শঙ্করের 'চৌরঙ্গীর' স্যাটা বোসকে নিশ্চয়ই মনে আছে!
সত্যসুন্দর ওরফে স্যাটা এয়ার হোস্টেস সুজাতা মিত্রের গল্প দানা বেঁধেছিল শাহজাহান হোটেলে। ঠিক সেইভাবে আরেকটি প্রেম কাহিনির সাক্ষী কলকাতার একটি হোটেল।
সদর স্ট্রিটের এলগিন ফেয়ারলন হোটেল হোটেলের ১৭ নম্বর ঘরটি। কার্পেটে মোড়া কাঠের সিঁড়ি, বাহারি রেলিং, লাল মেঝের দালান আর সবুজ খড়খড়ির ফেয়ারলন সেই গল্প বুকে আগলে রেখেছে। ২৭ বছরের জেনিফার কেন্ডাল আর ২১ বছরের শশী কপূরের দাম্পত্যের ইনিংস শুরু করার কাহিনি।
গত শতকের পাঁচের দশকের কথা।
সাবেক গ্লোব সিনেমায় তখন ভ্রাম্যমাণ থিয়েটার দল ‘শেক্সপিয়ারানা’ নিয়ে জমিয়ে শেক্সপিয়রের নাটক করছেন জেনিফার কেন্ডালের মা-বাবা লরা ও জেওফ্রে।
ব্রিটিশ নাটকের দলটির সঙ্গে একবার একই জায়গায় পড়ল ‘পৃথ্বী থিয়েটার’-এর শো। দুই দল কথা বলে ঠিক করেছিল দুই দল দু’দিনে শো করবে। তার মাঝেই দেখা হল দু’জনের।
'দ্য টেমপেস্ট'-এর মিরান্ডাকে দেখে প্রেমে পড়লেন পৃথ্বীরাজ কপূরের মেজ ছেলে শশী কপূর। তখন ‘শশী’ বলবীররাজ কপূর। তিনি তখন ‘পৃথ্বী থিয়েটার’-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেজ ম্যানেজার। অভিনয়ের পাশাপাশি সামলাতে হয় দলের অন্য দায়িত্বও। ইতিমধ্যে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেছেন ‘আগ’, ‘আওয়ারা’, ‘সংগ্রাম’-এর মতো ছবিতে। ছবিতে অভিনয় করতেন ‘শশীরাজ’ নামে।
মঞ্চে কাজ করতে গিয়েই আলাপ হয়েছিল নীল নয়নার সঙ্গে। আলাপ থেকে প্রেমে পড়তে সময় লাগেনি শশীর। কিন্তু সময় নিয়েছিলেন জেনিফার। ‘হ্যাঁ’ বলার পরও খুব গোপনে চলতে লাগল প্রেম পর্ব।
এমনকি জেনিফারের বাবা নাট্যব্যক্তিত্ব জেওফ্রে কেন্ডল শশীকে ডেকে নিয়েছিলেন নিজের দলে অভিনয়ের জন্য। তাঁর ইংরেজি উচ্চারণ নিখুঁত করার দায়িত্বে জেনিফার।
দুজনেই পরিণত মনের মানুষ। আন্দাজ করেছিলেন তাঁদের সম্পর্কের পথ সহজ হবে না। ভিন্ন জাতি সম্প্রদায়, বয়স-এমন সব বিষয় নিয়ে বাধার কাঁটা অনেক। শেষে বলবীর ওরফে শেষে বাড়িতে তাঁর বৌদি শাম্মী কাপুরের স্ত্রী গীতা বালিকে জানালেন তাঁর প্রেমের কথা। একদিন আলাপও করালেন জেনিফারের সঙ্গে।
গীতা জানিয়েছিলেন স্বামী শাম্মী কপূরকে। তাঁর মাধ্যমেই জানতে পারল গোটা পরিবার। এল তীব্র আপত্তি! জেনিফারের বাবাও মানতে পারলেন না খাঁটি ব্রিটিশ মেয়ের সঙ্গে ভারতীয় ছেলের সঙ্গে এই সম্পর্ক! পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন ‘দুজনকেই দল ছাড়তে হবে’! প্রেমের জন্য ‘শেক্সপিয়ারানা’ ছেড়েছিলেন জেনিফার, কিন্তু শশীর হাত ছাড়েননি কিছুতেই। বিপরীত পরিস্থিতি আরও মজবুত করেছিল সম্পর্ক।
১৯৫৮ সালের জুলাইয়ে বিয়ে সারলেন দুজনে। মধুচন্দ্রিমায় এসেছিলেন কলকাতায়। যে শহরে তাঁদের আলাপ হয়েছিল। ফেয়ারলন হোটেলের ১৭ নম্বর ঘরে কাটিয়েছিলেন কয়েকটা দিন।
শশী-জেনিফার কলকাতায় যখনই এসেছেন পাঁচতারা বিলাসের টান উপেক্ষা করে ফেয়ারলন হোটেলে উঠেছেন। এই হোটেলের কর্ত্রী ভায়োলেট স্মিথের আতিথেয়তার মায়াতেই আবদ্ধ হতে চেয়েছেন। জেনিফার বিদায় নেওয়ার পরেও শশী কপূর কলকাতায় এলেই তাঁর ঠিকানা হত ফেয়ারলন হোটেলের ১৭ নম্বর ঘরটি। শশী জেনিফারের প্রেমের সাক্ষী সেই ঘরটি এখন অতিথিদের কাছে ‘ শশী কপূর রুম’।
ফেয়ারলন হোটেলটি আর্মেনিয়ান এক ব্যবসায়ীর তৈরি। ভায়োলেট স্মিথ ছিলেন এই হোটেলের কর্ত্রী। বিশ শতকের গোড়ায় আর্মেনিয়ায় তুর্কিদের গণহত্যার সময়ে খাইবার পাস পেরিয়ে কোনও মতে ঢাকায় পালিয়ে আসেন ভায়োলেটের মা-বাবা। সেখানে কিছুদিন পাটের কারবার করার পর খুচরো পয়সা ভরা কেরোসিনের টিন নিয়ে চলে আসেন কলকাতা। এরপরই সদর স্ট্রিটে হোটেল ব্যবসার সূত্রপাত। ভায়োলেটের সঙ্গে ইংরেজ অ্যাডমন্ড ফ্রেডরিক স্মিথের বিয়ে হয়। বিবাহ সূত্রে ভায়োলেট ইংল্যান্ডে গেলেও সেখানে বেশি দিন থাকেননি। কলকাতার প্রতি প্রেম তাঁকে সেখানে বেশিদিন থাকতে দেয় নি। ছয়ের দশকে বরকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন এবং হোটেলের দায়িত্বভার নেন। হয়ে ওঠেন 'ডাচেস অফ সদর স্ট্রিট'। এই নামেই ভায়োলেট স্মিথ কলকাতার বুকে পরিচিত।