তার ইচ্ছে হরিণ-টরিন মেরে কিছু মাংস রেখে, কিছু বেচে চাল-ডাল কিনবে। তাতে পরিবারের সকলের মুখেই সে মাংস-ভাত তুলে দিতে পারবে।

মানুষ যা ভাবে তা তো আর সবসময় হয় না। সারাদিন সমস্ত অরণ্য হন্যে হয়ে খুঁজেও রুরুদ্রুহ হরিণ কেন, একটা পশু কিংবা পাখিও দেখতে পেল না। ঘরে মা-বউ-ছেলেমেয়েরা সব অভুক্ত, শিকার না-নিয়ে সে ফিরবে কেমন করে! কিন্তু, এখন শিকারের উপায় সে কীভাবে করবে?

বেলা শেষ হয়ে এসেছে। এমন সময় ভাবতে ভাবতে তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সে বনের ভেতরের যে পুকুরটিতে পশুরা রাতে জল খেতে আসে, সেখানে গিয়ে হাজির হল। সারাদিন পশুরা লুকিয়ে থাকলেও রাতে জল খেতে তাদের এই পুকুরে আসতেই হবে, আর তখনই রুরুদ্রুহ তাদের হত্যা করবে। পশুরা কখন আসবে তার তো ঠিক নেই, তাই সারারাত খাওয়ার মতো যথেষ্ট জল ভিস্তিতে ভরে ঘাটের কাছেই একটি গাছে উঠে বসল।

রুরুদ্রুহ যে-গাছটিতে উঠে বসল, সেটি একটি বেল গাছ। তার নীচে শুকনো পাতায় ঢাকা ছোট্ট একটি স্বয়ম্ভু শিবলিঙ্গ ছিল। রুরুদ্রুহর দেখার মনও ছিল না, তাছাড়া সন্ধ্যের ঝুঁজকো আলোয় তাঁকে দেখাও যেত না।

সন্ধ্যে ঘনিয়ে রাত্রি যখন এক প্রহর হল, তখন পশুর পায়ের শব্দ সে সচকিত হল। দেখল, খানিক দূর থেকে একটি হরিণী এগিয়ে আসছে পুকুরঘাটের দিকে। কাছাকাছি আসতেই রুরুদ্রুহ তির নিয়ে ধনুকের জ্যা-তে স্থাপন করল। এতে তার যে সামান্য নড়াচড়া হল, তাতে কিছু বেল পাতা ঝরে পড়ল এবং ভিস্তি থেকে খানিকটা জল চলকে পড়ল গাছের নীচের শিবের মাথায়। এতে তার অজান্তেই শিবরাত্রির চার প্রহরের পুজোর প্রথম প্রহরের পুজো সম্পন্ন হয়ে গেল।

হরিণীকে হত্যার জন্য জ্যা-তে টান দিতেই যে মর্মর শব্দ হল, তাতে চমকে তাকিয়ে রুরুদ্রুহকে দেখতে পেল হরিণী। সে অমনি বলে উঠল, ওহে ব্যাধ দয়া করে আমাকে হত্যা করো না! আমার দুধের সন্তানেরা রয়েছে, আমি মরলে তারাও যে মরে যাবে!

উত্তরে রুরুদ্রুহ বলল যে, হত্যা তাকে করতেই হবে। শিকার তার অন্নসংস্থানের অন্যতম উপায়। অথচ সারাদিন সে একটাও শিকার পায়নি। এখন মাংস নিয়ে না-গেলে তার মা-বউ-ছেলেমেয়েরাও তো অনাহারে মরবে। অতএব সে নিরুপায়।

হরিণী বলল, বেশ। আমার মৃত্যুতে যদি অনেকের জীবন বাঁচে, তাহলে সে মৃত্যুও গৌরবের। তবে আমায় মারার আগে একটু অপেক্ষা করো। আমার স্বামী এবং বোন-সতীনকে ছেলেমেয়েদের সম্পূর্ণ দায়ভার দিয়ে বিদায় নিয়ে আসি। তারপর আমায় মেরো।

রুরুদ্রুহ বলল, তুমি যে ফিরে আসবে, তারই বা নিশ্চয়তা কী? না-ও তো আসতে পারো।

হরিণী তখন অত্যন্ত কাতরকণ্ঠে অনুরোধ করে বলল, আমায় বিশ্বাস করো, আমি তিন সত্যি করে বলছি, যদি ফিরে না-আসি পৃথিবীর সমস্ত পাপের কালিমা আমার গায়ে লাগবে এবং আমার কখনও মুক্তি হবে না!

হরিণীর কাতরতায় রুরুদ্রুহর ইচ্ছে হল তাকে বিশ্বাস করতে। সে ধনুক নামিয়ে নিল। বাণ তুলে রাখল। হরিণীকে ঘাটে নেমে জল খেয়ে ফিরে যেতে দিল।

ওদিকে হরিণের ঘরে তখন সবাই চিন্তায় আকুল। এক প্রহর পার হয়ে দুই প্রহর হয়ে গেল হরিণী জল খেতে গিয়ে এখনও ফিরল না; ওর কোন বিপদ হল না তো! বোন-সতীন আর থাকতে না-পেরে এগিয়ে এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে পুকুরের ঘাটে গিয়ে পৌঁছল। তাকে দেখে রুরুদ্রুহ আবার ধনুক তুলে তির যোজনা করল। তখন তার নড়াচড়ায় কিছু বেল পাতা এবং ভিস্তি থেকে কিছু জলও চলকে পড়ল গাছের নীচের শিবের মাথায়। তাতেই দ্বিতীয় প্রহরের পুজো হয়ে গেল।

তির ছোঁড়ার জন্য জ্যা টানতেই মর্মর শব্দে চমকে বোন-সতীন হরিণী রুরুদ্রুহকে দেখতে পেল। এবং সেও রুরুদ্রুহের কাছে ক্ষণিকের প্রাণভিক্ষা চেয়ে ছেলেমেয়েদের দায়ভার স্বামী ও দিদি-সতীনের কাছে দিয়ে বিদায় নিয়ে ফিরে আসার কথা বলল। তারপর তিন সত্যি করে রুরুদ্রুহের বিশ্বাস জুগিয়ে চলে গেল। রুরুদ্রুহ আবার ধনুক নামাল। তির তুলে রাখল।

ওদিকে প্রায় তিন প্রহর হতে চলল, অথচ দুই স্ত্রী তখনও ফিরল না দেখে হরিণ চঞ্চল হল। সে বেরুল তাদের খুঁজতে। খুঁজতে খুঁজতে হাজির হল সেই পুকুরের ঘাটে। এবারেও ধনুক তুলে তির যোজনা করতে গিয়ে রুরুদ্রুহর নড়াচড়ায় কিছু বেল পাতা ও জল পড়ল শিবের মাথায়। ফলে, তৃতীয় প্রহরের পুজোও হয়ে গেল।

সেই সময় জ্যা টানার শব্দে চমকে তাকিয়ে হরিণ গাছের ওপর রুরুদ্রুহকে দেখতে পেল। সেও একইরকমভাবে ক্ষণিকের প্রাণভিক্ষা চেয়ে দুই স্ত্রীর ওপর ছেলেমেয়েদের দায়ভার দিয়ে ও বিদায় নিয়ে ফিরে আসার কথা বলল। তারপর তিন সত্যি করে বিশ্বাস জুগিয়ে চলে গেল। রুরুদ্রুহ ফের ধনুক নামিয়ে রাখল। তির তুলে রাখল তূণে।

ওদিকে হরিণ যখন ঘরে ফিরল, ততক্ষণে তার দুই স্ত্রীও ঘরে ফিরেছে। তিনজনই পরস্পরের অভিজ্ঞতা পরস্পরের কাছে বলে বুঝতে পারল যে, তারা একই ব্যাধের কাছে মৃত্যুবরণ করার জন্য ফিরে যেতে অঙ্গীকার করে বসে আছে। তিনজনেরই মৃত্যু অবধারিত। এখন ছানাদের কার কাছে রেখে যাবে তারা! ভারি অসহায় হয়ে বিদায় বেদনায় ছানাদের জড়িয়ে তিনজনই কাঁদতে লাগল। তারপর চোখ মুছে ছানাদের সাবধানে থাকার উপদেশ দিয়ে পুকুরের দিকে রওনা দিল। ছানারা তাদের একলা যেতে দিল না। তারা পিছু নিল।

পুকুরের ধারে হরিণ-পরিবারটি যখন পৌঁছল, তখন রাত্রি চার প্রহর। তাদের দেখে রুরুদ্রুহ খুশি হয়ে ধনুক তুলল এবং তূণ থেকে তির নিয়ে ছিলায় বসানোর সময় আর এক প্রস্থ নড়াচড়া হল। তাতে আবারও কিছু বেল পাতা এবং ভিস্তির জল পড়ল শিবের মাথায়। ফলে, চার প্রহরের পুজো সম্পূর্ণ হল।

ধনুকে তির যোজনা হতেই ওদিকে হরিণ বলে উঠল, হে ব্যাধ, সংসারে সন্তান প্রতিপালনের জন্য পিতার চেয়ে মাতার প্রয়োজন বেশি, তাই সন্তানদের দুই মাতার প্রাণ ভিক্ষা দিয়ে আমাকে হত্যা করো। 

রুরুদ্রুহকে কথা বলার সুযোগ না-দিয়ে সামনে এগিয়ে এল দিদি-সতীন হরিণী। বলল, হে ব্যাধ, সংসারে সন্তান প্রতিপালনের জন্য পিতা এবং মাতা উভয়েরই প্রয়োজন। তাই আমার স্বামী এবং বোন-সতীনের প্রাণ ভিক্ষা দিয়ে আমাকে হত্যা করো। আমি মরলেও আমার বাছারা তাদের আর এক মাকে তো পাবে!

অমনি বোন-সতীন এগিয়ে এল। বলল, হে ব্যাধ, আমি ছোট। আমার জীবন থাকতে আমার গুরুস্থানীয়দের জীবন-সংশয় হতে দিতে পারি না। তাই তুমি আমার স্বামী এবং দিদি-সতীনের প্রাণ ভিক্ষা দিয়ে আমাকে হত্যা করো।

বোন-সতীনের কথা শেষ হতে-না-হতেই হরিণ ছানারা এগিয়ে এল। তারা সমবেতভাবে বলল, হে ব্যাধ, আমরা বেঁচে থাকতে চোখের সামনে পিতা-মাতাকে মরতে দেখতে পারব না। তুমি আমাদের জীবনের বিনিময়ে হয় তাঁদের ছেড়ে দাও, নয়তো তাঁদের হত্যা করার পূর্বে আমাদের হত্যা করো।

চার প্রহর অজান্তে শিবের পুজো করে নিষ্ঠুর ব্যাধের মনেও তখন সত্য-শিব-সুন্দরের দয়াগুণ ক্রিয়া করতে শুরু করেছে। সমস্ত পাপ দূরীভূত হয়ে পাপের ইচ্ছে নষ্ট হতে শুরু করেছে। 

তাই হরিণ পরিবারের সকলের প্রতি সকলের এই ভালোবাসা, এই ত্যাগের আদর্শ দেখে ব্যাধ রুরুদ্রুহের মনেও ভাবান্তর উপস্থিত হল। এরা নিজের শরীর ও জীবন দিয়ে পরের উপকার করতে চায়। অথচ, সে তো নিজের ও নিজের পরিবারের অন্নসংস্থানের জন্য সারা জীবন অপরের প্রতি অন্যায় করেছে, অত্যাচার করেছে! তাহলে তার কী গতি হবে?

শিবরাত্রিতে চার প্রহরের পুজোয় শিব আগেই তুষ্ট হয়েছিলেন, এবার অনুশোচনায় শুদ্ধ হতে আরও তুষ্ট হলেন। তাই সাক্ষাৎ দেখা দিলেন। অমনি কৃতার্থ হয়ে হরিণেরা তাঁকে প্রণিপাত করল, পায়ে এসে পড়ল রুরুদ্রুহ।

শিব প্রথমে সত্যনিষ্ঠ ও ত্যাগের আদর্শে বিশ্বাসী হরিণ পরিবারটিকে হরিণ জন্ম থেকে উদ্ধার করলেন। তখন তারা রথে চড়ে স্বর্গে গেল। 

তারপর শিব রুরুদ্রুহকে কৃপা করলেন। তাকে 'গুহ' নাম দিয়ে বিরাট অরণ্যরাজ্যের রাজা করে দিলেন। বললেন, দশরথপুত্র রামচন্দ্র তাঁর গৃহে অতিথি হয়ে আসবেন একদা। তখন তাঁর সাহচর্যে মুনিদের চেয়েও মহৎ মোক্ষ লাভ করবে গুহ (রুরুদ্রুহ)।

মাঝখানে কেটে গেল কত কত দিন...

তারপর শিবের বরে সত্যই একদিন রুরুদ্রুহ রামচন্দ্রের সাহচর্য পেয়ে, রাজ্যসুখ ভোগ করে শিব-সদৃশ হয়ে মোক্ষলাভ করল।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...