বোধন কথা: বোধন ও অকালবোধন

বাঙালির বছরব্যাপী প্রতীক্ষার অবসান হয় ষষ্ঠীতে, বেলতলায় দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। দেবীপক্ষের অর্থাৎ শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে দেবীর বোধন হয়৷ মৎস্যপুরাণ, মার্কেণ্ডয়পুরাণ, শ্রীশ্রীচণ্ডী, দেবীপুরাণ, কালিকাপুরাণ এবং দেবী ভাগবতে বোধনের উল্লেখ রয়েছে। নবম ও দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত দেবীভাগবতপুরাণ ও কালিকাপুরাণে এর বিবরণ রয়েছে। কালিকাপুরাণ অনুসারে, রাবণবধে রামচন্দ্রকে সাহায্য করার জন্য রাত্রিকালে দেবীর বোধন করেছিলেন ব্রহ্মা। যদিও বাল্মীকির রামায়ণে শ্রীরামচন্দ্রের দুর্গাপুজার কোনও বিবরণ নেই। প্রচলিত ইতিহাস অনুসারে, সত্য যুগে রাজর্ষি সুরথ চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষে দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়া দুর্গার বসন্তকালে বোধন করেছিলেন। যাকে আমরা বাসন্তী পুজো বলি। আর আশ্বিন মাসে অর্থাৎ শারদীয়ায় হয় অকালবোধন। 

বছরকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়, উত্তরায়ণ ও দক্ষিনায়ণ। সূর্যের উত্তরায়ণের সময় অর্থাৎ শ্রাবণ হতে পৌষ অবধি সময়কাল হল দেবতাদের দিন। উত্তরায়ণে বিষুবরেখা থেকে সূর্যের ক্রমশ উত্তরে গমন। গমনে সময় লাগে ছয় মাস। এই সময় দেবতারা জাগ্রত থাকেন। তাই এই সময় দেবতাদের পুজো করা শাস্ত্রসম্মত। এই সময় পুজো করলে আলাদা করে বোধন করার প্রয়োজন পড়ে না। অন্যদিকে, সূর্যের দক্ষিণায়ণ হল দেবতাদের রাত। মাঘ থেকে আষাঢ় পর্যন্ত দক্ষিণায়ণে বিষুবরেখা থেকে সূর্যের ক্রমশ দক্ষিণে গমন করে। সূর্যের এই গমনকালও চলে ছয় মাস যাবৎ। রাত তাই স্বভাবতই এই সময় দেবতারা ঘুমান। শরৎকাল দক্ষিণায়ণের সময়ের মধ্যে পড়ে অর্থাৎ এই সময়টা হল দেবতাদের রাত্রিকাল। এই সময় পুজো করা শাস্ত্রসম্মত নয়। সেই একই কারণে শরৎকাল পুজোর জন্যে উপযুক্ত সময় নয়। তাই এই সময় দেবতার পুজো করতে হলে, দেব-দেবীকে জাগরিত করতে হয়। জাগরণের এই প্রক্রিয়াটিই বোধন নামে পরিচিত। পঞ্জিকা অনুযায়ী, ষষ্ঠীর দিন সকালে দেবী দুর্গার ষষ্ঠ্যাদি কল্পারম্ভ এবং ষষ্ঠিবিহিত পুজো, সন্ধ্যায় দেবীর বোধন। বোধন মানে, জাগরণ, বোধন শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল- 'বোধ'+'অনট' ধাতু= জাগ্রত করা। 

সংস্কৃত থেকে অকাল ও বোধন শব্দদুটি বাংলা ভাষায় তৎসম শব্দ হিসেবে গৃহীত হয়েছে। অকাল শব্দের অর্থ অসময়, যা শুভকর্মের জন্যে অনুপযুক্ত সময়। অন্যদিকে বোধন শব্দটির অর্থ উদ্বোধন, নিদ্রাভঙ্গকরণ। অকালবোধন শব্দবন্ধটির অর্থ অসময়ে বোধন বা জাগরণ অর্থাৎ অসময়ে দেবী দুর্গার আরাধনা।

শ্রীরামচন্দ্র রাবণকে পরাজিত করতে অসময়ে মায়ের পুজো করেছিলেন। তাই এই পুজোকে অকালবোধন বলা হয়। যেহেতু অকাল বোধন শরৎকালে হয়েছিল তাই একে শারদীয়া বলা হয়। কিন্তু ঘুমন্ত দেবীকে জাগ্রত করার জন্য স্বয়ং ব্রহ্মাকে দেবীস্তুতি করেছিলেন। পুজোর সূচনাক্ষণে স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মা দেখেছিলেন সাগরের বালুকাবেলার অনতিদূরে গহন অরণ্যে একটি বিল্ববৃক্ষের নীচে একটি আট থেকে দশ বছরের বালিকা আপন মনে খেলছে। ব্রহ্মা ধ্যানস্থ হয়ে জানলেন, সেই বালিকাই স্বয়ং গৌরী, কন্যকা। ব্রহ্মা চোখ মেলতেই সেই বালিকা ওই বিল্ববৃক্ষে লীন হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ব্রহ্মা স্থির করলেন, দেবী দুর্গার সেই বোধনের পূজার্চনা হবে ওই বিল্ববৃক্ষের নীচে। তাই আজও দেবীর বোধনের আগে বিল্বশাখা বা বিল্ববৃক্ষকে পুজো করে তা প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। ​ব্রহ্মার আহ্বানে দেবী বিল্ববৃক্ষের এক বিল্বপত্রে কুমারী কন্যার রূপে আবির্ভূতা হন৷ আজও বিল্ববৃক্ষের নীচেই দেবীর বোধন হয়। ষষ্ঠীতিথির সন্ধ্যায় প্রথমে দেবীর বোধন হয়, তারপর হয় অধিবাস ও সবশেষে আমন্ত্রণ করা হয়৷ 

ষষ্ঠীর সকালেই বোধন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত গোটা পুজো পর্বে যেন কোনও বিঘ্ন না ঘটে, তাই দেবীর কাছে প্রার্থনা করা হয়। এরপর ঘট ও জলে পূর্ণ একটি তামার পাত্র মণ্ডপের কোণে স্থাপন করা হয়। এই স্থানেই দুর্গা ও চণ্ডীর পুজো করা হয়।তারপর হয় বোধন। বোধনের পর বিল্ব শাখার দেবীকে আহ্বান জানানো হয়। ঘটের চারপাশে তীরকাঠিতে সুতো জড়িয়ে আমন্ত্রণ প্রক্রিয়া শুর হয়। এ ভাবেই শেষ হয় মহাষষ্ঠীর আচার। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী এ দিনই স্বর্গ থেকে মর্ত‍্যে পদার্পণ করেন দেবী দুর্গা। সঙ্গে তাঁর চার সন্তান লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিক, সরস্বতীও আসেন। মনে করা হয়, বোধনের পর প্রতিমার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয়। 

তবে বাংলায় আরও এক বোধন রয়েছে। কথায় বলে, জিতার ডালায় বোধন আসে। জিতাষ্টমী এক ব্রত, এই ব্রতে সন্তানের মঙ্গলকামনায় জীমূতবাহনের আরাধনা করা হয়। দুর্গাপুজোর অষ্টমীর আগের অষ্টমী তিথিতে অর্থাৎ কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমীর পরের দিন কৃষ্ণনবমীতে কোথাও কোথাও দেবীর বোধন হয়। বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে মায়ের আগমনের এটি পালিত হয়।দুর্গাপুজোর আগে আশ্বিনে যে অষ্টমী আসে, সেই অষ্টমীর পালনের মধ্য দিয়ে মায়ের বোধনের সূচনা হয়। এই ব্রত পালনের শেষ ব্রতীরা ভেজা বস্ত্র পরিহিতা অবস্থায় প্রত্যেকে মঙ্গলঘটে নদী থেকে জল সংগ্রহ করে বাড়ি নিয়ে আসেন। বাড়িতে বা পুজোর মণ্ডপে সেই ঘট প্রতিস্থাপনের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার বোধনের সূচনা হয়, এমনটাই স্থানীয় বিশ্বাস। কৃষ্ণানবমাদিকল্প অর্থাৎ জিতাষ্টমীর পরের দিন বোধন হয়। বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাদের দ্দুর্গাপুজো যা আঠারো দিন ধরে চলে তা এই তিথি থেকেই শুরু হয়। শোভাবাজারের রাজবাড়িতেও এই দিন বিশেষ পুজো করা হয়। 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...