আমি সামান্য মানুষ, জীবনে অনেক জিনিস এড়িয়ে চলেছি। তাই মরবার পরেও আমার দেহটা যেন তেমনি নীরবে, একটু ভদ্রতার সঙ্গে, সামান্য বেশে, বেশ একটু নির্লিপ্তির সঙ্গে পুড়ে যেতে পারে।-এই কথা বলেই পঞ্চভূতে মিশেছিলেন শম্ভু মিত্র। নবনাট্যের জনক তিনি। তাঁর উচ্চারণ যেন শব্দ ব্রহ্ম। এক একটা শব্দ যেন এক একটা থিয়েটার।
বাংলা থিয়েটারের অন্যতম প্রবাদপুরুষ শম্ভু মিত্রর জন্ম ১৯১৫ সালের ২২ অগস্ট কলকাতার ডোভার রোডে। আজকের দিনেই। বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকেই শম্ভু মিত্রর পড়াশোনার শুরু। সেই সময় থেকেই অভিনয় ও আবৃত্তির আগ্রহের শুরু। ১৯৩১ সালে শম্ভু প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। স্কুল পেরিয়ে শম্ভু মিত্র ভর্তি হয়েছিলেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কলেজ ছেড়ে দিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, বেছে নিলেন আত্মশিক্ষার জীবন। লক্ষ্ণৌ, এলাহাবাদ মিলিয়ে চলল শরীর এবং স্বরের চর্চা। লাইব্রেরিতে পড়ে থাকতেন। একদিন সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরছেন। হঠাৎ করেই শুনলেন আলমগীর নাটকের রেকর্ড বাজছে। সেদিনই বুঝলেন নাটক ছাড়া তার আর গতি নেই। তাঁর নিজের কথায়- 'মনে হল যেন শ্যামের বাঁশি বাজল। নাটক ছাড়া আমার গত্যন্তর নেই।'
১৯৩৬-৩৭ সালে শম্ভু মিত্র কলকাতায় ফিরলেন। জ্যোতিনাথদার হাত ধরেই শম্ভু মিত্র হয়ে ওঠার শুরু। থিয়েটারের প্রথম দিকের কথা তিনি নিজেই বলে গিয়েছেন। তাঁর নিজের কথায়, "গিয়ে দেখি কোথায় সেই কল্পনার থিয়েটার! একটা পার্ট ধরিয়ে দিলে, এতটুকু একটা কাগজের মধ্যে খুদে খুদে অক্ষরে লেখা। বলল, কাল সন্ধেবেলায় এটা অভিনয় করবেন।" এইভাবেই যাত্রা আরম্ভ। ১৯৩৯-সালে শম্ভু মিত্র রঙমহল থিয়েটারে যুক্ত হলেন। রঙমহল থিয়েটারেই গুরু মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য অর্থাৎ শম্ভুর মহর্ষির সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা। কয়েকটি পুরনো নাটকের পর তিনটি নতুন নাটক মালা রায়, রত্নদীপ এবং ঘূর্ণি নাটকে অভিনয় করলেন। বন্ধ হল রঙমহল। প্রখ্যাত অভিনেতা ভূমেন রায় মিনার্ভা থিয়েটারে নিয়ে এলেন শম্ভু মিত্রকে। সেখানেই বেশিদিন থাকলেন না। নাট্যনিকেতনে এলেন। তাও একদিন লাটে উঠল। শিশির ভাদুড়ীর হাতে শ্রীরঙ্গম নাম নিয়ে নতুন করে পথ চলা শুরু হল।
কলকাতার রঙ্গালয়ের পরিবেশ তাঁর কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল। ১৯৪০-৪১ সালে শ্রীরঙ্গম ছেড়ে কালীপ্রসাদ ঘোষ বি এস সি-র টুরিং কোম্পানিতে যোগ দিলেন, কিন্তু এখানেও বেশি দিন থাকেননি। ততদিনে বিশ্বযুদ্ধ, ফ্যাসিবাদ, মন্বন্তর, দাঙ্গা, স্বাধীনতার লড়াই চল্লিশের দশক উত্তাল। অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট রাইটার্স অ্যান্ড আর্টিস্টস অ্যাসোসিয়েশনের থেকেই গণনাট্য সংঘের জন্মক্ষণ সেটা। ২৬ বছরের যুবক শম্ভু তাঁর প্রথম নাটক উলুখাগড়া, শ্রীসঞ্জীব নামে লিখে ফেললেন। ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের ডাক পেলেন। গণনাট্য সংঘই শম্ভু মিত্রকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দিল। শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় নবান্ন নাটক বাংলা নাটকের ইতিহাসে নবনাট্য আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রর মধুবংশীর গলি শম্ভু মিত্রের কণ্ঠে, গণনাট্য আন্দোলনের ভাষা হয়ে উঠেছিল। নাটকের সূত্র ধরেই তৃপ্তি মিত্রের সঙ্গে তার পরিচয় এবং বিয়ে। ছবির কাজও এই সময়টাতে করতে শুরু করলেন তারা। ১৯৪৮ সালে শম্ভু মিত্র গণনাট্য ও ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। অনেকেই বেরিয়ে এসেছিলেন। এই সময় বহুরূপীর জন্ম। একে একে মঞ্চস্থ হতে শুরু হল পথিক, উলুখাগড়া, ছেঁড়া তার, বিভাব। ১৯৫২-তে দশচক্র ১৯৫৪-য় রক্তকরবী। পুতুলখেলা, মুক্তধারা, বিসর্জন, বাকি ইতিহাস পাগলা ঘোড়া, চোপ আদালত চলছে আজও এসব ইতিহাস হয়ে রয়েছে। শম্ভু মিত্র, অমিত মৈত্র ও চিত্রগ্রাহক দেওজীভাই পাদিহার তৈরি করলেন চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা। চলচ্চিত্র প্রয়াস সংস্থা। এই সংস্থা শুভ বিবাহ, মাণিক, পান্নার মতো ছবি তৈরি করেছিল। ধরতী কে লাল, একদিন রাত্রে, জাগতে রহো মতো ছবি পরিচালক শম্ভু মিত্রকে চিনিয়ে দেয়।
১৯৬৮ সালে জাতীয় নাট্যমঞ্চ গড়ার তাদিগেই মুদ্রারাক্ষস ও তুঘলকের মতো নাটক করেছিলেন। সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। বহুরূপীতেও ভাঙন ধরল। ১৯৭৮ সালের ১৬ জুন বহুরূপীর প্রযোজনায় পুতুলখেলা নাটকে শম্ভু মিত্রকে শেষ বারের জন্য মঞ্চে দেখা গিয়েছিল। এর পর আর বহুরূপীর দপ্তরে তাঁকে দেখা যায়নি। অন্য নাট্যগোষ্ঠীর প্রযোজনায় মঞ্চে এসেছেন কয়েক বার। ১৯৭৮ সালের ১৫ অগস্ট অ্যাকাডেমিতে শম্ভু মিত্র পাঠ করেন চাঁদ বণিকের পালা। অনেকেই এই নাটকটিকে তাঁর আত্মজীবনী বলে মনে করেন। ১৯৮০ সালের ১৮ নভেম্বর গ্যালিলি গ্যালিলিও নাটকে নামভূমিকায় শেষ বারের মতো তিনি মঞ্চে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি আজও ফিনিক্স। বাংলা নাটককে দুটো ডানা দিয়েছিলেন শম্ভু মিত্র। বারবার পুড়েছে, ছাই হয়েছেন, আবার সেই ছাই থেকেই পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। কথায় বলে ভিত ভাল হলেই নির্মাণ ভাল হয়। বাংলা নাটকের এক সত্যিকারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থপতি হিসেবে শম্ভু মিত্র আজীবন ইতিহাসের পাতায় থেকে যাবেন।