"আসলে খুবই সাধারণ একটা জীবন কাটিয়েছি আমি। আমার জীবনে খুব একটা নাটক নেই, ওঠাপড়া নেই। আমার একটা মায়া আছে। মায়া বলো, ভালবাসা বলো। এটা কখনও কখনও আমাকে পীড়াও দেয়। ভালবাসা না থাকলে জীবনটাকে উপভোগ করা যায় না। ভালবাসাটুকুকে সম্বল করেই বাঁচি।"
এমন মায়াময় লেখা বা কথা আর কার হতে পারে, তাঁর ছাড়া? তিনি - অর্থাৎ বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২রা নভেম্বর, ময়মনসিংহে, যা বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্গত। তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও অসমের বিভিন্ন অংশে। তাঁর বাবা রেলওয়েতে চাকরি করতেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় কলকাতার ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। শীর্ষেন্দুবাবু প্রথম চাকরি নেন স্কুল শিক্ষক হিসাবে। দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত ছিলেন একটি পত্রিকার সাথে ।
তাঁর প্রথমে গল্প "জল তরঙ্গ" ১৯৫৯ খ্রীষ্টাব্দে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সাত বছর পর প্রথম উপন্যাস "ঘুণপোকা" প্রকাশিত হয়। তারপর একে একে "কাগজের বৌ", "ফেরীঘাট", "যাও পাখি", "উজান", "মানব জমিন", "দূরবীন", "পার্থিব" এবং আরো আরো অসামান্য গল্প এবং উপন্যাস।
পাশাপাশি কিশোর সাহিত্য সৃষ্টিতেও তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি অথবা "গোঁসাই বাগানের ভূত"-এর মতো কিশোর উপন্যাস শুধু বাংলা কেন অন্য ভাষার সাহিত্যতেও বিরল। তেরো চোদ্দ বছরের ছেলেরা অঙ্কপরীক্ষা খারাপ দিলে নিধিরামের মতো মজারু ভূতেরা এসে আজও তাদের কানের কাছে গুনগুন করে বলতে থাকে "বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো"। অদ্ভুতুড়ে সিরিজ লিখে ফেললেন কী অনায়াসে! প্রতিটা উপন্যাস যেন রসে টইটম্বুর। তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এত ভূতের আইডিয়া পান কোথা থেকে? লেখকের সপ্রতিভ উত্তর ছিল, '‘কে জানে! ভূতেরাই দিয়ে যায় বোধ হয়।’'
দু'বার আনন্দ পুরস্কার, সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য সাহিত্য পুরস্কার পাওয়া সাহিত্যিক নিজের সম্পর্কে বলেন, "অনেকেই আমাকে বলেন, ‘কেন আপনি লিখছেন না?’ আসলে আমি খুব গেঁতো-অলস লোক। প্রকাশক তো আমায় মাঝে মাঝে ধরে জিজ্ঞেস করেন, "আপনার মাথায় পিস্তল না ধরলে কি আপনি লিখতে পারেন না?" আমি বলি, "যা বলেছেন এক্কেবারে ঠিক বলেছেন। আমি খানিকটা পয়েন্ট অব নো রিটার্ন-এ যখন যাই, তখন তেড়েফুঁড়ে লিখতে বসি, তা না হলে আমার লেখা আসে না।" শুরুতে যখন আত্মপ্রকাশের একটা তাগাদা ছিল, উৎসাহও ছিল তখন। এখন মনে হয় আবার লিখতে হবে, আবার ছাপা হবে! আবার টেনশন, আরও ঘরের মধ্যে থাকা, লেখা মানে তো কেরানিগিরি। আমার স্ত্রী বলেন, "আমি তো কেরানিকে বিয়ে করতে চাইনি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেরানিই জুটে গেছে।" "কেরানি তবু শুধু অফিসে কাজ করে, আমি তো বাড়িতেও কাজ করি।"
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের তুলনা শুধু তিনি নিজেই। আরো অনেক অনেক অসাধারণ সাহিত্য কীর্তি সৃষ্টি করুন তিনি।
জন্মদিনে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই এই অপ্রতিম সাহিত্যিককে।