শীতলা অষ্টমীর প্রাক্কালে চাঁপাতলার শতাব্দী প্রাচীন শীতলা মায়ের কাহিনি

বসন্তে পূজিতা হন দেবী শীতলা। দোলপূর্ণিমার সাতদিন পর শীতলা অষ্টমী পালিত হয়। চৈত্র মাসের কৃষ্ণ পক্ষের অষ্টমী তিথিতে পালিত হয় শীতলা অষ্টমী। রোগবালাই থেকে রক্ষা পেতে এই দিন শীতলাদেবীর পুজো করা হয়। বসন্ত থেকে গ্রীষ্মে পা দিচ্ছে সময়, ঋতুর এই সন্ধিক্ষণে দেবী শীতলার পুজো পালিত হয়। সন্তানের সুস্থতা ও আরোগ্য কামনা করে শীতলা অষ্টমীর দিনে দেবীকে বাসি খাবারের ভোগ নিবেদন করা হয়। মনে করা হয় দেবীর আশীর্বাদে জ্বর, হাম, বসন্ত রোগের কবল থেকে মুক্তি মিলবে। শীতল অর্থাৎ শরীর ও পরিবেশ ঠান্ডা রাখার উদ্দেশ্যেই দেবী শীতলা অষ্টমীতে দেবীকে বাসি খাবারের ভোগ নিবেদন করা হয়। দেবী শীতলাকে লৌকিক দেবী মনে করা হলেও, সেই মহাভারতের কাল থেকে তাঁর পুজো হচ্ছে। রামায়ণেও জ্বরাসুরের দেখা মেলে উত্তর কাণ্ডে। কেউ কেউ বলেন জ্বরাসুর হলেন শীতলার স্বামী। "বসন্ত আনিয়া দেবী কহেন জ্বরাসুরে। কার দেশে পূজা লবে বলহ আমারে।। জ্বরাসুর বলেন পূজার সব হেতু। চন্দ্রবংশ নরপতি, নাম চন্দ্রকেতু।।" অর্থাৎ, জ্বরাসুর রোগ ছড়াবে। দেবী সেই রোগ সারাবেন। স্কন্দপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণেও শীতলা বসন্তের দেবী। তাঁর কৃপায় রোগ সারে। মধ্যেযুগের বাংলায় মঙ্গলকাব্যের স্রষ্টারা যেমন কবি মানিকরাম গাঙ্গুলি, দ্বিজ হরিদেব বা কবি জগন্নাথ, কবি বল্লভ এবং কৃষ্ণরাম দাস শীতলা বন্দনা করেছেন। অন্য এক মতে, কাত্যায়নীর আর এক রূপ হল শীতলা। ব্রহ্মার কন্যা এবং কার্ত্তিকেয়ের স্ত্রী হিসেবেও শীতলাকে দেখা যায়।

Chapatala Maa Shitala Temple

গোটা কলকাতায় অসংখ্য শীতলা মন্দির রয়েছে। উত্তর কলকাতা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে দেবীর একাধিক প্রাচীন মন্দির। ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি আদপে ছিল দেবী শীতলার মন্দির। সেখানে সাহেবরাও যেতেন রোগ নিরাময় কামনায়। গবেষক রাল্ফ ডব্লিউ নিকোলাসের লেখা দ্য গডেস শীতলা অ্যান্ড এপিডেমিক স্মল পক্স ইন বেঙ্গল প্রবন্ধে দেখা যায়, দেবী শীতলা দু'শো বছর আগে বসন্ত রোগের দেবী হিসাবে কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম প্রধান আরাধ্যা দেবী হিসাবে নিজের জায়গা করে নিচ্ছেন। মানুষের বিশ্বাস ছিল, দেবীই শহর কলকাতাকে গুটি বসন্তের মহামারি থেকে রক্ষা করে গিয়েছেন। ১৮৫০-এর গুটিবসন্তের মহামারিতে কলকাতায় প্রায় ছয় হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। উনিশ শতকে প্রতি চার-পাঁচ বছরের ব্যবধানে গুটিবসন্ত মহামারী হয়ে হানা দিয়েছে কলকাতায়। প্রাণ কেড়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের। শ্যামপুকুর, কলুটোলা, মুচিপাড়া, তালতলা, বড়তলা ইত্যাদি এলাকায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছিল। এই সব অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন।
এই অঞ্চলগুলো ঘিরে সবচেয়ে বেশি শীতলা মন্দির গড়ে উঠেছে বয়স সবগুলোই প্রাণ। তেমনই একটি প্রাচীন শীতলা মন্দির রয়েছে চাঁপাতলায়।

জনশ্রুতি অনুযায়ী, চাঁপাতলার শীতলা জীবন্ত। তাঁর ভীম নাগের সন্দেশ খাওয়ার একটি ঘটনাও শোনা যায়। লেডি ডাফরিন হাসপাতাল ঘেঁষে চলে গিয়েছে স্কট লেন। সেকালের কলকাতায় এই পাড়ার নাম ছিল চাঁপাতলা। শহর কলকাতার প্রাচীন শীতলা মন্দিরগুলোর অন্যতম চাঁপাতলার শ্রী শ্রী শীতলা মাতার মন্দির। বউবাজারের চাঁপাতলার মা শীতলার পুজোর বয়স ১৮৩ বছর। হালের কলকাতায় মন্দিরের ঠিকানা এক নম্বর ডাঃ অমল রায়চৌধুরী লেন, কলকাতা-৯, যা স্থানীয় মানুষদের কাছে চাঁপাতলা বলেই পরিচিত। জেলেপাড়াও বলা যেতে পারে। কৈবর্ত্য সম্প্রদায়ের মানুষেরা এখানে বসবাস করতেন। আজও করেন। চাঁপাতলার মা শীতলার পুজোর আয়োজন করে কৈবর্ত্য জনসংঘ সেবকবৃন্দ।

জনশ্রুতি অনুযায়ী, কোনও এক ব্যক্তি স্বপ্নাদেশ পান মা শীতলা এক কিশোরী মেয়ের রূপ ধরে এসে তাকে বলেন, এক করবী গাছের তলায় শিলাখণ্ড রূপে তিনি অবস্থান করছেন। সেই শিলাখণ্ডটি মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করে তাকে পুজো করার আদেশ দেন। করবীতলা থেকে শিলাখণ্ডটি উদ্ধার করে, একটি মাটির ঘর বানিয়ে, হোগলা পাতার ছাউনির আচ্ছাদনে শুরু হয় পুজো। স্থানীয় জেলে সম্প্রদায় মানুষেরা মাথায় করে রাখেন মা শীতলাকে। এখানে দেবী গর্দভের পৃষ্ঠে আরোহণ করেন। জগৎকে রোগমুক্ত করার কলস থাকে তাঁর হাতে। দেবীর গাত্রবর্ণ লাল। জেলে সম্প্রদায়ের জনৈক গোষ্ঠ বিহারী দাস মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য জমি দান করেছিলেন। কালে কালে তৈরি হয় আজকের মন্দির। আজও হাজার হাজার মানুষ মায়ের কাছে আসেন পুজো দেন। মানত করেন। বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিট থেকে মানুষেরা দণ্ডী কাটতে কাটতে মন্দিরে যান।

মন্দিরে শীতলা মায়ের পুজো শুরুর বিশেষ রীতি রয়েছে। পুরোহিত পরপর দুটো ফুল মায়ের মাথায় দেন। ফুল দুটো যদি পুরোহিতের হাতে পড়ে, তাহলে ধরে নেওয়া হয় পুজো শুরু করার অনুমতি দিলেন মা। শুরু হয় মায়ের পুজো। আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল ষোলো আনা ভোগ। আদপে এটি হল সন্দেশ। এককালে দাম ছিল এক টাকা। তাই নামটি ষোলো আনা ভোগ। এখনও ভীম নাগের দোকানে এই ষোলো আনা সন্দেশ বা ষোলো আনা ভোগ কিনতে লাইন পড়ে। ১৮৪ তম বর্ষে পদার্পণ করতে চলেছে মন্দিরটি। চৈত্র মাসে দেবীর বাৎসরিক পুজো হয়। মন্দিরে নানান উৎসব পালিত হয়। জন্মাষ্টমী, গুরুপূর্ণিমা, বারুণী, বুদ্ধপূর্ণিমা, জিতাষ্টমী ইত্যাদি তিথি উপলক্ষ্যে মন্দিরে বিশেষ পুজো

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...