ওকালতি ছেড়ে সাহিত্যে এসেছিলেন শরদিন্দু

কবিতার ধড় মাথা-বুঝি-না-রে ভাইরে

ছন্দের মিল খোঁজা বড়ই বালাই রে

ওসব চলে না আর

কবি বলে বারবার

কবিতার সাথে তাই " মেইড ইজি চাইরে।

প্রথমেই পাঠকের কাছে একটা প্রশ্ন। বলতে হবে উপরের এই লিমেরিকটি কার লেখা। একটা ক্লু দেওয়া যাক। এই লিমেরিকটি যার লেখা তিনি একজন অতি বিখ্যাত সাহিত্যিক এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় এক গোয়েন্দা চরিত্রের স্রষ্টা। এইবার পাঠক একটু ধন্দে পড়বেন। কারণ বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা চরিত্র তো বেশ ক'জন রয়েছে। আর চমৎকার লিমেরিক লিখতেন সত্যজিৎ রায়। বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্রের স্রষ্টা ও বটে। তবে কি ...? এবার বলা যাক যে না, এই মজাদার লিমেরিকটি সত্যজিৎ রায় লেখেননি।

এই লিমেরিকটি যার লেখা তিনি কিন্তু প্রথমে কবিতাই লিখতেন। কুড়ি বছর বয়সে তাঁর প্রথম বই, একটি কবিতা সংগ্রহ প্রকাশিত হয়েছিল যদিও তা পাঠক মহলে তেমন সমাদৃত হয়নি। এখনও ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না তাই না? তাহলে এবার শেষ ক্লু –তাঁর গোয়েন্দা কাহিনীগুলো এবং ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলি এখনও সর্বাধিক বিক্রিত দশটি বাংলা বইয়ের তালিকায় বেশ উপরের দিকে থাকে। তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলি পাঠক মনে তুমুল সাড়া ফেলেছিল এবং এখনও মনে তোলপাড় সৃষ্টি করে। সাহিত্যিক নিজেই একবার বলেছিলেন – "ইতিহাসের গল্প লিখেই বেশি তৃপ্তি পেয়েছি। মনে কেমন একটা ‘সেন্স অফ ফুলফিলমেন্ট’ হয়। গৌড়মল্লার ও তুঙ্গভদ্রার তীরে লেখার পর খুব তৃপ্তি পেয়েছিলাম।" এইবার সবাই বুঝতে পেরে গিয়েছেন কার কথা বলা হচ্ছে এখানে।

ঠিকই ধরেছেন, বাংলা সাহিত্যের আকাশে যে ক’জন সাহিত্যিকদের নাম ধ্রুবতারার মতো চিরউজ্জ্বল হয়ে রয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম, ইনি– শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় যাকে বেশিরভাগ বাঙালি ‘ব্যোমকেশ’ এর সৃষ্টিকারী বলেই চেনেন।

এই অতি জনপ্রিয় সাহিত্যিক মানুষটি তাঁর জীবৎকালে এটাই ভেবে গিয়েছেন আর বেশিদিন তিনি সাহিত্য সৃষ্টিতে পারঙ্গম থাকবেন না। কুড়ি বছর বয়সেই তাঁর ভাবনা, “এই যে এতগুলো দিন গেল, আমি কি করলুম!”

‘কালের মন্দিরা’ (১৯৫১) যখন লিখছিলেন তখন এক বার ভেবেছিলেন যে এরপর আর বড় কিছু লিখবেন না। কারণ তাঁর “বয়স বাড়িতেছে, জীবন জটিলতর হইয়া উঠিতেছে। অতঃপর দীর্ঘ রচনা আর সম্ভব হইবে না।কিন্তু ঘটনা হল ''নীহাররঞ্জনের 'বাঙ্গালীর ইতিহাস' পড়িয়া আবার মাথায় একটি উপন্যাস আসিয়াছে। লিখিতে আরম্ভ করিয়াছি।”

এটাই ছিলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় যার ‘কালের মন্দিরা’, ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’ অথবা ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ পড়ে আজও পাঠক মুগ্ধতার আবেশে ডুবে যায়।

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা তারাভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বিহারের মুঙ্গেরের নামজাদা উকিল। তাঁর একান্ত বাসনা ছিল ছেলে আইনজীবী হোক। তাদের বাড়িতে প্রচুর বই ছিল, বহু নামকরা সাহিত্যপত্রিকাও আসত। সেই কারণে খুব কম বয়স থেকেই শরদিন্দুর সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল। প্রথম দিকে ইংরেজি বই পড়ার ঝোঁক ছিল বেশি। কিন্তু রমেশচন্দ্র দত্তের লেখা পড়ে প্রথম বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর ভালোবাসা জন্মাল।

তাঁর যখন পনেরো বছর বয়স বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা হৃদয় হরণ করে নিল। লেখার অভ্যাসও তখন থেকেই। তবে তখনও ভাবেননি যে সাহিত্য সাধনা করেই জীবন অতিবাহিত করবেন। ষোল বছর বয়সে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পরে এলাহাবাদে মামার বাড়ি গিয়েছিলেন। সেখানে লিখলেন কয়েকটি শেষ না হওয়া ছোটগল্প এবং আস্ত একটা উপন্যাস। কিন্তু বেশ কয়েক বার চেষ্টা করেও প্রকাশ করা যায়নি সেই উপন্যাস। খসড়া অবস্থায় ঘরেই পড়ে ছিল। বহুদিন পর প্রকাশিত হয়েছিল সেই উপন্যাস, যে উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সিনেমাটি আজও বাঙালির মন জুড়ে রয়েছে। সেই অবিস্মরণীয় উপন্যাসের নাম 'দাদার কীর্তি'

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র ‘ব্যোমকেশ বক্সী’ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিগুলির অন্যতম। ব্যোমকেশ চরিত্র নিয়ে তিনি তেত্রিশটি কাহিনি লিখেছিলেন। ব্যোমকেশ কাহিনি নিয়ে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে যার মধ্যে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘চিড়িয়াখানা’য় অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছিলেন উত্তমকুমার। তাঁর সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সীর প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৩২ সালে। 'পথের কাঁটা', 'সীমন্তহীরা' আর 'সত্যান্বেষী' এই তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল বসুমতীতেই। পরের বছর লিখলেন 'মাকড়সার রস'

এই চারটি কাহিনী নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল ব্যোমকেশের প্রথম বই, 'ব্যোমকেশের ডায়েরি'। পরের চার বছরে ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে আরও ছটি উপন্যাস লেখার পর বহু বছর আর ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে কিছু লেখেননি। চলে গিয়েছিলেন বম্বেতে। সেখানে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাহিনীকার-চিত্রনাট্যকার হিসেবে কাজ করেছেন ১৯৫১ পর্যন্ত। তারপর সেই ফরমায়েশি কাজ ছেড়ে দিয়ে আবার সাহিত্য সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করেন। দীর্ঘ ১৫ বছর পর আবার ব্যোমকেশ কাহিনি লিখলেন প্রিয় বন্ধু পরিমল গোস্বামীর অনুরোধে। এবার লিখলেন ব্যোমকেশকেন্দ্রিক তেইশটি উপন্যাস। এই দ্বিতীয় পর্বের প্রথম ব্যোমকেশ কাহিনী লিখলেন ‘চিত্রচোর’। শেষ ব্যোমকেশ কাহিনী ‘বেণীসংহার’ শেষ করে যেতে পারেননি তিনি।

শরদিন্দুবাবুর ছোটগল্পগুলো এবং ছোটদের জন্য লেখাগুলিও কম আকর্ষণীয় নয়।সদাশিব-কাহিনি আজও ছোটদের খুব প্রিয়।

খেলাধূলোর প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, টেনিস, বাস্কেটবল, ভলিবল সবরকম খেলা খেলতেন স্কুল ও কলেজ জীবনে। কলেজে পড়াকালীন চুটিয়ে সিনেমা দেখেছেন। শখের থিয়েটারে অভিনয়ের নেশাও ছিল। ওকালতি না সাহিত্যসাধনা–এই সিদ্ধান্ত নিতে কেটেছিল চৌত্রিশ বছর। প্রথমে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন- আইনজীবী হয়ে কোর্টে প্র্যাকটিস করা। কিন্তু ওকালতি নাকি মা সরস্বতীর চরণে ঠাঁই নিয়ে সাহিত্য সাধনা, এই দ্বন্দ্ব কাটিয়ে শুধুমাত্র সাহিত্য সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করা- এই সিদ্ধান্ত নিতে বেশ কয়েক বছর সময় লেগেছিল তাঁর।

তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্প 'উড়ো মেঘ' বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর একে একে 'প্রবাসী', 'ভারতবর্ষ' ইত্যাদি তৎকালীন বিখ্যাত পত্রিকাগুলোতে তাঁর লেখা বেরোতে থাকল। এরপর তিনি বুঝতে পারলেন যে সাহিত্য সৃষ্টিই তাঁর কাজ, ওকালতি নয়। তাঁর গল্পের উপর বেশ কিছু বাংলা সিনেমা তো বটেই, হিন্দি সিনেমাও তৈরি হয়েছিল। যেসব প্রখ্যাত পরিচালক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প বা উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন তাদের মধ্যে তরুণ মজুমদার, সত্যজিৎ রায়, ঋতুপর্ণ ঘোষ এবং অঞ্জন দত্তের নাম উল্লেখযোগ্য। ১৯৭০ সালে হৃদরোগ আক্রান্ত হয়ে তিনি পরলোকগমন করেন। এই বিখ্যাত সাহিত্যিক জন্মগ্ৰহণ করেছিলেন ৩০শে মার্চ, ১৮৯৯। তাঁর লেখা একটি সরস কবিতার পংক্তি দিয়েই তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা যাক।

"শিল্পীর শিরে পিলপিল করে আইডিয়া

লেখেন যখন পুস্তক তিনি তাই দিয়া

উইপোকা কয় চল এইবার খাই গিয়া"....

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...