সেলিম দুরানিকে বাদ দিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাস সম্পূর্ণ হয় না। সেলিম দুরানিকে বাদ দিয়ে ইডেন-ইতিহাসও অসমাপ্ত থাকে। সেলিম দুরানির হাত ধরে অর্ধশতাব্দী আগে ইডেনে প্রথম বার ভারতকে টেস্ট জিততে দেখা, জিততে দেখা ইংরেজদের হারিয়ে। '৬১-'৬২-তে। ইডেন বলতে সেলিম দুরানি বোঝেন, তাঁর সামনে ক্রিকেটের দরজা খুলে যাওয়া। নইলে ভারতের পূর্বতন 'প্রিন্স'-কে নাকি ইঞ্জিন ড্রাইভার হতে হত। একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে দর্শকদের চাহিদাকে সম্মান জানিয়ে ছক্কা হাঁকাতেন।
১৯৫৩-৫৪ মরসুম থেকে ১৯৭৭-৭৮ মরসুম পর্যন্ত সেলিম দুরাণী'র প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন চলমান ছিল। প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে ৩৩.৩৭ গড়ে ৮,৫৪৫ রান করেন। তার মধ্যে, ১৪টি সেঞ্চুরি ইনিংস ছিল তাঁর। কখনো দর্শকেরা ছক্কার দাবী জানালে তিনি তা করার চেষ্টা চালাতেন।সমগ্র খেলোয়াড়ী জীবনে ২৯ টেস্টে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। ১ ডিসেম্বর, ১৯৬০ তারিখে মুম্বইয়ে সফরকারী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে সেলিম দুরাণী'র। ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৩ তারিখে সফরকারী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সর্বশেষ টেস্টে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৬১-৬২ মরসুমমে ইংরেজ ক্রিকেট দল ভারতে আসে। ওই সিরিজ জয়ের অন্যতম নায়ক ছিলে ন তিনি। কলকাতায় ৮ উইকেট ও চেন্নাইয়ে ১০ উইকেট নিয়ে ভারত দলকে জয়ী করেন। এছাড়াও, এক দশক পর পোর্ট অব স্পেনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ক্লাইভ লয়েড ও গ্যারি সোবার্সের উইকেট নিয়ে তুলে ভারতকে জয়ের মুখ দেখাতে বড় ভূমিকা পালন করেন। তার মধ্যে, গ্যারি সোবার্স শূন্য রানে বিদায় নিতে বাধ্য হন। ২৯ টেস্টে অংশ নিয়ে ৫০ ইনিংস খেলেন। তবে, একটিমাত্র সেঞ্চুরি করার গৌরব অর্জন করেছিলেন সেলিম দুরাণী। ১৯৬২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১০৪ রান করেন।
১৯৭৩ সালে কানপুর টেস্টে তাঁকে দলের বাইরে রাখা হলে দর্শকেরা 'দুরানি নেই, টেস্ট নেই' প্ল্যাকার্ড বহন করে ও স্লোগান দেয়। একই বছরে 'চরিত্রা' চলচ্চিত্রে পারভীন ববি'র সাথে অভিনয় করেন।
প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে অর্জুন পুরস্কার লাভ করেন। ৩১ মে, ২০১১ তারিখে বিসিসিআই কর্তৃক শচীন তেন্ডুলকরসহ তিনি 'সি.কে. নায়ড়ু আজীবন সম্মাননা' পদকে ভূষিত হন। ১৪ জুলাই, ২০১৮ তারিখে বেঙ্গালুরুতে ভারত-আফগানিস্তানের মধ্যকার উদ্বোধনী টেস্টে তিনি উপস্থিত ছিলেন। ভারতীয় ক্রিকেটের 'প্রিন্স সেলিম' তিনি। মহিলামহলে ছিলেন দারুণ জনপ্রিয়। ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে আকর্ষণীয়। গ্ল্যামারের ঝলমলানিতে ঝলসে যেতেন ভক্তরা।
ইনি সেলিম দুরানি। আফগানিস্তানে জন্মানো একমাত্র ভারতীয় ক্রিকেটার। এক সময় 'পাবলিক ডিমান্ড' মেনে ছয় হাঁকাতেন। বল উড়ে যেত গ্যালারিতে। হাততালিতে ফেটে পড়ত মাঠ। রাজকীয় হাবভাবে জাগাতেন সমীহ। এমনই তারকাসুলভ ভাবমূর্তি ছিল যে, সত্তরের দশকে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট দলে তাঁকে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছিল বোর্ড! ১৯৬০ থেকে ১৯৭৩, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। ২৫.০৪ গড়ে ১২০২ রান, একটি সেঞ্চুরি, সাতটি হাফ-সেঞ্চুরি। বাঁ-হাতি স্পিনে নিয়েছিলেন ৭৫ উইকেট। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১৭০ ম্যাচে ৮৫৪৫ রান, ৪৮৪ উইকেট। অবশ্য নিছক পরিসংখ্যানে তাঁকে মাপা মুশকিল। তারকার গ্ল্যামার জড়িয়ে ছিল তাঁর ক্রিকেটে। সুদর্শন ক্রিকেটার পা রেখেছিলেন বলিউডেও। ১৯৭৩ সালে করেন 'চরিত্র' নামের সিনেমা। পরভিন ববি ছিলেন নায়িকা। সেই শুরু, সেই শেষ। আর সিনেমা করেননি।
ছক্কা হাঁকানোর কারণে তিনি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। আক্রমণধর্মী বামহাতি ব্যাটসম্যানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন তিনি। সেরা বোলারদেরকেও তিনি মনোবলহীন করে দিতে সক্ষম ছিলেন। স্বীয় উচ্চতাকে কাজে লাগিয়ে বলকে বাঁকানোয় সক্ষমতা দেখিয়েছেন। প্রথম-শ্রেণীর সাবেক ক্রিকেটার আব্দুল আজিজের সন্তান তিনি। একমাত্র আফগান বংশোদ্ভূত ভারত ক্রিকেট দলে খেলেছেন। ব্যাট হাতে দর্শক মনোরঞ্জন ছিল তাঁর খেলার স্টাইল। আনন্দ দিতে ভালবাসতেন ক্রিকেটপ্রেমীদের। বোলারদের পরোয়া করতেন না, চালাতেন ব্যাট।সুনীল গাওস্করের 'প্রিন্স সেলিম' আছেন নিজের জগতেই পরিপূর্ণ!