ফ্রিল্যান্স শিল্পী হিসেবে সারাটা জীবন কাটিয়েছেন। রোজগারের অনিশ্চয়তা থাকলেও, বিষাদ তাঁকে কোনও দিন গ্রাস করতে পারেনি। জন্মেছিলেন হাওড়া জেলার মৌরিগ্রামে। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে অঙ্কে অনার্স নিয়ে পাশ করেছিলেন। লেখাপড়া শেষ করে প্রসাধন তৈরির একটা ছোট কারখানা বাড়িতেই বানিয়ে নিয়েছিলেন। সাবান, আলতা, সিঁদুর তৈরি করে বাড়ি-বাড়ি বিক্রি করতেন। কিন্তু সে ব্যাবসা টেকেনি। এ সময় তাঁর সঙ্গে বিজ্ঞাপন জগতের একটা যোগাযোগ তৈরি হয়। আঁকা, যা ছিল তাঁর শখ, ধীরে ধীরে তাইই হয়ে ওঠে পেশা। তিনি এমন একজন, যাঁর আঁকা ছবি ‘পড়ে’ আমরা বড় হয়েছি। তিনি শৈলনারায়ন চক্রবর্তী ওরফে শৈল চক্রবর্তী।
আঁকা আয়ত্ত করতে তাঁর কোনও শিক্ষাগুরুর প্রয়োজন পড়েনি অথবা পা বাড়াতে হয়নি আর্ট কলেজের পথে। যেটা না থাকলেই নয়, সেই ‘অবজারভেশন’টাই ছিল তুখোড়। তা দিয়েই ১৯৩০-এর দিকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ইলাস্ট্রেশনের কাজ শুরু করেন। শুরুর দিকে ইলাস্ট্রেশনেই জোর দিয়েছিলেন তিনি। সেসময়ে বা তার আগে কমিক ছবির ক্ষেত্রে তাঁর মতো সফল কেউ ছিলেন না।
বাংলায় ‘স্ট্রিপ’ কার্টুনের প্রবর্তকও বলা চলে তাঁকে। একদিকে প্রতুলচন্দ্র লাহিড়ীর ‘খুড়ো’, অন্যদিকে শৈল চক্রবর্তীর ‘লিটল ডাকু’ –এই দু’টিই স্ট্রিপ কার্টুনের অগ্রগামী। টানা ষোল বছর ‘লিটল ডাকু’ অমৃতবাজারে জনপ্রিয়তা বজায় রেখেছিল। শোনা যায়, এই ‘ডাকু’র সঙ্গে তাঁর ছেলে অভিনেতা-সাংসদ-চিত্রশিল্পী চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী’র শৈশব-মুখাবয়বে নাকি বেশ মিল ছিল। নিজের সন্তানদের মধ্যে সুনিপুনভাবে শৈল্পিক সত্ত্বার বীজ বপন করে দিয়েছিলেন শৈশব থেকেই। সে বিষয়ে এক সংবাদপত্রের প্রবন্ধে চিরঞ্জিৎ নিজে লিখেছিলেন, এক একদিন হত আঁকার ওয়ার্কশপ। বাবা ফিঙ্গার পেন্টিং করতে দিতেন আমাদের। পেনসিল, তুলি এ সব নিয়ে আঁকা মোটেই মুখের কথা নয়, তাই বলতেন ও সব নয়, ফিঙ্গার পেন্টিং করো। এটাও ছিল মায়ের জন্য আর এক ঝামেলার দিন। সে দিন মাকে এক হাঁড়ি অ্যারারুটের আঠা বানাতে হত। প্লেটে রং থাকত। সেই রং ওই আঠার সঙ্গে মিশিয়ে, আঙুলে নিয়ে গাছ, ফুল, পাখি আঁকা চলত। সত্যি, বাবার কাছ থেকে কত কী যে শিখেছি!
ছেলেমেয়েদের উপর কখনই রেগে যেতেন না। সর্বদা প্রানবন্ত থাকতেন। চিরঞ্জিৎ শৈশবের আর একটি অভিজ্ঞতার কথাও লিখেছিলেন, যা উল্লেখ না করলেই নয়। তা হল- ছোটবেলায় একদিন একটা ব্লেড দিয়ে বটলের কর্ক কেটে-কেটে একটা মানুষ বানাচ্ছিলেন তিনি। সেটা করতে গিয়ে, হঠাৎ হাত কেটে ফেলেন। রক্ত পড়তে থাকে। তাঁর বাবা তখন সে সব পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে, আবার আঁকতে বসে যান। কেটে যাওয়া আঙুল নিয়ে ছেলের মাথাব্যাথা দেখে তৎক্ষণাৎ বলেন, ‘‘কী হল, ওটা শেষ করবে না? শেষ করো,’’ বলে উনি সেই কর্কটায় কম্পাস দিয়ে ফুটো করে, একটা দেশলাই কাঠি ঢুকিয়ে দেন, যাতে একটা গ্রিপ পাওয়া যায়। আবার ব্লেড দিয়ে কর্কটা কাটতে শুরু করেন ছেলে। এই ছিল একজন প্রকৃত শিল্পীর শৈল্পিক অনুশাসন।
শৈল চক্রবর্তী ছিলেন মনে-প্রানে-কাজে নিপাট রসিক মানুষ, যে কারণে তাঁর সাথে জুড়ে গিয়েছিলেন আর এক বিখ্যাত রসিক ‘চক্কোত্তি’ – শিবরাম। তাঁকে নিয়ে লেখা অথচ শিবরাম থাকবেন না, তাও কি হয়! তাঁর আঁকা শিবরামের চেহারা এখনও সমান সমাদৃত। এ বিষয়ে বেশ মজার মজার ঘটনাও রয়েছে। শৈলবাবু একবার শিবরাম-কে বলেছিলেন, ‘ফটো নেই আপনার? দিন না। আপনার প্রথম পুরুষে লেখা গল্পে সেটা থেকে ছবি করে দেব।’ শিবরাম তো জন্মরসিক, সেদিন দু’মিনিট থমকে তারপর বলেছিলেন, ‘না, আমার কোনো ফটো নেই। কী হবে ফটো নিয়ে? আপনার ছবিতেই আমি থাকব’। তারপর গলা খাটো করে বলেন, ‘তাহলে কোনওদিন বুড়ো হব না।’
একবার শিবরাম চক্রবর্তী-র গল্পের ছবি আঁকতে বসেছেন শৈল চক্রবর্তী। তাঁর আঁকা দেখছেন লেখক। একটা পাখি এঁকে শিল্পী জানতে চাইলেন, পাখাটা কেমন হয়েছে? উত্তর এলো, ‘যেন পাখোয়াজ।’ আর পাখির ল্যাজটা? ‘যেন ল্যাজারাস।’ আর একদিন শিবরাম-এর এক ঘোড়ার গল্পে শৈলবাবু শিবরাম-এর মর্জিমত ঘোড়া এঁকেছেন। শিবরাম-কে দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি বার কয়েক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেন। তারপর একগাল হেসে মন্তব্য করেন, ‘শূন্য মার্গে চলাচল আমার মত স্থুল জীবের পক্ষে তো সম্ভব নয়। কিন্তু এই পক্ষীরাজ আমায় বার বার আকাশে নিয়ে যাবে।’
শিবরামের নানা কাজের পাশাপাশি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা সিরিজের অনেক ছবিই তাঁর আঁকা। সত্যজিৎ রায়ের প্রথম মুদ্রিত গল্প ‘বর্ণান্ধ’-র ছবিও তাঁর আঁকা। পিসি সরকার(সিনিয়র)-এর একটা ইন্টারন্যাশনাল বুলেটিনে ছবি এঁকে দিয়েছিলেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দু’টি গল্পেরও ইলাস্ট্রেশন করেছিলেন, প্রগতি সংহার ও ল্যাবরেটরি। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ভাবনায় কলকাতা পুরসভার লোগোতে এখনও রয়েছে তাঁরই আঁকা ছবি।
দিনরাত এক করে ছবি আঁকতেন, ছবি আঁকতে আঁকতেই আগ্রহ জন্মে লেখালিখিতে। তাঁর লেখা ও আঁকা ছবির বই ‘গাড়ি ঘোড়ার গল্প’, ‘মানুষ এল কোথা হতে’, ‘মুখোশ’, ‘কালো পাখি’ রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পায়। এছাড়াও লিখেছেন, ‘ছড়ার দেশে টুলটুলি’, ‘বেজায় হাসি’, ‘আজব বিজ্ঞান’, ‘চিত্র বুদ্ধজীবন কথা’, ‘বেলুন রাজার দেশে’-সহ প্রায় ২৫টি গ্রন্থ। সুনির্মল বসুর লেখা নিউ থিয়েটার প্রডাকশনের ‘মিচকে পটাশ’ অ্যানিমেশন তাঁরই সৃষ্টি।
সাম্প্রদায়িকতা নিয়েও তাঁর আঁকা কার্টুন রয়েছে। ‘Divide and Rule’, যার মধ্যে অন্যতম। সাহেব শাসকদের নিয়ে এটি এঁকেছিলেন শৈল চক্রবর্তী।
সেসময় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধ সান্যাল, রমেন মল্লিক প্রমুখ গুণীজনদের ‘রবিবাসয়ীয়’ নামে একটি ক্লাব ছিল। তাঁরা মাঝে মাঝে সভা করতে আসতেন শৈল চক্রবর্তীর বাড়িতে। শৈলবাবু সেখানে পাপেট শো করতেন। তাঁকে সমগ্র দেশের মর্ডান পাপেট্রির অগ্রণী বলা চলে। মন্দার মল্লিক এবং তিনি এ দেশে প্রথম ‘চ্যাঙা ব্যাঙা’ নামে একটি কার্টুন ফিল্ম বানিয়েছিলেন। শুরুতে যেমন ইলাস্ট্রেশন-এ জোর দিয়েছিলেন, তেমনই শেষের দিকে মন দিয়ে কাজ করতে চাইতেন পাপেট্রি নিয়ে। নিজেই বানাতেন পেপিয়ামেশি পুতুল(কাগজের পুতুল)। বাজনার সঙ্গে তালমিলিয়ে পুতুল নাচের প্রবর্তন শৈল চক্রবর্তীর হাত ধরেই হয়। ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয় তাঁর পাপেট্রি। গড়ে তোলেন নিজের দল ‘পুতুল রঙ্গম’।
জীবনের শেষ ধাপে পৌঁছে আমেরিকার নিউ জার্সি ও ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরোতে তাঁর আঁকা ছবির একক প্রদর্শনী হয়। সেখানে সমস্ত ছবিই বিক্রি হয়ে যায়। তার কয়েক বছর পরই, ১৯৮৯ সালে চলে যান শৈল চক্রবর্তী। এত বড় মাপের শিল্পী তবু আজ তাঁর উল্লেখ, তাঁকে নিয়ে চর্চা এসব যেন বড্ড ধূসর।