শৈব সংস্কৃতি মেনে বাংলায় যে উৎসবগুলো প্রচলিত, তার মধ্যে অন্যতম হল শিবরাত্রি। বলা হয় মহাশিবরাত্রিতে শিব পার্বতীর বিয়ে হয়েছিল। যদিও বাংলায় শিবের বিয়ে উপলক্ষ্যে আরেকটি উৎসব পালিত হয়।
নদীয়ার নবদ্বীপ মহাসমারোহে হয় শিবের বিয়ের উৎসব। চৈত্র মাসে বাসন্তী পুজোর শেষ দিন অর্থাৎ দশমীর পরদিন ভোররাতে শিবের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। শিব ও পার্বতীকে সাজিয়ে চতুর্দলায় করে শোভাযাত্রার মাধ্যমে পোড়ামাতলায় নিয়ে আসা হয়। শিব এখানে সমাজের তথাকথিত নিম্ন শ্রেণীর প্রতিনিধি, অন্যদিকে পার্বতী উচ্চ বংশীয়। নবদ্বীপের এই উৎসবের বয়স ৫০০ থেকে ৬০০ বছরেরও বেশি।
চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও বিজয়া দশমী তিথিতে বাসন্তী পুজো অনুষ্ঠিত হয়। নবদ্বীপে বাসন্তী পুজোর সঙ্গেই শিবের বিয়ে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছে। বাসন্তী পুজোর শেষ দিনে অনুষ্ঠিত হয় শিবের বিয়ের অনুষ্ঠান। বাসন্তী পুজো শেষ হলে, বাসন্তী রূপে পূজিতা মহিষাসুরমর্দিনী প্রতিমার সঙ্গে নবদ্বীপের মন্দিরে অধিষ্ঠিত শিবের বিবাহ সম্পন্ন হয়। মাটি দিয়ে শিবের মুখোশ গড়ে সেটিকে চতুর্দলায় সাজিয়ে নিয়ে বর সাজানো হয়। এই মুখোশ লোকসংস্কৃতির অনন্য উপাদান। বাসন্তী দুর্গাকে দোলায় করে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরিয়ে পোড়ামাতলায় নিয়ে আসা হয়। সেখানে হিন্দু বিবাহ রীতি মেনে শিব ও মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার বিয়ে দেওয়া হয়। সাতপাকে ঘোরা থেকে শুরু করে মালাবদল সবই হয় রীতি মেনে। নবদ্বীপের সাত শিবের এই বিয়ের প্রচলন আছে। তারা হলেন বুড়োশিব, যোগনাথ, বালকনাথ, দন্ডপাণি শিব, পলকেশ্বর, আলোকনাথ, বানেশ্বর।
বিয়েতে নানান ধরণের উপহার দেওয়ার রেওয়াজও রয়েছে। ব্যবসায়ীরা তাদের দোকানের শ্রেষ্ঠ সামগ্ৰী এই বিয়েতে যৌতুক রূপে দেন। পোশাক থেকে আসবাব, সাইকেল থেকে কাঁসা-পিতলের বাসনপত্র, উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। বিয়ের পর দর্শনার্থীদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। লুচি-আলুদম, মিষ্টি, খিচুড়ি ইত্যাদি খাওয়ানো হয়। আজও এই প্রাচীন রীতি একই ভাবে পালিত হচ্ছে। একদা বড় বড় ঝুড়িতে লুচি আর মিষ্টি রাখা থাকত। পোড়ামাতলায় শিবের দোলা পৌঁছনোর পর শোভাযাত্রার সামিলদের তা খেতে দেওয়া হয়। আদপে তারা হলেন বিয়ের বর যাত্রী। সেকালের এক এক জন ধনী মানুষ এক একটি শিবের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাদের সামর্থ্য অনুযায়ীই পোলাও, খিচুড়ির ভোজ হত।