বসন্তকালে শিব-দুর্গার বিয়ের আসর বসে নবদ্বীপে

বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান,

শিব ঠাকুরের বিয়ে হল তিন কন্যা দান।

এক কন্যা রাঁধেন বাড়েন এক কন্যা খান,

এক কন্যা রাগ করে বাপের বাড়ি যান।

 

গতকাল মহাসমারোহে পালিত হয়েছে শিবরাত্রি। তবে আজও চতুর্দশী রয়েছে। শৈব সংস্কৃতি মেনে বাংলায় যে উৎসবগুলো প্রচলিত, তার মধ্যে অন্যতম হল শিবরাত্রি। বলা হয় আজকের দিনে শিব পার্বতীর বিয়ে হয়েছিল। যদিও বাংলায় শিবের বিয়ে উপলক্ষ্যে আরেকটি উৎসব পালিত হয়। নদীয়ার নবদ্বীপ মহাসমারোহে হয় শিবের বিয়ের উৎসব। চৈত্র মাসে বাসন্তী পুজোর শেষ দিন অর্থাৎ দশমীর পরদিন ভোররাতে শিবের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। শিব ও পার্বতীকে সাজিয়ে চতুর্দলায় করে শোভাযাত্রার মাধ্যমে পোড়ামাতলায় নিয়ে আসা হয়। শিব এখানে সমাজের তথাকথিত নিম্ন শ্রেণীর প্রতিনিধি, অন্যদিকে পার্বতী উচ্চ বংশীয়। নবদ্বীপের এই উৎসবের বয়স ৫০০ থেকে ৬০০ বছরেরও বেশি। 

চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও বিজয়া দশমী তিথিতে বাসন্তী পুজো অনুষ্ঠিত হয়। নবদ্বীপে বাসন্তী পুজোর সঙ্গেই শিবের বিয়ে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছে। বাসন্তী পুজোর শেষ দিনে অনুষ্ঠিত হয় শিবের বিয়ের অনুষ্ঠান। বাসন্তী পুজো শেষ হলে, বাসন্তী রূপে পূজিতা মহিষাসুরমর্দিনী প্রতিমার সঙ্গে নবদ্বীপের মন্দিরে অধিষ্ঠিত শিবের বিবাহ সম্পন্ন হয়। মাটি দিয়ে শিবের মুখোশ গড়ে সেটিকে চতুর্দলায় সাজিয়ে নিয়ে বর সাজানো হয়। এই মুখোশ লোকসংস্কৃতির অনন্য উপাদান। বাসন্তী দুর্গাকে দোলায় করে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরিয়ে পোড়ামাতলায় নিয়ে আসা হয়। সেখানে হিন্দু বিবাহ রীতি মেনে শিব ও মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার বিয়ে দেওয়া হয়। সাতপাকে ঘোরা থেকে শুরু করে মালাবদল সবই হয় রীতি মেনে। নবদ্বীপের সাত শিবের এই বিয়ের প্রচলন আছে। তারা হলেন বুড়োশিব, যোগনাথ, বালকনাথ, দন্ডপাণি শিব, পলকেশ্বর, আলোকনাথ, বানেশ্বর। 

বিয়েতে নানান ধরণের উপহার দেওয়ার রেওয়াজও রয়েছে। ব্যবসায়ীরা তাদের দোকানের শ্রেষ্ঠ সামগ্ৰী এই বিয়েতে যৌতুক রূপে দেন। পোশাক থেকে আসবাব, সাইকেল থেকে কাঁসা-পিতলের বাসনপত্র, উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। বিয়ের পর দর্শনার্থীদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। লুচি-আলুদম, মিষ্টি, খিচুড়ি ইত্যাদি খাওয়ানো হয়। আজও এই প্রাচীন রীতি একই ভাবে পালিত হচ্ছে। একদা বড় বড় ঝুড়িতে লুচি আর মিষ্টি রাখা থাকত। পোড়ামাতলায় শিবের দোলা পৌঁছনোর পর শোভাযাত্রার সামিলদের তা খেতে দেওয়া হয়। আদপে তারা হলেন বিয়ের বর যাত্রী। সেকালের এক এক জন ধনী মানুষ এক একটি শিবের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাদের সামর্থ্য অনুযায়ীই পোলাও, খিচুড়ির ভোজ হত। 

লৌকিক বাংলার নানান লোক দেবতার সঙ্গেও মিশেছেন শিব। যেমন ধর্ম ঠাকুর, কালু রায়, দক্ষিণ রায়, চাঁদ রায় এরা প্রত্যেকেই শিবের পরিবর্তীত রূপভেদ। ক্ষেত্র রক্ষক দেবতা, ক্ষেত্রপাল হলেন এক ভৈরব। তাঁকে শিবের অনুচর বা শিবের পৃথক এক রূপভেদ বলেই মনে করা হয়। শিবের সঙ্গে ক্ষেত্রপাল মিশে গিয়েছেন, এমন প্রতীকেরও দেখা মেলে কয়েক জায়গায়। যেমন উত্তর ২৪ পরগনার খড়দহে এক অতি প্রাচীন ক্ষেত্রপাল মন্দির রয়েছে। ওই মন্দিরে যে শিবলিঙ্গ রয়েছে, তার উপরের অংশটি স্বভাবিক শিব লিঙ্গের তুলনায় কিছুটা দীর্ঘ। উপরের অংশ কিছুটা উন্মুক্ত। প্রচলিত বিশ্বাস মতে মনে করা হয়, শিব লিঙ্গের ঐ অংশটি ক্ষেত্রপালের প্রতীক এবং রুপোর পাত দিয়ে পরে ঐ অংশটির সঙ্গে শিবলিঙ্গকে সংযুক্ত করা হয়েছে। এইভাবে একই প্রতীকে দুই দেবতা মিশে গিয়েছেন এমনটা খুব একটা দেখা যায় না। অনেকেই মনে করেন ক্ষেত্রপাল আসলে শিব বা শিবেরই আকৃতি ভেদ। খড়দহের ঐ মন্দির ক্ষেত্রপাল মন্দির নামেই পরিচিত। মন্দিরের সামনে শ্রী শ্রী ক্ষেত্রপাল বাড়ি লেখা দেখা যায়। মন্দিরে শিবরাত্রি উপলক্ষ্যে বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। সে সময় এবং দুর্গা পুজো চলাকালীন তিনদিন শিব লিঙ্গ থেকে ক্ষেত্রপালের অংশটি খুলে অন্যত্র রাখা হয়। এটাই প্রমান করে যে, ক্ষেত্রপালকে শিব বা শিবের ভিন্ন রূপ ভেদ বা নিদেন পক্ষে শাস্ত্রীয় দেবতা বলেও মনে করেন না পুরোহিতেরা। এই ক্ষেত্রপালের প্রতীক অংশটি সরিয়ে রাখার ঘটনা তা নিশ্চিত করে।

প্রাচীন যুগে ক্ষেত্রপালের প্রস্তর মূর্তি দেখা যেত। তাতে ক্ষেত্রপালের হাতে গদা দেখা যায়। হাতে গদা এবং ক্ষেত্রপালের শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা থেকে অনুমান করা যায়, প্রাচীন যুগে ক্ষেত্রপালকে দিক রক্ষক দেবতা বলে গণ্য করা হত। কারণ গদা হল রক্ষকদের চিহ্ন। হয়ত এই গদাই পরবর্তী কালে পল্লি বাংলায় বংশদন্ডে রূপান্তরিত হয়েছে। আর্য এবং অনার্য ধর্মরীতির মিলনের ফলে তাদের সংস্কৃতির আদান-প্রদান হয়েছে। ক্ষেত্রপালের গদা কালক্রমে বংশদন্ডে রুপান্তরিত হয়েছে। ক্ষেত্রপাল লৌকিক দেবতায় পরিণত হয়েছে।

আবার জেলেদের দেবতা, মাকাল শব্দটি মহাকালের অপভ্রংশ। অনেকে ঐতিহাসিকের মতে, মহাকাল শব্দটির ধ্বনি লোপ পেয়ে মাকাল শব্দের উৎপত্তি হয়েছে।রেকাবি বা শালপাতা অথবা কাগজের ঠোঙায় সামান্য বাতাসা। কোথাও কোথাও তার সঙ্গে কিছু ফলমূল এবং চিনির সন্দেশ। এমনকি পুজো করতে লাগে না কোনো ব্রাহ্মণ পুরোহিতও। মাছচাষিরা নিজেরাই খড় জ্বালিয়ে পুজো করে মাকাল ঠাকুরকে। বড় রেকাবিতে বাতাসা, ফুল, জল, বেলপাতা। তাতেই ঠাকুর খুশি। উপকরণেও শিবের পুজোর সঙ্গে মাকাল ঠাকুরের পুজোর সদৃশ্য রয়েছে।প্রচলিত পালাগানে শিবের চাষ পালায় মৎস্য শিকারী রূপে মহাদেব ও গৌরী দেবীকে দেখা যায়। একদিকে তারা ধানক্ষেতের জমা জলে মাছ ধরছেন, তেমনিই অপরদিকে সেই মাছ মাথায় করে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করছেন। অনুমান করা যায় এই কারণে মৎসজীবি সম্প্রদায় হরগৌরীকে জেলেদের দেব-দেবী রূপে কল্পনা করে পুজো করে। প্রচলিত লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, পুকুরের মধ্যে মাকাল ঠাকুরের যে'দুটি রূপ বর্ণনা করা হয় সেগুলো হল মহাকাল শিব ও অপরটি স্ত্রী গৌরী। লোকসংস্কৃতি অনুযায়ী, মাকাল ঠাকুর ও লৌকিক হরগৌরীর পুজো এক এবং অভিন্ন। সম্প্রদায়ভেদে শিব ঠাকুরের আরাধনার যে বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়, তারই মধ্যে মাকাল ঠাকুরের পুজো অন্যতম একটি।মাকাল ঠাকুরের কোনও মানুষের আকৃতিবিশিষ্ট মূর্তি নেই। মাটির একটি অথবা একসঙ্গে দুটি ছোট স্তূপের প্রতীকে পুজো করা হয়। যেখানে জোড়া প্রতীকে পুজো করা হয় সেখানে দু'টি প্রতীকের মধ্যে স্ত্রী দেবতা-পুরুষ দেবতা ভেদভেদা করা হয় না। উপাসকেরা দুটি প্রতীককেই দেবতার মূর্তি মনে করে।

এই প্রতীকটি অনেকটা উল্টানো গ্লাস বা টোপরের মতো দেখতে। জেলে সম্প্রদায় মূর্তি বিহীন মাটির বেদীকে মাকাল ঠাকুরের থান হিসেবে কল্পনা করেন। কোন কোন ক্ষেত্রে মাঠের উপর কাদা মাটির একটি বা দুটি আবক্ষ মূর্তি তৈরি করা হয়। মূর্তি অতি সাধারণ, নির্মাণ পদ্ধতি অতি সহজ। পুকুরের খোল থেকে আঠালো পাঁকমাটি অল্প নিয়ে দুই হাতের তালুতে রগড়ে চার ছয় ইঞ্চি লম্বা ও দু তিন ইঞ্চি ব্যাস যুক্ত করা হয়। তারপর তর্জনী বুড়ো আঙ্গুলের চাপ দিয়ে নাক, চোখ, মুখ তৈরি করে পূজার বেদীতে বসানো হয়। এই মূর্তিকে শিব লিঙ্গের মত দেখতে হয়। এইরূপ মূর্তি তৈরি হত কুষাণ যুগে। এটিই মাকাল ঠাকুর। মৎস্যজীবী সম্প্রদায় মূর্তিহীন মাটির থানকে মাকাল ঠাকুর বলে পুজো করে।

আবার অনেক জায়গায় সরল গঠনের কিছু আবক্ষ মূর্তিও থাকে। মাকাল ঠাকুরের স্থায়ী আবক্ষ মূর্তি বা কেবল মুন্ড পুজিত হতে দেখা যায়। মাকাল ঠাকুরের মূর্তি কাঁধ পর্যন্ত চুল, বিশাল ঝুলন্ত বিস্ফারিত চোখ, কান কুন্ডল ও গলায় গলাপটি। এরূপ মূর্তি উত্তর চব্বিশ পরগনার ভেরি অঞ্চলে দেখা যায়। লৌকিক ইতিহাসের সঙ্গে মিশে রয়েছেন মাকাল ঠাকুর। মাকাল ঠাকুরের যুগ্ম মূর্তিটির বিশেষ তাৎপর্য আছে। কাদামাটি দিয়ে তৈরি মাকাল ঠাকুরের যুগ্ম কাল্পনিক মূর্তি দেবদেবী সম্পর্কিত নিরাকার অবশেষ রূপে ধরা হয়। যা খ্রিস্টপূর্ব যুগের বলে অনুমান করা যায়।

কাদার যুগ্ম প্রতীককে যেমন নারী ও পুরুষ রূপে ভাবা যায়, তেমনি এদের একে অন্যের অনুচর রূপেও কল্পনা করা যায়। শিব, হরগৌরি, ভোলেবাবার দেব রূপের আদিমতম ধারার সঙ্গে মাকাল ঠাকুর মিলে মিশে এক হয়ে গিয়েছে। প্রকৃতিকে পুজো করার মানুষের আদিম রীতিটিও ধরা রয়েছে মাকাল ঠাকুরের উপাসনার মধ্যে, সভ্যতার ইতিহাস এবং লৌকিক ইতিহাস কোথাও গিয়ে যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। অনন্য উপাখ্যান হয়ে দাঁড়িয়েছে মাকাল ঠাকুরের আরাধনা।

পল্লীবাংলার আরেক এক লৌকিক দেবতা হলেন পাঁচুঠাকুর। পঞ্চানন বা পঞ্চানন্দ বা পাঁচু ঠাকুর এক খ্যাতিমান লৌকিক দেবতা, শুধু খ্যাতনামা বললেও কম বলা হয় তিনি হলেন গ্রাম বাংলার জনপ্রিয়তম লৌকিক দেবতা। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কোনও কোনও জায়গায় পাঁচু ঠাকুর 'বাবাঠাকুর' নামেও পরিচিত। মূলত রাঢ়-বাংলার উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলী, কলকাতা, বর্ধমান, নদিয়া ও বাঁকুড়াতে এঁর পুজো হয়ে থাকে। প্রান্তিক কলকাতাতেও​ কোথাও কোথাও পঞ্চানন ঠাকুর পুজো পান। অনেকেই মনে করেন, ভাগিরথী প্রবাহের নিম্নধারার মাধ্যমে জনসংস্কৃতির বিভেদ্যতায় রাঢ়-বাংলার মুখ্য লোকদেবতা ধর্মঠাকুর ক্রমেই পঞ্চানন রূপের মধ্যে দিয়ে পরিপূর্ণ শিবমূর্তিতে রূপান্তরিত হয়েছেন।

পঞ্চানন ঠাকুরের গায়ের বর্ণ লাল, তাঁর চোখমুখের ভঙ্গি রুদ্ররূপী। বড় গোলাকার রক্তাভ তিনটি চোখ ক্রোধোদ্দীপ্ত। মূর্তিতে ঠাকুরের প্রশস্ত ও কালো টিকালো নাক বর্তমান, দাড়ি নেই, গোঁফ রয়েছে যা কান অবধি বিস্তৃত। মাথায় পিঙ্গলবর্ণের জটা চূড়া করে বাঁধা এবং জটা বুকে পিঠে ছড়ানো। কানে ধুতরা ফুল গুঁজে রাখা। মূর্তির উর্ধাঙ্গ অনাবৃত, নিম্নাঙ্গে থাকে বাঘছাল, আবার কোনও কোনও জায়গায় নিম্নাঙ্গে কাপড় পরানো থাকে।গলায় ও হাতে বেশ বড় পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষমালা থাকে। হাতে ত্রিশূল ও ডমরু, পায়ে খড়ম এবং মাথায় বা দেহের উপর সাপ বিদ্যমান। পাশে থাকে পঞ্চরংয়ের বা পাঁচমুখো গাঁজার কলকে। পঞ্চানন ঠাকুরের আবার পার্শ্বজ পরিষদ রয়েছে, তাঁর অনুচর হলেন লৌকিক দেবতা জরাসুর ও ধনুষ্টংকার নামের দু-জন অপদেবতা। এঁর সঙ্গেই থাকে মামদো ভূত, ঘোড়া, বাঘ প্রভৃতি।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...