হিমালয় আর মেনকার বড় আদরের মেয়ে উমা। সেই উমা একদিন বড় হলেন, বিয়ের যুগ্যি হলেন। তখন হিমালয় আর মেনকার ভারি ভাবনা হল, তাঁদের আদরের মেয়েকে কার হাতে তুলে দেবেন! কে তাকে এমন করে সুখে-আহ্লাদে রাখবে! ত্রিসংসারে এমন কে আছে?
তাঁরা যখন এসব সাতপাঁচ ভাবছিলেন, তখন সেখান দিয়ে ঢেঁকি চড়ে যাচ্ছিলেন নারদমুনি। তিনি সব শুনে হেসে বললেন, ‘আছেন গো আছেন, তিনলোকে তেমন একজনই আছেন।’
‘তিনি কে?’ নারদের কথা শুনে হিমালয়-মেনকা যেন হাতে চাঁদ পেলেন।
নারদ হেসে বললেন, ‘তিনি আর কেউ নন, আমাদের কৈলাসপতি শিব।’
‘শিব! ওমা, তা কি করে হয়! সে যে চালচুলোহীন বাউন্ডুলে লোক একটা। তার ওপর বয়সের গাছপাথর নেই। কচি মেয়েটাকে মা হয়ে তার হাতে তুলে দিই কেমন করে!’ ডুকরে উঠলেন মেনকা, তাঁর গলার ক্ষোভ আর ঢাকা পড়ল না, ‘সব জেনেও আপনি এমন একটা কথা কী করে বললেন মুনিবর!’
এদিকে হিমালয়ও শিবের কথা শুনে বিরসমুখে চুপ করে আছেন দেখে নারদ হেসে বললেন, ‘আমি বলার কে মা, বিধাতা বলাচ্ছেন, তাই বলছি। তোমার মেয়েও তাঁকে মনে মনে চায় যে! দেখ না নিজেই একবার খোঁজ নিয়ে!’
মনের কলকাঠিটি নেড়ে দিয়ে ‘নারায়ণ, নারায়ণ’ বলতে বলতে নারদ চলে গেলেন। তখন ডাক পড়ল উমার। উমা এলেন। মাকে বললেন, ‘নারদমুনি ঠিকই বলেছেন মাতা, আমি মহাদেব শিবকেই মনে মনে পতিরূপে বরণ করেছি। তাই বরমালা দিতে হলে, একমাত্র তাঁর গলাতেই দেব, অন্য কারোর গলায় নয়।’
মেয়ের মুখে এমন বালিকাসুলভ কথা শুনে মেনকা খুব উতলা হয়ে পড়লেন। হিমালয় মেয়েকে বড্ড ভালোবাসেন, তাই পাছে মেয়ের মনে আঘাত দিয়ে ফেলেন সেই ভয়ে, উমাকে কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। চুপ করে রইলেন। ওদিকে মেনকা যুক্তি দিয়ে, তর্ক করে, অভাবের কথা বলে, অ-সুখের কথা বলে কিছুতেই মেয়েকে বুঝিয়ে উঠতে পারলেন না যে, শিব কোন কিছুতেই উমার যোগ্য নন। বোঝাবেন কেমন করে, এতদিন ধরে উমা যে তলে তলে নিজেকেই শিবের যোগ্য করে তোলার সাধনা করেছেন। তাঁকে মনে মনে স্বামীরূপে বরণ করে, তাঁকে মনপ্রাণ সমর্পণ করেছেন! উমার মনে পড়ল :
সেই প্রথম যৌবনে একদিন কৈলাসে সখীদের সঙ্গে শিববন্দনা করতে গিয়ে মহেশ্বরের ভুবনভোলানো রূপ দেখে মন হারিয়েছেন উমা, তাঁর জ্ঞান-ঐশ্বর্যের কথা শুনে প্রাণ সমর্পণ করেছেন। এমন অবস্থায়, তাঁকে বোঝাবে কে! এদিকে বিরহও আর সয় না, কিন্তু, যোগী শিবের ধ্যান কেমন করে ভঙ্গ করবেন, কেমন করে তাঁকে আপন করে পাবেন--তাও ভেবে পাচ্ছেন না! শিব যে তাঁর উমার দিকে আজ অব্দি একবার ফিরেও দেখলেন না!
উচাটনের এই সময়ে পরামর্শ দেবার লোকের অভাব হল না। সব কাজের কাজি, নারদ এসে জুটলেন। উমাকে বললেন কৃচ্ছসাধনার মধ্য দিয়ে কঠোর তপস্যা করার কথা। উমা শুরু করলেন তপস্যা। নিত্য আহার ছেড়ে শুধু পর্ণপত্র খেয়ে কঠোর সাধনা করে তিনি হলেন, অপর্ণা। তাঁর তপের তেজে জ্বলে উঠল অগ্নি। সেই আগুনের শিখা স্বর্গ ছুঁল। তার তাপ সহ্য করতে না পেরে ইন্দ্রপ্রস্থ ছেড়ে দেবতারা 'ত্রাহি ত্রাহি' করে শরণ নিলেন মহাদেবের। ততক্ষণে উমার তপে শিবের আসন শুরু করেছে টলতে, নয়ন খুলেছেন তিনি। কপালে ভাঁজ পড়েছে, ভাবছেন, এমন কঠিন সাধনা করছে কে? কে সেই তপস্বী?
নারদ বললেন, ‘তপস্বী নয় গো, তপস্বিনী। স্বয়ং শক্তি তোমাকে পাবার জন্য আকুল হয়েছেন। এবার বিবাগী ভাবখানা ছেড়ে যাও না বাপু তাঁকে বরণ করে নাও।’
নারদের আর তর সয় না। একরকম জোর করেই পাঠালেন শিবকে। শিব গেলেন উমার কাছে। বুড়ো বামুনের বেশে। তপস্যা ক্লিষ্ট উমা বুড়ো বামুনকে আতিথ্য দিলেন। পাদ্য দিলেন। অর্ঘ্য দিলেন। সেসব গ্রহণ করে বুড়ো শিব বললেন, ‘তোমার সেবায় তুষ্ট হয়েছি। তাই বলছি, ভিখারি-বাউন্ডুলে-ভাঙখোর শিবকে বিয়ে করার জন্য এতটা উতলা হওয়া তোমার উচিত হয়নি বাছা। আর তোমারই বা দোষ কি...’ বলতে-না-বলতেই তাঁকে থামিয়ে দিলেন উমা।
শিবের নিন্দা তাঁর কানে বিষের মতো ঠেকল। মনে ক্রোধ এলো। তাই একটু উষ্মা নিয়েই বললেন, ‘শিবকে আমি মনে মনে পতিরূপে বরণ করেছি। পতিনিন্দা শোনাও পাপ। হে অতিথি, আপনি হয় চুপ করুন, নয় বিদায় নিন, আমায় তাঁর জন্য তপস্যা করতে দিন।’ বলেই তপের আসনে বসে পড়লেন উমা। তাঁর আঁখিপল্লব নিমীলিত হল। শুধু শিব মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইলেন তাঁর দিকে। উমার কমনীয় মুখে তপস্বিনীর তেজ দেখলেন, অনন্ত ভালোবাসা দেখলেন। আকাশছোঁয়া রূপ দেখলেন। শিব অভিভূত হলেন। তখন নিজের স্বরূপে এলেন। বললেন, ‘উমা, এই দেখ, আমি এসেছি।’ শিবের ডাক শুনে উমা চোখ খুললেন। এই তো সেই অনিন্দ্যকান্তি শিবসুন্দর তাঁর সামনে! এতদিনে! এবার বুঝি জন্মের চাওয়া সত্যি হল! কানে শুনলেন, শিব যেন বললেন, ‘তুমি আমাকেই স্বামীরূপে চাও তো?’
মন্ত্রমুগ্ধের মতো উমা আসন ছেড়ে উঠে এলেন, তিনি যেন বলতে চাইলেন : 'চাই তো, আজন্ম তো তাই চেয়েছি, জন্মান্তরেও তাই চাইব।' মুখে কিছুই বললেন না। শুধু চেয়ে রইলেন অপলক। মহাদেব শুধু তাঁর প্রশস্ত বুকে উমাকে আশ্রয় দিয়ে বললেন, ‘তথাস্তু, তাই হোক...’
বিশ্বচরাচরে যেন সেই মুহূর্তে আনন্দের বান ডাকল। পাখি গান গাইল, শাখে শাখে ফুল ফুটল, হাওয়ায় হিল্লোলিত হল, শঙ্খনাদে আর মঙ্গলগানে দশদিক মুখরিত হল...
গল্পের উৎস : বেদব্যাস রচিত, 'শিব পুরাণ' ও 'লিঙ্গ পুরাণ'।