বাংলা নাট্য জগতের এক বিখ্যাত অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তী বলেছিলেন "স্টেজের ওপর আমি যখন অভিনয় করি তখন লোকে আমাকে মেনে নেয়, কিন্তু যখন থিয়েটার শেষ করে মধ্য রাতে বাড়ি ফিরি তখন দর্শক আমাকে মেনে নিতে পারে না।" ১৯৪২ সালের ৫ই আগস্ট কলকাতার বাগবাজারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম অজিত চক্রবর্তী। শৈশব থেকেই তাঁর মধ্যে প্রকট ভাবে ইচ্ছা ছিল অভিনয় করার। তাই প্রচুর পড়াশুনো করে এবং বহু চাকরি করেও তাঁর মন সবসময়ে তাঁকে টেনেছে নাট্যমঞ্চে। নাটক করার জন্য কলেজের চাকরি ছেড়ে দেন। পাশাপাশি ‘নান্দীকারের’ হোলটাইমার হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৬১ সালে নান্দীকার নাট্যগোষ্ঠীতে তাঁর প্রথম অভিনয় এই দলের চতুর্থ নাটক 'চার অধ্যায়' নাটকে। শৈশব থেকে পরিবারিক কলহের ফলে কেয়ার মধ্যে সংগ্রামশীল মানসিকতা গড়ে উঠেছিল। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অসুবিধার কারনে পাঁচ বছর থিয়েটার থেকে সরে ছিলেন তিনি। কিন্তু থিয়েটার এমন একটা মাধ্যম, যা ভালবাসলে ছেড়ে থাকা যায় না।
তাই ১৯৬৬ সালে আবার পুনরায় যোগ দেন নান্দীকারে। একটা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু অর্থের প্রয়োজন থিয়েটারে অভিনয় করে তিনি তা কখনও পাননি এবং তিনি কখনও চান ও নি। তিনি তাঁর খরচা চালিয়েছেন বেতার, চলচ্চিত্রে অভিনয় করে কিন্তু কখনো থিয়েটার থেকে মোটা টাকা নেন নি। তাঁকে থিয়েটারে অনেকে মোটা টাকা দিয়ে অভিনয় করানোর আমন্ত্রণ দিলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। তিনি পয়সা নিয়ে থিয়েটার করা পছন্দ করতেন না। থিয়েটার তাঁর কাছে অর্থ, খ্যাতি, প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এমনকি নান্দীকারের আর্থিক সংকটের সময়ে মায়ের গহনা বন্ধক দিয়ে তিনি অর্থ জোগাড় করেছিলেন নান্দীকারের জন্য। অসাধারন পরিশ্রম করতেন ছোট-বড়ো যে কোনো চরিত্রের জন্য। ১৯৭৪ সালে বাদল সরকারের তত্ত্বাবধানে 'মিছিল' নাটকে সামান্য পার্টে কোরাসে যে মহিলাটি মাত্র দু লাইন সংলাপে দর্শকদের মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন, তিনি আর কেউ নন কেয়া চক্রবর্তী। তাঁর অভিনীত নাটক গুলি হল তুঘলক, নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র, রাত্রি, নীলিমা, বৃত্ত, তিন পয়সার পালা, নটী বিনোদিনী, ফুটবল, শাহি সংবাদ, রক্তকরবী, শেষরক্ষা প্রভৃতি। তাঁর অভিনীত নাটকের সংখ্যা শতাধিক এছাড়া তিনি চারটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন। তাঁর মৃত্যু ছিল বাংলা নাট্য জগৎ এর এক মর্মান্তিক ঘটনা। একটি ছবির শুটিং করতে গিয়ে তিনি মারা যান। অভিনয়ে নিবেদিতপ্রাণ একজন মানুষ অভিনয় করতে করতেই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চিরবিদায় নেন, এর থেকে ভাল মৃত্যু বোধহয় আর কিছুই হতে পারেনা।