"জটাটবী গলজ্জলপ্রবাহ পাবিতস্থলে
গলেহবলম্ব্যলম্বিতাং ভুজঙ্গতুঙ্গ মালিকাম্।।"
শ্রীশিবতান্ডব স্ত্রোত্রের বর্ণনায় আছে - দেবাদিদেব শিবের গলায় মালার মতো জড়িয়ে আছে সর্প, মস্তকের জটা থেকে উৎপন্ন গঙ্গাদেবীর প্রবাহ সেই গলদেশকে প্লাবিত করেছে। মর্ত্যে মাজদিয়ার শিবনিবাস যেন মহাদেবের এই রূপের বাস্তবায়ন। গঙ্গাদেবী এখানে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত নন, তার সহচরী চূর্ণীকে পাঠিয়েছেন পিতার মন্দির পাহারায়।
পূর্বভারতের অন্যতম বৃহত্তম শিবলিঙ্গ রয়েছে শিবনিবাসের রাজরাজেশ্বরী মন্দিরে। কষ্টী পাথরের তৈরী শিবলিঙ্গটির উচ্চতা নয় ফুট এবং বেড়ে প্রায় একুশ ফুট। মন্দির কর্তৃপক্ষ দাবি করে যে, এটি এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শিবলিঙ্গ। ১৭৫৪ খ্রীষ্টাব্দে (১৬৭৬ শকাব্দ) কৃষ্ণনগরের মহারাজ রাজেন্দ্র কৃষ্ণচন্দ্র রায় মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমা মহিষীর নামে এই মন্দিরটি উৎসর্গ করেন। মন্দির প্রতিষ্ঠার কারণ সম্পর্কে বহু জনশ্রুতি শোনা যায়, সে গল্পে পরে আসছি।
এই মন্দিরের পাশেই রাজ্ঞীশ্বর মন্দির, মন্দিরাভ্যন্তরের শিবলিঙ্গটি তুলনায় ছোটো, সাত ফুট। জানা যায়, রাজ্ঞীশ্বর মন্দিরটি রাজরাজেশ্বরের কিছু পরে ১৭৬২ খ্রীষ্টাব্দে নির্মাণ করা হয়েছে। রাজ্ঞীশ্বর শিবমন্দিরের প্রতিষ্ঠাফলক অনুযায়ী মহারাজ এই মন্দিরটি দ্বিতীয়া মহিষীকে উৎসর্গ করেন। রাজরাজেশ্বর মন্দিরটি বয়োজেষ্ঠ হবার কারণে স্হানীয় এলাকায় বুড়োশিবের মন্দির নামে পরিচিতি লাভ করেছে। মন্দিরগাত্রের কোটরে টিয়া পাখি বাসা বেঁধেছে, ইষ্টকনির্মিত কাঠামোতে এ যেন প্রাণসঞ্চার যা চরম নাস্তিকের মনেও সাড়া ফেলবে।
এক শিষ্য জানায় সে মন্দিরের বেদিতে রাত্রিযাপন করে, দেবতার আনুকূল্যে যা পায় তা দিয়েই ক্ষুধা নিবৃত্তি করে। ভোলেনাথ তার নিবাসে আপনভোলা এই শিষ্যটিকে আড়াল থেকে দেখেন। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাস হল শিবনিবাসে আসার সবচেয়ে ভালো সময়, কারণ ভীম একাদশী থেকে শিবরাত্রি পর্যন্ত বড়ো করে মেলা হয় এখানে। ভক্তদের বিশ্বাস বাবা তখন সবচেয়ে বেশি জাগ্রত থাকেন এবং সকল মনস্কামনা পূরণ করেন। মন্দিরের সামনের দোকান থেকে পূজার সামগ্রী সংগ্রহ করা যায়। নিকটবর্তী আরেকটি মন্দির রয়েছে যা রাম-সীতার মন্দির নামে খ্যাত।
রাম-সীতা ও লক্ষণের মূর্তিসহ আরো দেব-দেবীর মূর্তি রয়েছে এই মন্দিরে। রামচন্দ্রের মূর্তিটি কোষ্টীপাথরের এবং সীতার মূর্তিটি অষ্টধাতুর। মন্দিরের শিখরে রয়েছে চক্র। হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে চৈত্র মাসে শুক্লা নবমীতে নিষ্ঠা সহকারে রামনবমী পালিত হয় এখানে। এছাড়াও শিবনিবাসে গাজনের মেলা অনুষ্ঠিত হয়, এই সময়ে দূর-দূরান্ত থেকে সন্ন্যাসীরা আসেন এই পুণ্যভূমিতে।
এবার আসা যাক, মন্দিরের ইতিহাসকথায়। সেই যুগে শিবনিবাস সংলগ্ন অঞ্চলে নসরৎ খাঁ নামে এক দুর্ধর্ষ ডাকাতের কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। অঞ্চলটিকে নসরৎ খাঁর বেড় বলে চিহ্নিত করা হত। এই অত্যাচারী ডাকাতের আরাধ্য দেবতা ছিলেন স্বয়ং মহাদেব। নসরৎ খাঁর প্রকোপ থেকে প্রজাগণকে বাঁচাতে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র একটি কৌশল অবলম্বন করলেন। ডাকাতের আরাধ্য দেবতা শিবের উদ্দেশ্যে শিবনিবাস নির্মাণ করেন এবং সুরক্ষিত রাখতে একে কেন্দ্র করে একটি কৃত্রিম খাল খনন করেন।
এই খালটিই পরবর্তীতে চূর্ণী নদী নামে পরিচিতি পায়। কিন্তু ভৌগলিক ভাবে চূর্ণী একটি প্রাকৃতিক নদী তাই এই মত গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশের পদ্মানদী থেকে উৎপন্ন মাথাভাঙ্গা নদীর দুটি শাখার একটি শাখা চূর্ণী নামে শিবনিবাসের কাছে প্রবাহিত। শিবনিবাস পৌঁছতে হলে এই নদীর ওপরের বাঁশের ছোটো সাঁকো পেরিয়ে আসতে হয়।
শিবনাথ শাস্ত্রীর রচিত "রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন-বঙ্গসমাজ" বইয়ে অন্য তথ্য পাই। বইয়ে উল্লেখ পাওয়া যায়, ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দে নবাব আলিবর্দ্দী খাঁ-এর সময় থেকে বর্গী আক্রমণের শুরু। তৎকালীন অবস্থা উপলব্ধি করে নিরাপদ স্থানের উদ্দেশ্যে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কৃষ্ণনগর থেকে ছয় ক্রোশ দূরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন এবং পুত্র শিবচন্দ্রের নামানুসারে জায়গাটির নাম দেন "শিবনিবাস"। এ স্হানেই রাজপ্রাসাদ, দেবালয় ও নিকট আত্মীয়দের নিয়ে একটি সুরক্ষিত নগর গড়ে তোলেন।
এবারে শিবনিবাস কেন "বাংলার কাশী" খ্যাতিলাভ করে সেই গল্পে আসা যাক। জনশ্রুতি মতে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কাশীর শিবের স্বপ্নাদেশ পান যে, তিনি কাশী ছেড়ে কৃষ্ণচন্দ্রের হাতে পূজা পেতে চান। সেই আদেশ পালনার্থেই কৃষ্ণচন্দ্র একশো আটটি শিবমন্দির স্থাপন করেন। যার অধিকাংশই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।
শ্রী শশিভূষণ বিদ্যালঙ্কার সঙ্কলিত "জীবনীকোষ" (ভারতীয় ঐতিহাসিক) দ্বিতীয় খন্ডে উল্লেখ আছে, শিবনিবাস প্রতিষ্ঠার পর কাশী ও কাঞ্চী থেকে আগত ব্রাক্ষ্মণগণের উপস্থিতিতে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র অগ্নিহোত্র বাজপেয় যজ্ঞ সম্পন্ন করেন এবং ব্রাক্ষ্মণ কর্তৃক মহারাজ "অগ্নিহোত্রী বাজপেয়ী" উপাধি পান। হয়ত একারণেও শিবনিবাস কাশীর সমতুল্য প্রসিদ্ধি লাভ করে।
যারা ধরাবাঁধা নিয়মের বাইরে ঘুরতে ভালোবাসেন তারা এখান থেকে একটি টোটো ভাড়া করে ঘুরে আসুন সীমান্তবর্তী এলাকায়। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এখান থেকে অনতিদূরেই রয়েছে। বিশ্বমায়ের এক সন্তান আমরা, কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে আমরা যে অনন্তের সন্তান তার সাক্ষাৎ উপলব্ধি হবে।