মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। নারীরা যাতে নিজেদের রক্ষা নিজেই করতে পারে তার জন্য আমাদের দেশেও নানারকম ভাবনাচিন্তা করা হচ্ছে। বেশ কিছু স্কুলে এবং মার্শাল আর্টস অ্যাকাডেমিতে মেয়েদেরও দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণ। যদিও চীন, জাপান-সহ বেশ কিছু দেশে এই প্রশিক্ষণ প্রায় দৈনিক জীবনেরই অঙ্গ। যাইহোক, আজ বলব সেই মার্শাল আর্টের পীঠস্থানের কথা; আশ্চর্যের বিষয় এর সূত্রপাত কিন্তু এক ভারতীয়র হাত ধরেই। কী সেই কৌশল?
বলছি চীনের হেনান প্রদেশের বিখ্যাত দেড় হাজার বছর ধরে চর্চিত শাওলিন কুংফুর কথা, যার মূল উদ্দেশ্য হল - মানব দেহকে শক্তিশালী প্রাণনাশক অস্ত্রে পরিণত করা। চীনা ভাষায় ‘গুমফু’ বা কুংফু শব্দের অর্থ - ধৈর্য্য ও শক্তির মাধ্যমে অধ্যয়ন। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে, ভ্রান্তি বশতঃ কুংফু ও ক্যারাটে একই জিনিস মনে হলেও বিষয়টি এক্কেবারে ভিন্ন।
কুংফু হল চীনের ও ক্যারাটে হল জাপানের আত্মরক্ষার কৌশল। ক্যারাটের অর্থ খালি হাত আর কুংফু খালি হাতেও হতে পারে আবার হাতিয়ার ব্যবহার করেও হতে পারে। মার্শাল আর্টের যত ধরন আছে তার মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও ভয়ঙ্কর শাওলিন কুংফু।
আর এই ভয়ঙ্কর শাওলিন কুংফুর যাত্রা শুরু হয়েছিল এক ভারতীয় সন্ন্যাসী বুদ্ধভদ্রের হাত ধরে। ভারত থেকে চীনে ধর্মপ্রচার করতে গিয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি; এমন কি তৎকালীন সম্রাট জিয়া ওয়েনও তাঁর গুণমুগ্ধ ছিলেন। তাই বুদ্ধভদ্রকে স্থায়ীভাবে চীনে রাখতে তিনি ৪৭৭ খ্রিস্টাব্দে সং পর্বতমালায় একটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন, যা বিশ্বে শাওলিন টেম্পল নামেই পরিচিত।
এই মঠ প্রতিষ্ঠার পর বুদ্ধভদ্র ঈশ্বর সাধনার পাশাপাশি মানসিক এবং শারীরিক শক্তি সাধনার প্রয়োজন অনুভব করেন। তখন তিনি তার দুই প্রধান শিষ্য হুই গুণ এবং সেঙ চাও এর সহায়তায় ভারতীয় মার্শাল আর্টের সাথে চাইনিজ মার্শাল আর্টের মিশেলে জন্ম দেন এই শাওলিন কুংফুর। সেই থেকেই শাওলিন বৌদ্ধমঠ হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী মার্শাল আর্ট স্কুল হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে।
শাওলিন মন্দিরে ৪০০ জন বৌদ্ধ ভিক্ষু বসবাস করেন, এদের মধ্যে ১০০ জন শিক্ষর্থী। এই শিক্ষার্থীদের কাছে কুংফু শুধু সমর বিদ্যা নয় আত্মিক সাধনা। তবে প্রশিক্ষণের সাথে বৌদ্ধ ধর্মের সম্যক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। এই মঠের শুরুর কয়েকশো বছর সন্ন্যাসীদের ১০০০টি কুং-ফু শৈলী অভ্যাস করতে হতো।
পরে তার থেকে সেরা ১০০টি এবং এখন সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ১৮টি শৈলী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। নতুন শিক্ষার্থীদের প্রথমেই পেশী ও হাড় শক্ত করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রতিদিন ভোর ৪টে থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলে প্রশিক্ষণ। বাহ্যিক কাঠামোর সাথে শরীরের ভিতরকেও শক্তিশালী করে গড়ে তোলার জন্য মেডিটেশন বা ধ্যান শিক্ষার এক বিশেষ অঙ্গ।
১৯৭৮ সালে হংকং থেকে শাওলিন টেম্পলের এই প্রশিক্ষণ নিয়ে কিছু চলচিত্র প্রকাশের পর সারা বিশ্বে এর জন্যপ্রিয়তা বাড়ে। তখন থেকে প্রতি বছর এই শাওলিন টেম্পলে দেশ-বিদেশ থেকে শিক্ষার্থী কুংফু শিখতে আসে। এখনো পর্যটকদের আগ্রহ নিরসনের জন্য আছে কুং-ফুর প্রশিক্ষণ দেখার ব্যবস্থা। ঘুরে দেখতে পারেন তাদের মেডিটেশন রুম, ঐতিহাসিক চিকিৎসা কেন্দ্র সহ গোটা মঠ, দেখা মিলবে বুদ্ধভদ্রের। রেস্তোয় ভর দিয়ে একবার ঘুরে আসতেই পারেন, এক ভারতীয়র এমন এক কীর্তি দেখতে মন্দ লাগবে না, মন প্রশান্ত হবে।