শশী ‘স্টার’ না ‘ট্যাক্সি’?

যে কাউকে নাকি গাড়িতে বসিয়ে নিতেন তিনি। যে কেউ তাঁর গাড়ির সওয়ার হতে পারত। এমন কান্ডের জন্য কাপুর হাউসে তাঁর ডাক নাম হয়ে গিয়েছিল ‘ট্যাক্সি’। এই নামেই ভাই শশীকে ডাকতেন দাদা রাজ কাপুর।

রাজ তখন ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ ছবিতে হাত দিয়েছেন। কাস্টিং-এর কাজ চলছে। শশীর ডেট পেতে পাগলের মতো তাঁকে ধাওয়া করছেন রাজ। কিছুতেই ধরতে পারছেন না তাঁকে।

রাগ বাড়ছে। বিরক্তিও। কিন্তু শশীকে কাস্টিং তিনি করবেনই। যুবক রাজের একমাত্র মুখ হয়ে উঠতে পারবেন ভাই শশী। মানে শশী কাপুর, আর কেউ নয় - এ ছিল তাঁর স্থির বিশ্বাস।

একটা সময় সত্যি সত্যি নিজের গাড়িটাই বাড়ি হয়ে উঠেছিল শশীর। দিন থেকে রাত শুধু ছবির কাজ। ‘রাউন্ড দ্য ক্লক’ এক ফ্লোর থেকে আর এক ফ্লোরে দৌড় । চার থেকে পাঁচ শিফট টানা।

অগত্যা গাড়ি ভিতরের খাওয়া-ঘুম আর সুযোগ পেলে হালকা বিশ্রাম। এই কারণেই দাদা রাজ নাম দিয়েছিলেন ‘ট্যাক্সি’।
রাজের ছবিতে কাজ করতে গেলে সেই সময় অন্য ছবিতে কাজ করা যাবে না। অন্য শিফট তো দূরের কথা। তাই দাদার প্রস্তাবে এক কথায় রাজী হওয়া শশীর পক্ষে খুব সহজ ছিল না।

শেষ পর্যন্ত ডেট সমস্যা মিটেছিল। ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ ছবিতে শশী কাপুরের বিপরীতে নায়িকা ছিলেন জিনত আমন। দুজনেরই শুটিং ক্যালেন্ডার শুনে তো রাজ কাপুর তো থ! তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা স্টার নয়, তোমরা আসলে ট্যাক্সি! কেউ মিটার ডাউন করলেই দৌড়াচ্ছ...এখানে দু’ঘন্টা...ওখানে দু’ঘন্টা!’

দাদা রাজের এই মন্তব্যে কষ্ট পেয়েছিলেন শশী। বহুদিন পর্যন্ত ভুলতে পারেননি। ‘সেনসিটিভ’ মানুষ ছিলেন, তাই যে যাই বলুক কিছুতেই ভুলতে পারতেন না। বিশেষ করে রাজের কথা। রাজ তাঁর কাছে শুধু ‘দাদা’ নন, পিতৃপ্রতীম’।

১৯৭০। দেশ উত্তাল। রাজনীতি অস্থির। সেই অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের সব স্তরে। শশীর কেরিয়ারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বছর। একের পর এক বড় প্রোজেক্টে ব্যস্ত তিনি। শ্বাস ফেলার ফুরসত পান না।

সেই সময় থেকেই এক স্টুডিয়ো থেকে আর স্টুডিয়ো দৌড়ের শিডিউলে ঢুকে পড়লেন শশী। একসঙ্গে অনেক ছবি।
‘শর্মিলি’ ছবির পরিচালক সমীর গাঙ্গুলী বলেন, এই সময় হিন্দি ছবির দুনিয়ায় ‘শিফট সিস্টেম’ চালু হল। যার মূল হোতা শশী। সেই সময়ের ব্যস্ততম অভিনেতা।

যতই ডায়েরিতে ডেট নিয়ে চাপ থাক কোনও পরিচালককে ফেরাতেন না। এতটাই সময় সম্পর্কে চেতন যে তাঁকে দেখে ঘড়ি মিলিয়ে নিতে পারতেন পরিচালকরা। মাঝে মাঝে যদিও বা দেরী হয়ে যেত সেটে পৌঁছতে সে সব পরিচালকরা ধর্তব্যের মধ্যে আনতেন না। তাঁরা জানতেন শশীর শিডিউল। এও জানতেন শশী একবার সেটে পৌঁছালে আর কিছু ভাবতে হবে না।

শশীর কাজের ধরনটাও বেশ অভিনব। নীতু সিং তখন সবে পা রেখেছেন ইন্ড্রাস্ট্রিতে। একটা মশলা মুভিতে অভিনয় করছেন শশীর সঙ্গে। নীতু তখনও কাপুর পরিবারের সদস্য হননি। শশী তাঁর ‘শশী আঙ্কেল’।

নীতুর কথায়, ‘সেটে এলেন শশী আঙ্গেল। এসেই বললেন, ‘উই উড ডু থ্রি শিফট। আই ডোন্ট নো ম্যাঁয় কিসকা ক্যারেক্টার কর রাহি হুঁ। হাঁ, লাইনস কেয়া হ্যায়’?

এতটাই চাপে ছবির কাজ চলত যে অনেক সময় মনে রাখতে পারতেন না কোন ছবিতে কোন চরিত্র করছেন। ছবির গল্পও।
ছবির জগতের অনিশ্চয়তা তাঁর এমন দৌড়ের একটা বড় কারণ। নিজের এবং পরিবারকে আর্থিক নিরাপত্তা দেওয়াটা তাঁর কাছে সবচেয়ে জরুরী হয়ে উঠেছিল। শুধু মাত্র সেই কারণেই এমন বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেছিলেন যা তাঁকে সমালোচনার মুখে ফেলেছিল।

মেয়ে সঞ্জনা কাপুর একবার মা জেনিফারকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘শশী এমন সব ছবিতে কেন অভিনয় করেন’!
জেনিফার মেয়েকে বলেছিলেন, ‘যদি তুমি ভাব প্রতি গরমে লন্ডনে ছুটি কাটাতে যাবে, কিংবা গোয়ায় একটা বাড়ি থাকবে তাহলে তার জন্য টাকা দরকার। এই চক্রে একবার আটকে গেলে আর বেরনোর পথ নেই’।

শশী ‘স্টার’ না ‘ট্যাক্সি’ সে নিয়ে রাজের ধন্দ থাকলেও দর্শকদের ছিল না। কী বাণিজ্যিক ছবি কী অন্যধারা সবেতেই সফল শশী। শশীই প্রথম ভারতীয় অভিনেতা যিনি হলিউড ছবিতে অভিনয় করেন। হলিউড ছবি থেকে মশলা ফিল্ম সবেতেই তিনি হীরক দ্যুতিতে উজ্জ্বল।
তথ্যঋণ ঃ (Shashi Kapoor: The Householder, the Star )

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...