যে মানুষ মনে প্রাণে স্বাধীনচেতা নন তিনি আর যাই হন প্রকৃত শিল্পী হওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। একজন শিল্পীর জীবনের আর একটি সবচেয়ে বড় দীক্ষা হলো তার নির্মোহ থাকা। শিল্পীর এই সমস্ত গুনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন সাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তী। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঘর ছেড়েছিলেন শিবরাম, চলে এসেছিলেন কলকাতায়। থাকবার খাওয়ার কোনো জায়গা নেই, রাত কাটাচ্ছেন ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির সামনের ফুটপাথে। গুরু দেশবন্ধু কিন্তু ঠিক খবর রেখেছেন, চিঠি লিখলেন আর এক শিষ্য সুভাষকে। ‘শিবরামকে তোমার আত্মশক্তি কাগজে নিয়ে নাও, ভালো লেখে ও।’ চিত্তরঞ্জনের আদেশ সুভাষের কাছে শিরোধার্য, চাকরি হলো শিবরামের। কিন্তু নিয়মকানুন শৃঙ্খলার ধার শিবরাম কোনোদিনই ধারতেননা। শিবরাম ইচ্ছে হলে কোনও দিন অফিস যান তো কোনও দিন পা ঠেকাননা। সুভাষের কাছে সে খবর এসে পৌঁছতে সুভাষ যারপরনাই বিরক্ত হন। এই আচরণ তাঁর মতো সুশৃঙ্খল মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন হয়। শিবরামকে তিনি ওয়ার্নিং দিলেন ঠিক সময়ে রোজ দপ্তরে আসতে হবেই। শিবরাম কোনও দিন কারও কথা শুনে চলেছেন এমন কথা কেউ ইতিহাসে শুনেছে? তাই যা হওয়ার তাই হল, এরপর একদিন হাতে একটি খাম পেলেন শিবরাম আর তার মধ্যে একটা একশো টাকার নোট আর সুভাষচন্দ্র বোসের একটা চিঠি। চিঠিতে লেখা— "আপনাকে আর দরকার নেই"। বরখাস্ত হওয়ার চিঠি নিয়ে শিবরাম নিশ্চিন্ত মনে বেরিয়ে গেলেন আত্মশক্তির অফিস থেকে, এমনই তার স্বাধীনতা বোধ যে সুভাষের কাছেও মাথা নোয়ালেননা, একবার অনুরোধও করলেননা বরখাস্ত না করার জন্য। এই কাগজের চাকরি যেমন গেছে ঠিক তেমনই একবার একটি খবরের কাগজ অফিসের মালিক হয়েছিলেন শিবরাম। কিন্তু তার জন্যই আবার জেলে যেতে হল শিবরামকে। যুগান্তর বন্ধ হয়ে যাবে ঠিক এমন অবস্থায় মাত্র ৫০০ টাকা দিয়ে শিবরাম কিনে ফেলেন যুগান্তর। নিজেই হলেন সম্পাদক। যুগান্তর কাগজে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে লেখা ছাপিয়ে শিবরাম পড়লেন পুলিশের নজরে। একদিন অফিসের কাজ সেরে মুক্তারামবাবু স্ট্রীটের মেসে ফিরছেন, রাস্তাতে খবর পান পুলিশ এসে তাঁকে খুঁজছে। শিবরাম সোজা ঢুকে পড়লেন সামনের মিষ্টির দোকানে, জেল যদি হয় তাহলে কত দিন মিষ্টি খাওয়া হবে না! আর আজতো নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকতে হবে সুতরাং বড় সাইজের মোট কুড়িটা রসগোল্লা গলাধঃকরণ করার পর পকেটে হাত দিয়েই বুঝতে পারলেনএকটা টাকাও নেই। মিষ্টির দোকানের মালিক সঙ্গে একজন লোক দিয়ে দিলেন শিবরামের সঙ্গে ওর মেসে গিয়ে টাকা নিয়ে আসবে। বাড়িতে ঢুকবেন ঠিক সেই মুখেই গ্রেপ্তার হন শিবরাম। পুলিশকে বোঝালেন যে একজনকে টাকা মিটিয়ে দিতে হবে তাই একবার ঘরে ঢোকা দরকার কিন্তু মিষ্টির দোকানের সেই কর্মচারী বিপদ বুঝে আগেই পালিয়েছেন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় জেলর বলেন, ‘‘আপনার নিজের যা জিনিস আছে তা নিয়ে যেতে পারেন" কিন্তু নিজের বলতে তো কিছুই নেই শিবরামের তাই জেল থেকে বেরিয়ে কিছু পয়সা জোগাড় করে আগে গেলেন সেই মিষ্টির দোকানে, ধারের টাকা মেটাতে, দোকানের ভেতর ঢুকতেই মালিক হাতজোড় করে উঠে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন বোমা না মেরে যা চান দিয়ে দিচ্ছি। বলে কাঁপা কাঁপা হাতে ক্যাশবক্সে হাত দিতে যান দোকানদার, শিবরাম বলে ওঠেন তিনি এসেছেন ধার মেটাতে। শিবরামের কাছে সব শুনে স্বস্তি পেলেন দোকানদার, তারপর কুড়িটা প্রমাণ সাইজের রাজভোগ শিবরামকে খাইয়ে তবে বিশ্বাস করলেন এবং আরও কুড়িটা হাঁড়িতে ভরে দিয়ে বললেন, ‘‘বাড়িতে খাবেন আর দোকানে যখন খুশি এসে খেয়ে যাবেন কোনো পয়সা লাগবে না"। যদিও পরের দিন থেকে আর ওই দোকানের ধারে কাছে যাননি শিবরাম কারন তিনি ধারের ধার কোনোদিনই ধারতেন না।