শরদিন্দু বলতেই আমাদের প্রথম যে নামটা মনে আসে, তা হল ব্যোমকেশ। নিজের মেস জীবনের অভিজ্ঞতাকে কলমের মোচড়ে কালোত্তীর্ণ করে গিয়েছেন তিনি নিজেই। কিন্তু শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় মানে কি শুধুই ব্যোমকেশ? শরদিন্দু ছিলেন একাই একশো। জীবনের প্রতিটি ভূমিকাতেই তিনি সুপারহিট।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় গল্পকার ও ঔপন্যাসিক হিসেবে পরিচিত হলেও, কবিতা লেখাতেও সমান পারদর্শী ছিলেন তিনি। তাঁর সাহিত্যজীবন শুরুই হয়েছিল কবি হিসেবে। তাঁর রচিত প্রথম বই প্রকাশিত হয় তাঁর ২০ বছর বয়সে, সেটি ছিল বাইশটি কবিতার সংকলন ‘যৌবন-স্মৃতি’। শরদিন্দু হাস্যকৌতুক কবিতাও লিখেছিলেন, ‘চন্দ্রহাস’-নাম নিয়ে, সে সব সরস কবিতা লিখতেন তিনি। যেমন - শিল্পীর শিরে পিলপিল করে আইডিয়া,
লেখেন যখন পুস্তক তিনি তাই দিয়া।
উইপোকা কয় চল এইবার খাই গিয়া’!
আবার মজার প্যারোডিও লিখতেন তিনি, যেমন নজরুল গীতির প্যারডি করে লিখেছিলেন ‘তোমার এ মহাবিশ্বে ছাতা হারায় খালি প্রভু’! অসামান্য রসবোধের অধিকারী শরদিন্দু আবার কালো কোট পরে বাবার জুনিয়র হয়ে আদালতে গিয়ে ওকালতিও করেছেন।
খুবই আড্ডাপ্রেমী মানুষ ছিলেন, মুম্বাইতে থাকাকালীন মালাড ও পুণের দুই বাড়িতে আড্ডার আসর বসাতেন। শচিন কত্তাও সে আসরে যেতেন। শোনা যায় এই আসরে অন্তাক্ষরী খেলাও শুরু করেছিলেন ব্যোমকেশের গুরুগম্ভীর লেখক। কেবল ইনডোরই নয়, আউটডোর গেমেও অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন শরদিন্দু, খেলাধুলোর নেশা ছিল প্রবল। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, টেনিস, বাস্কেটবল, ভলিবল সবই খেলেছেন। সেই সঙ্গে সামরিক প্রশিক্ষণও নিয়েছেন জীবনে।
শরদিন্দু কিন্তু বিপ্লবীও ছিলেন, স্বদেশী আন্দোলনকে সমর্থন করতেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে বিলিতি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিছুদিনের জন্যে আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে সামান্য জড়িয়েও পড়েছিলেন। যদিও তার পরেই পড়াশোনায় ইতি টেনে মুঙ্গেরে ফিরে গিয়েছিলেন।
গপ্পো উপন্যাস তো আছেই, তাঁর নাটক লেখার হাতও ছিল জবরদস্ত। বরদার গল্পে যে বাণীমন্দির ক্লাবের কথা রয়েছে। সেই ক্লাব সত্যিই ছিল এবং ঐ ক্লাবের জন্যই বঙ্কিমচন্দ্র এবং রমেশচন্দ্র দত্তর উপন্যাসকে নাট্যরূপ দেওয়ার কাজ থেকেই শুরু হয়েছিল তাঁর নাটক লেখা। পরে শরদিন্দুর লেখা ‘শিব-উমা’ আর ‘ডিটেকটিভ’, দুটো নাটকের রেকর্ড বেরোয়। তাঁর লেখা নাটক ‘বন্ধু’ও রঙমহলে অভিনীত হত। কলেজজীবনে চুটিয়ে সিনেমা দেখেছেন। শখের থিয়েটার করেছেন নিজে। শুধু কলমেই ক্ষান্ত হননি! নিজে নেমেওছেন অভিনয়ে।
১৯৩৬-সালে রবীন্দ্রজয়ন্তীতে রেডিয়োয় লেখকদের নিয়ে ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ অভিনীত হয়। শরদিন্দু কেদারের চরিত্র করেন। তাঁর সহ-অভিনেতারা ছিলেন মনোজ বসু, সজনীকান্ত দাস, প্রমথনাথ বিশী, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিমল গোস্বামী প্রমুখ। পরিমল গোস্বামীর সরযূবালাতেও অভিনেতা শরদিন্দুকে পাওয়া গিয়েছে। নাটক ছাড়াও চলচ্চিত্র জগতেও তিনি তাঁর পারদর্শীতার ছাপ রেখেছিলেন। বোম্বে টকিজের হয়ে 'ভাবী’, ‘বচন’, ‘দুর্গা’, ‘কঙ্গন’, ‘নবজীবন’, ‘আজাদ’, ‘পুনর্মিলন’- এই সাতটি ছবির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন শরদিন্দু। গোয়েন্দা-রহস্য কাহিনী ছাড়াও লিখে গিয়েছেন সামজিক, রোম্যান্টিক উপন্যাস, ইতিহাস নির্ভর কাহিনী। গৌড়মল্লার, চুয়াচন্দন, তুমি সন্ধ্যার মেঘ, কালের মন্দিরা, কুমারসম্ভবের কবি-এর মতো সৃষ্টিই বলে দেয় কি ভয়ানক শক্তিশালী ছিল তাঁর কলম! কানু কহে রাই, ভল্লু সর্দার-এর মাধ্যমে তিনি ছোটদের জন্যও রেখে গিয়েছেন তাঁর সৃষ্টির ছোঁয়া।
মানুষ শরদিন্দু ছিলেন আদ্যন্ত গার্হস্থ্যে টইটম্বুর। মুহূর্মুহূ চা খেতেন। ভোজনরসিক ছিলেন, লেখার সময়ে অভ্যেস ছিল মাঝে মাঝে উঠে বয়াম খুলে হাল্কা কিছু মুখে দেওয়া।
তবে ব্যোমকেশ স্রষ্টার আরেকটি দিক ছিল জ্যোতিষ চর্চা। ছাত্রবয়স থেকেই প্ল্যানচেট করতেন তিনি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যে নেশাটি তিনি ছাড়তে পারেননি তা হল কুষ্ঠীবিচার।তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় একদা একটি চিঠিতে তাঁকে প্রশ্ন করছেন, ‘অশুভটা কোন পথ ধরে আসবে? একটু আলোকপাত করলে সুখী হব।’ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় থেকে রাজশেখর বসু, সকলেই তাঁর গণনায় চমৎকৃত। প্রমথনাথ বিশী চিঠিতে লিখছেন, ‘আপনার বিরহে আমরা অর্থাৎ প্রতুলবাবু, জিতেনবাবু, বিমল মিত্র, গজেনবাবু ও আমি সকলেই কাতর। আপনি আসিয়া গ্রহনক্ষত্রকে একটু সচল করিয়া দিবেন, এই ভরসায় আছি।’ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মারা গিয়েছেন। শরদিন্দু ডায়েরি লিখছেন, ‘জন্মসময়ের অভাবে লগ্ন স্থির করিতে পারিতেছি না... চেহারা ইত্যাদি হইতে মনে হয় সিংহ লগ্ন। সিংহ লগ্নের বুধ মারক। বুধ দশার আরম্ভেই মৃত্যু হইয়াছে।’ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জ্যোতিষ চর্চার এমন উদাহরণ অজস্র রয়েছে।
খেলা থেকে অভিনয়, বিপ্লব থেকে জ্যোতিষগিরি, সবেতেই তিনি ছিলেন জ্যাক অফ অল ট্রেডস! তিনিই বোধহয় গাইতে পারেন-
যেকোন ভূমিকায় সমানে লড়ে যাই,
আপনি যা চান আমি ঠিক তাই।