সতীপীঠঃ কাশীর পঞ্চসাগরে রয়েছেন বিঘ্ননাশিনী রক্ষাকারিণী ‘মা বারাহী’

উত্তর প্রদেশের গঙ্গাতীরের মহান তীর্থ কাশী। সেখানে যে সতীপীঠ রয়েছে, সেখানে দেবীরূপে বিরাজ করছেন মা বিশালাক্ষী। তাঁর ওপর রয়েছে এই তীর্থটিকে সুচারুভাবে পালনের ভার। তবে এই তীর্থের ভার শুধু একা তাঁর ওপরই নেই। রয়েছে আরও একজনের ওপর। তাই শুধুমাত্র একটি সতীপীঠ এই পুণ্যভূমিতে বিরাজ করছে না, এই একই ভূমিতে রয়েছে আরও একটি সতীপীঠ। মা বিশালাক্ষীর কথা আগে একদিন লিখেছি, আজ লিখব এই ‘অন্য সতীপীঠটির’ কথা। কাশীর মানমন্দির ঘাটের নিকটেই ‘পঞ্চসাগর’ নামক স্থান। সেখানেই এই সতীপীঠটির অবস্থান। মূর্তিমতী দেবীর নাম, ‘মা বারাহী’। ‘পীঠনির্ণয়’ তন্ত্রগ্রন্থে দেবী ও তাঁর ভৈরব এবং পীঠস্থান সম্পর্কে স্পষ্টই বলা হয়েছেঃ

‘অধোদন্ত মহারুদ্রো বারাহী পঞ্চসাগরে’।

শ্লোকাংশটির অর্থঃ বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হয়ে পঞ্চসাগরে দেবী সতীর নীচের পাটি ও দাঁত পতিত হয়েছিল। এই পীঠে দেবীর নাম ‘বারাহী’; তাঁর ভৈরবের নাম ‘মহারুদ্র’।

আর যে-সমস্ত সতীপীঠ রয়েছে, তাতে যে-সব দেবীমূর্তি বিরাজ করছেন; তাঁদের সকলের চেয়ে আলাদা দেবী বারাহী। ধর্মে, মর্মে, কর্মে, রূপে, আকারে, উদ্দেশ্যে সবেতেই তিনি আলাদা। কিন্তু কীভাবে? সেই ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার জন্য প্রথমেই বলে নিই দেবীর রূপের কথা। দেবীর মুখমণ্ডল বরাহের মতো। শিরে শোভায়মান আধখানা চন্দ্রমা। দেবীর চারটি করে মোট আটটি হাত। সেই হাত সমূহে শঙ্খ, চক্র, অন্যান্য অস্ত্রমালা ও বরাভয় নিয়ে বিরাজ করছেন দেবী। অর্থাৎ অষ্টভুজের সজ্জায় দেবী জগতের পালন ও রক্ষার জন্য যে প্রস্তুত; তা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে। ভক্তদের বিশ্বাস, দেবীর ওপরই রয়েছে রাত্রিকালে মহাতীর্থ কাশীর রক্ষার ভার, পালনের ভার, সমৃদ্ধির ভার। কাশীর কালভৈরবকে বলা হয়, ‘কাশীর কোটাল’। তাঁর ওপর রয়েছে দিনের বেলায় কাশীর সুরক্ষার ভার। আর দেবী বারাহীর ওপর রয়েছে রাত্রিকালীন সুরক্ষার ভার। দেবী সারাটি রাত তাই সজাগ থেকে পাহারা দেন; আর দিনের বেলা বিশ্রাম নেন। সেই জন্য ব্রাহ্মমুহূর্তেই দেবীর পুজো করতে হয়। তারপরই দেবীর বিশ্রামের সময় হয়ে যায়। পুজো ও দর্শনের সময় সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে সকাল সাড়ে সাতটা। এই দু’ঘন্টা শুধুমাত্র মন্দির খোলা থাকে। আর সমস্ত দিনমান মন্দির বন্ধ থাকে।

দেবীর যেখানে বিরাজ করছেন, সেই গর্ভগৃহে একমাত্র প্রবেশ করতে পারেন পূজারী একা। ভক্তদের দেবীর কাছে যাওয়ার বিধান নেই। দেবী যেহেতু সারারাত নিরলস নিরন্তর কাশী পরিক্রমা করেছেন সকলের সুরক্ষার জন্য, তাই তাঁর দেহে-মনে রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি। এই অবস্থায় তাঁর কাছে ভিড় করা বা দিনের আলোর যথেচ্ছ প্রবেশ ঘটতে দেওয়া; তাঁর বিরক্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাই দেবীর শান্তি ও আরামের বিঘ্ন না-ঘটিয়ে একাকী পূজারী প্রত্যূষে দেবীকে পুজো করেন। সেই সময় তিনি স্নান করে এসে প্রথমে দেবীকে স্নান করান। তারপর দেবীকে জিজ্ঞেস করেন, এ-দিন দেবীর কোন বস্ত্র পরার ইচ্ছে। তারপর দেবীর ইঙ্গিত বুঝে দেবীর ইপ্সিত কাপড় পরিয়ে পুজো করেন। এমন ধারাতেই চলে দেবীর নিত্য অর্চনা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে দেবীর কাছে ভিড় করা যায় না বা পূজারী ছাড়া আর কেউ দেবীর কাছে যেতে পারেন না বলা হচ্ছে, তাহলে দেবীকে ভক্তেরা দর্শন করেন কেমন করে? তারও উপায় আছে। আসলে, মন্দিরের গর্ভগৃহের বাইরে দুটি ছিদ্র আছে। একটিতে চোখ রাখলে দেবীর মুখমণ্ডল দেখা যায়; অন্যটিতে চোখ রাখলে দেখা যায় দেবীর পাদপদ্ম। এভাবে দেবীকে যারা দর্শন করেছেন, তাঁদের কাছে শোনা যায়, গর্ভগৃহের ভেতরে প্রদীপের আলোয় দেবীর অঙ্গ থেকে এক অদ্ভুত ছটা বিচ্ছুরিত হয়; ক্ষণকালের জন্য ছিদ্রপথ দিয়ে সেই ছটায় দেবীকে দেখে মনের মধ্যে এক অপূর্ব ভাবের উদয় হয়। অপূর্ব এক রোমাঞ্চ জাগে ভক্তজনের সারা অঙ্গে।

পুরাণ মতে, দেবী বারাহী হলেন সপ্ত বা অষ্টমাতৃকার অন্যতমা। দেবী চণ্ডিকা বা দুর্গা স্বয়ং তাঁর স্রষ্টা। আসলে, দেবীরই অন্তরশক্তির এক এক রূপ হলেন এই মাতৃকারা। ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণ’-এর শুম্ভ-নিশুম্ভ বধ অংশে এই মাতৃকাদের উৎপত্তির সুন্দর বিবরণ আছে। শুম্ভ ও নিশুম্ভের সঙ্গে যুদ্ধের আগে দেবীর সম্মুখ-সময় হয় তাদের সেনাপতি রক্তবীজের সাথে। রক্তবীজ এমন এক অসুর, যার রক্তের এক ফোঁটা মাটিতে পড়লে, তা থেকে লক্ষ লক্ষ অসুরের জন্ম হয়। সেই রক্তবীজের রক্ত থেকে যখন লক্ষ লক্ষ অসুর জন্ম নিয়ে দেবীর সঙ্গে লড়াই করতে প্রবৃত্ত হল, তখন দেবী আপন অঙ্গ থেকে সৃষ্টি করলেন ওই সপ্ত বা অষ্টমাতৃকাকে। এই মাতৃকারা হলেন বিপুল ও অপরাজেয় শক্তির আধার। তাঁরা রণংদেহি মূর্তিতে আবির্ভূতা হয়ে প্রবল পরাক্রমে অসুরদের নিমেষে নিঃশেষ করে ফেললেন যুদ্ধে। তাঁদের সহায়তায় দেবীও কালক্রমে রক্তবীজকে বিনষ্ট করতে সমর্থ হলেন। দেবী ও মাতৃকাদের সেই সমবেত পরাক্রম দেখে শুম্ভ ও নিশুম্ভ ভীত হল। তাই তারা যখন দেবীর সঙ্গে যুদ্ধ করত এল, তখন দেবীকে বলল যে, তারা একা দেবীর সঙ্গে লড়তে চায়। তখন দেবী সপ্ত বা অষ্টমাতৃকাকে নিজের মধ্যে সংবরণ করলেন। এই ঘটনা থেকে এটাই স্পষ্ট হয় যে, দেবী বারাহী নিছক সপ্ত বা অষ্টমাতৃকার অন্যতমা নন, তিনি সাক্ষাৎ দেবীরই এক রূপ। তা না-হলে দেবী তাঁকে বা তাঁদের নিজের মধ্যে সংবরণ করতেন না। এই কারণেই কাশীর সতীপীঠ তো বটেই, দেশের নানান শক্তিমন্দিরে আদ্যাশক্তির প্রতিভূ হয়েই তিনি পূজিতা হচ্ছেন।

আমরা জানি যে, বিষ্ণু বরাহ অবতারে পৃথিবীকে অর্থাৎ সৃষ্টিকে রক্ষা করেছিলেন। আমরা এও জানি যে, হিন্দুধর্মের মধ্যে পাঁচটি উপাসকসম্প্রদায়ের বিরোধ সুপ্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছিল। এই পাঁচটি সম্প্রদায় হলঃ শাক্ত, শৈব, সৌর, গাণপত্য ও বৈষ্ণব। তার মধ্যে সৌর ও গাণপত্য—এই দুই সম্প্রদায়ের প্রভাব এখন আর তেমন নেই; কিন্তু শাক্ত ও বৈষ্ণবের বিরোধ এখনও আমরা দেখতে পাই। রঙে, আচারে ও চর্যায় সেই বিরোধ অত্যন্ত স্পষ্ট। শাক্তদের কাছে লাল রঙ প্রিয়, কিন্তু বৈষ্ণবের কাছে তা ব্রাত্য। এছাড়া আমিষ ও নিরামিষের দ্বন্দ্ব তো আছেই। এগুলো খুব মোটাদাগের বৈষম্য। অনেক সূক্ষ্ম ও দার্শনিক বিরোধ উভয়ের মধ্যে আছে। সেই বিরোধ মেটানোর একটা নিরন্তর প্রয়াস আমরা পুরাণের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই। এই দেবী বারাহীর ক্ষেত্রেও সেটা চোখে পড়ে। দেবীর চেহারা বিষ্ণুর বরাহ অবতারের মতো। একটি পুরাণে তো এও বলা হয়েছে যে, স্বয়ং শিব বিষ্ণুর বরাহ অবতারকেই দেবীতে রূপান্তরিত করেন। দেবীর হাতে বিষ্ণুর শঙ্খ, চক্র; মাথায় শিবের ভাঙা-চাঁদ; এছাড়া এই অষ্টভুজা দেবীর অন্যান্য হাতে গণেশ ও সূর্যের অস্ত্রমালা। দেবী ভৈরব-শিবের মতোই রক্ষকের ভূমিকা পালন করেন; বিষ্ণুর মতো পালনকর্তার ভূমিকাও সম্পন্ন করেন। ফলে, দেবী বারাহী শুধু শাক্তদের দেবী হয়েই থেকে যাননি; তাঁর কাশীর মন্দিরে শৈব, বৈষ্ণব, তন্ত্রযোগী প্রভৃতি হিন্দুধর্মের সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষ নিত্যদিন পুজো দিতে আসেন; দেবীকে দর্শন করে ধন্য হতে আসেন।...

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...