সে একটা সময় ছিল বটে, যখন বলিউডে বঙ্গসন্তানরাই হয়ে উঠেছিলেন ভারতীয় সিনেমার ব্যাটনধারী। বিমল রায়, সত্যেন বোস, ফনী মজুমদারদের ধারা বেয়ে চিত্রপরিচালনায় গৌরবের সেই ইতিহাসে যাঁর অবদান অনস্বীকার্য, তিনি হলেন পরিচালক-প্রযোজক শক্তি সামন্ত।
চিত্রপরিচালক নয়, শক্তি ভেবেছিলেন অভিনেতা তথা নায়ক হবেন—তাও আবার বলিউডের ছবিতে। তবে সে তো অনেক পরের কথা। একদম প্রথমে ভেবেছিলেন যে, আর-পাঁচজনের মতো আদর্শ শিক্ষক হবেন। সে একেবারে ছোটবেলার ভাবনা। আসলে বর্ধমানের গ্রামে জন্ম নেওয়া এই মানুষটির কাছে তখন ‘হয়ে ওঠা’র আদর্শ বলতে চোখের সামনে শিক্ষকতাই ছিল বেশিরকমের পরিচিত পেশা।
তবে সেই গ্রামের গণ্ডি ছেড়ে বেরোতে দেরি হয়নি। কাকা চাকরি করতেন উত্তর প্রদেশের বাদাউঁ শহরে। গ্রামের স্কুলে পড়াশুনো শেষ হলে পরে কিশোর শক্তিকে সেখানে তাঁর কাছেই পাঠিয়ে দেওয়া হল মাধ্যমিক স্তরের পড়াশুনোর জন্য। কাকার ছিল বদলির চাকরি। ফলে, বাদাউঁ থেকে দেরাদুন, দেরাদুন থেকে কলকাতায় এসে শেষমেশ থিতু হলেন। এবং তাঁর সঙ্গে পরিক্রমা শেষে শক্তিও এসে পড়লেন কলকাতায়। ভর্তি হলেন স্নাতকস্তরে।
কলকাতা সিনেমার শহর, থিয়েটারের শহর। সিনেমায় তো আর সবার সুযোগ হয় না। তবে শক্তি এসে দেখলেন যে, তাঁর সহপাঠীদের অনেকেই অখ্যাত-প্রখ্যাত কোন-না-কোন নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত নাটক দেখা, আলোচনা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে ক্রমে এই মাধ্যমটির প্রতি তাঁর ভালোবাসা তৈরি হল। ইচ্ছে হল নাট্যদলে যোগ দিতে। মনের মধ্যে সাধ হল অভিনেতা হওয়ার। কাজেই যোগ দিলেন অভিনেতা হিসেবে।
শুরু হল আর এক জীবন। নাটকের রিহার্সাল শেষ হতে হতে রাত্তির হয়। কাজেই বাড়ি ফিরতে রাত হতে লাগল নিত্য। ফেরার সময়ের কোন ঠিকঠিকানা রইল না। এই অনিয়ম কাকার একেবারেই সহ্য হল না। তিনি মানুষ করেছেন, বকাঝকা তাঁর এক্তিয়ারের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু বিরক্তির চোটে খেয়াল রইল না যে, শক্তি বড় হয়েছেন। ফলে মাত্রাছাড়া বকুনিতে শক্তির ভারি অভিমান হল। তিনি কাকার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
শক্তি পথে নামলেন পথ তৈরি করবেন বলে। সেই পথ তাঁকে নিয়ে গেল আরেক অভিনয়মুখর শহরের দিকে। যেখানে স্বজন নেই, শাসন নেই, সেখানে। উঠে পড়লেন ট্রেনে, পৌঁছে গেলেন বম্বে। পৌঁছনো যত সহজ হল, শিকড় গাড়া তত সহজে হল না। অতীব সস্তার হোটেলে উঠে স্টুডিয়োতে স্টুডিয়োতে চক্কর কাটা শুরু হল। নাহ, তাতে শুধুই পকেটের রেস্ত কমতে লাগল, সুরাহা কিছুই হল না।
শক্তি দেখলেন যে, এই পরিস্থিতিতে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে গেলে বিকল্প পেশার বড় প্রয়োজন। তাতে ভর রেখেই স্বপ্নের ঘুড়ি ওড়াতে হবে। নইলে এই বিভূঁইয়ে বেঁচে থাকাই অসম্ভব। শুরু হল শুধুমাত্র নিজেকে টিকিয়ে রাখার লড়াই।
লড়াই সফল হল। কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে দিতে তিনি একদিন বম্বে থেকে পৌঁছলেন ডাপোলি-তে। সেখানকার এক অ্যাংলো হাইস্কুলে পেলেন শিক্ষকতার চাকরি। এরপরই শুরু হল তাঁর স্বপ্নপথের সংগ্রামী সফর।
ডাপোলি থেকে জলপথে বম্বে আসতে লাগে ঘণ্টাখানেক। প্রতি শুক্রবার ক্লাস সেরে শক্তি সেখান থেকে বম্বে আসেন। উইক-এন্ডটুকু সুযোগের আশায় স্টুডিয়োতে স্টুডিয়োতে প্রোডিউসারের কাছে হত্যে দিয়ে কাটান। তারপর আবার সোমবারে পাড়ি দেন শিক্ষকতার পেশায়। এই রুটিন বেশ কিছুকাল চলল।
তারই মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে একদিন তাঁর আলাপ হয়ে গেল অশোক কুমারের সঙ্গে। অশোক কুমার তখন স্বনামধন্য নায়ক তো বটেনই, বোম্বে টকিজের সঙ্গেও বেশ ভালোরকমভাবে জড়িয়ে। শক্তি একে বাঙালি, তায় শিক্ষিত ও সিনেমায় কাজের জন্য পাগল। ফলে, শক্তিকে দেখে তাঁর ভাল লাগল।
তখন তিনি শক্তিকে বুঝিয়ে বললেন যে, দেখুন, সিনেমায় অভিনয় আপনি করতেই পারেন, কিন্তু তার আগে মাধ্যমটাকে বুঝে নিন। সুবিধে হবে। আপনি বরং আমাদের এখানে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে জয়েন করুন। বড় বড় পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাবেন, শিখে নিন।
অশোক কুমারের যুক্তি শক্তির বেশ মনে ধরল। তিনি রাজি হয়ে গেলেন। তখন অশোক কুমার বললেন, দেখুন, আপনি তো নভিশ। তাই মাইনে দিতে পারব না। চায়ের বেলা চা পাবেন; আর দুপুরের খাবার পাবেন। চলবে?
শক্তি চাঁদ চেয়েছিলেন, পেয়ে গেছেন। আর কী চাই! হেসে বললেন, উঁহু, দৌড়বে!
তাঁর কথায় অশোক কুমারও হেসে ফেললেন।
দুই যোগ্য মানুষের পারস্পরিক বোঝাপড়া আর সহযোগিতার মধ্য দিয়ে এভাবেই শুরু হয়েছিল বন্ধুত্ব, যা বজায় ছিল আজীবন। পরবর্তীকালে যে-ছবিতে অশোক কুমারের অভিনয় কাজে লাগানোর প্রয়োজন হয়েছে, সেই ছবিতেই শক্তি কাজে লাগিয়েছেন তাঁর অভিনয়কে। যখন প্রয়োজন হয়নি, হয়নি। এ নিয়ে কোন অভিমানের জায়গা তৈরি হয়নি কোনওদিন। এমনই ছিল তাঁদের বন্ধুত্ব।
যাই হোক, বম্বে টকিজে যোগ দিয়ে ফণী মজুমদার প্রমুখ বড় বড় পরিচালকদের কাছে অভিনয় ও পরিচালনার খুঁটিনাটি শেখার পাশাপাশি আর একটা কাজের দায়িত্ব পেলেন শক্তি। তা হল বাঙালি পরিচালকদের লেখা বাংলা স্ক্রিপ্ট হিন্দিতে অনুবাদের কাজ। কেননা, উত্তর প্রদেশে পড়াশুনো করা শক্তির হিন্দি বেশ ভালোই জানা ছিল। বলতে কী, এই কাজটা করতে গিয়ে তাঁর দারুণ লাভ হল, স্ক্রিপ্ট লেখার কলাকৌশলটিও আয়ত্ত হয়ে গেল।
পাশাপাশি তাঁর পূর্বের স্বপ্নও একটু একটু করে পূরণ হতে লাগল। কেননা, বম্বে টকিজের সিনেমায় ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ তিনি পেতে লাগলেন। কিন্তু এই সময়ই বড় বড় পরিচালকের কাজ চোখের সামনে দেখতে দেখতে তাঁর স্বপ্নের বাঁকবদল ঘতে গেল। ইচ্ছে জাগল চিত্রপরিচালক হয়ে ওঠার। সুযোগও মিলে গেল।
১৯৫৪-তে পর পর দু’খানা ছবি পরিচালনা করে ফেললেন। তার মধ্যে করণ দেওয়ানকে নায়ক করে নির্মিত ‘বহু’ ছবিটি মুক্তি পেল ১৯৫৫ সালে। আর অশোক কুমারকে নায়ক করে নির্মিত ‘ইন্সপেক্টর’ ছবিটি মুক্তি পেল ১৯৫৬ সালে। দুটো ছবিই বেশ রমরম করে চলল।
শক্তি বুঝলেন, তিনি দর্শকের পালস ধরে ফেলেছেন। আর কী! এই বার তাঁর ইচ্ছে জাগল স্টুডিওর চাকরিবাকরি ছেড়ে নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা তৈরি করে স্বাধীনভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণের। অচিরেই গড়ে উঠল তাঁর নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা, ‘শক্তি ফিলমস’। নিজের ব্যানারে বানালেন প্রথম ছবি, সেখানে নায়ক অশোক কুমার। ১৯৫৮ সালে নির্মিত এই ছবির নাম, ‘হাওড়া ব্রিজ’। এই ছবিটিও অসম্ভব সাফল্যলাভ করল।
এভাবে ছবি তৈরি করতে করতেই শক্তি বুঝলেন যে, নির্মাণে পুরনো ঘরানার ন্যারেশান আর চলবে না, নতুন কিছু করতে হবে, দর্শককে ঝাঁকুনি দিতে হবে। ফলে, পরিচালনার ধারা, প্রেজেন্টেশনের খোলনলচে আমূল বদলে ফেলে ১৯৬২ তে নির্মাণ করলেন ‘চায়না টাউন’ ছবিটি। কেন্দ্রীয় চরিত্রে রইলেন শাম্মী কাপুর, শাকিলা আর হেলেন। অসাধারণ গল্প, দুর্ধর্ষ পরিচালনা এবং প্রাণোচ্ছল সঙ্গীত সকলের মন কেড়ে নিল।
এই ছবিতে মহম্মদ রফির গাওয়া ‘বার বার দেখো’ গানটি শাম্মী কাপুরের লিপ থেকে আপামরের লিপের গান হয়ে উঠল। জায়গা করে নিল সর্বকালের সেরা ও জনপ্রিয় গানের তালিকায়। আর শাম্মী কাপুরও শক্তির সাহচর্যে এই ছবি থেকে তাঁর নিজস্ব ম্যানারিজম তৈরি করে দর্শকহৃদয়ে আলাদা একটি আসন তৈরি করে নিলেন।
আবার ঝাঁকুনি। শাম্মী কাপুরকে নায়ক করে নায়িকা হিসেবে নিয়ে এলেন শর্মিলা ঠাকুরকে। সত্যজিৎ চিত্রিত লাজুক-ভীরু বাঙালি শর্মিলাকে তিনি দুই ধাক্কায় ভারতীয় থেকে আন্তর্জাতিক করে তুললেন।
তাঁদের নিয়ে ১৯৬৪-তে ‘কাশ্মীর কি কলি’ ও ১৯৬৭-তে ‘অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস’ নির্মাণ করলেন শক্তি। এই দুটো ছবিই ভারতীয় বাণিজ্যিক সিনেমায় আলোড়ন ফেলে দিল। শঙ্কর-জয়কিসনের সুরের জাদু সকলের মন তো ভরিয়েই দিয়েছিল। তার সঙ্গে শেষের ছবিটি যুক্ত করেছিল একটি বিতর্ক। সেখানে শর্মিলাকে টু-পিস বিকিনিতে দেখা গিয়েছিল। বাণিজ্যিক ছবিতে কোন ভারতীয় সেই প্রথম বিকিনিতে বিগ্রহ হয়ে উঠেছিলেন। একদিকে সেদিন ‘ভারতীয়তা বিপন্ন’ বিতর্কে সে-সময়ের কাগজ সরগরম হয়ে উঠেছিল, আর অন্যদিকে ছবিটি হয়ে উঠেছিল ভারতীয় ছবির ট্রেন্ডসেটার।
শুধু শাম্মী কাপুর নয়, ভারতীয় সিনেমায় রাজেশ খান্নার ইমেজ তৈরিতেও শক্তি সামন্তের বিরাট অবদান। বলা হয়, ভারতের প্রথম সুপারস্টারকে ইন্ট্রোডিউস করেন তিনিই। কেননা, ১৯৬৯ সালে রাজেশ খান্নাকে প্রথম নায়ক চরিত্রে সুযোগ দেন তিনিই। ‘আরাধনা’ ছবিতে। ছবিটি যে শুধু অসম্ভব সাফল্য অর্জন করে তাই নয়, রাজেশ খান্নাকে রাতারাতি স্টার বানিয়ে দেয়।
তারপরই পর পর সতেরটি ‘সুপার হিট’ ছবির নায়ক হিসেবে রাজেশ খান্না রেকর্ড করে ভারতীয় সিনেমার ‘প্রথম সুপারস্টার’-এর মর্যাদা পান। ‘আরাধনা’ ছাড়াও সেই সতেরটি ছবির মধ্যে শক্তির ‘কাটি পতঙ্গ’ (১৯৭০) ও ‘অমর প্রেম’ (১৯৭১) আজও গৌরবের সঙ্গে উজ্জ্বল।
শুধু হিন্দি নয়, বাংলা ছবির জগতেও তাঁর অবদান কম নয়। ‘অমানুষ’ (১৯৭৫), ‘অনুসন্ধান’ (১৯৮১) ও ‘অন্যায় অবিচার’ (১৯৮৫)-এর মতো দ্বিভাষিক ছবির মধ্য দিয়ে বাংলা বাণিজ্যিক ছবির আঙিনায় হিন্দি ছবির ন্যারেশান তিনিই প্রথম নিয়ে আসেন। পরবর্তীকালে সেই ধারাতেই সুখেন দাস, অনুপ সেনগুপ্ত, সুজিত গুহরা সিনেমা পরিচালনা করতে আসেন।
শক্তি সামন্তের স্বপ্ন ছিল বলিউডে নিজস্ব জায়গা করে নেওয়ার। তিনি তা অর্জন করেছিলেন। আর সেটা অর্জন করতে গিয়ে তিনি বাংলা ত্যাগ করেছিলেন। তা সত্ত্বেও বাংলা ও বাঙালিকে তিনি কখনই ভুলে যাননি। সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে, গীতিকার হিসেবে, গায়ক-গায়িকা হিসেবে, অভিনেতা-অভিনেত্রী হিসেবে, কলাকুশলী হিসেবে অসংখ্য বাঙালিকে তিনি তাঁর ছবিতে প্রথম থেকেই সুযোগ দিয়েছেন, ব্যবহার করেছেন। এমনকি তাঁর পরিচালিত শেষ ছবিটিও [‘দেবদাস’, ২০০২] একটি বাংলা ছবি। তাই সর্বভারতীয় তো বটেই, বাংলা সিনেমার ধারা পরিবর্তনের ইতিহাসেও তাঁর অবদান সোনার আখরে লেখা থাকবে…