ভারত তার ঐতিহাসিক প্রাচুর্যতার সাথে স্বভাবতই রহস্যময়। তবে সেই দিক থেকে দেখতে গেলে বাংলাও কম যায় না। এখানে পদে পদে রয়েছে রহস্য। আর এই রহস্যের কথা বললেই প্রথমেই উঠে আসে ভৌতিক ক্রিয়া কলাপের কথা। পশ্চিমবঙ্গের বুকে অবস্থিত সুন্দরবন। এই অঞ্চলটি ম্যানগ্রোভ ও রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের জন্য প্রসিদ্ধ হলেও গোটা সুন্দরবন ঘিরে রয়েছে এক ভৌতিক রহস্যের বেড়া জাল।
বলা বাহুল্য ভূত বা প্যারানরমাল অ্যাকটিভিটিস বিষয়ে বহু জনের বহু মত রয়েছে। আরও রয়েছে প্রতি ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। এ ক্ষেত্রে বাংলার একটি প্রবাদ প্রযোজ্য “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর”। এবার জেনে নেওয়া যাক মূল ঘটনা বিষয়ে। সুন্দরবনের বাসিন্দাদের বক্তব্য রাত্রি বাড়লে গভীর অরণ্যের এক বিশেষ আলো দেখতে পাওয়া যায়। আর সেই আলো দেখা মাত্রই যেকোন ব্যাক্তি ঐ আলোর বশীভূত হয়ে পড়ে। ফল স্বরূপ তার মৃত্যু ঘটে। কিন্তু কেন এমনটা ঘটে? এই আলোর উৎস কোথায়? সবই ধোঁয়াশা।
এবার বলা যাক, উক্ত ভৌতিক ঘটনা সুন্দরবনে যারা বহু কাল ধরে বসবাস করে আসছে শুধু মাত্র তারাই জানেন এবং এর শিকার হয়ে থাকেন। পর্যটক যারা সুন্দরবন ভ্রমনের জন্য এসে থাকেন তারা কেউই উক্ত ভৌতিক আলোর শিকার হননা। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে তার একমাত্র কারণ হল পর্যটকরা কেউ সুন্দরবনের গভীর অরণ্যে প্রবেশ করেননা। সাধারণত সুন্দরবনে বাঘের আতঙ্ক চিরকালই তবে তাজ্জবের বিষয় হল এই ঘটনায় যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের কারোর শরীরে কোন রকম আঘাত বা ক্ষতর চিহ্ন মাত্র পাওয়া যায়নি। সকলের প্রাণহানির একটি মাত্র কারণ হল জলে ডুবে মৃত্যু। তবে তারা যে সাঁতার না জানার ফলে প্রান হারিয়েছেন এমনটা নয়।
সুন্দরবনের বাসিন্দারা এই রহস্যের বিষয়ে একটি প্রাচীন কাহিনীতে বিশ্বাসী। তাদের কথায় বহু বছর আগে সুন্দরবনে শ্রুঞ্জয় নামক এক রাজা ছিলেন। তাঁর একমাত্র পুত্র আঞ্জয় নিজের গুণে সকলের প্রিয় পাত্র ছিলেন। তাঁর অপর নাম ছিল আলেয়া। অঞ্জয়ের রাজ্যাভিষেকের সময় হলে রাজপরিবারের নিয়ম মেনে তাকে যেতে হয় শিকারে। আর শিকারের শর্ত হিসাবে ছিল সুন্দরবনের বিখ্যাত রয়্যাল বেঙ্গল বাঘ শিকার করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করা। নিয়ম মতন অঞ্জয় তাঁর পিতা এবং দলবলকে সঙ্গে নিয়ে শিকারের উদ্দ্যেশে রওনা দেয়। সুন্দরবনের গভীর অরণ্যের খাঁড়ির মধ্যে দিয়ে দুই দিন ব্যাপী তাদের বজরা চলে। জ্যোৎস্নার আলোয় আঞ্জয় এক বাঘিনীকে তার শাবকের সাথে জল পান করতে দেখলে তার দলের সাথে মিলে তাদের শিকার করে। পরের দিন ফেরার সময় অপর এক বাঘিনী ও তার শাবককে একত্রে জল পান করতে দেখলে অঞ্জয় তাদের শিকার করতে অগ্রসর হয়। কিন্তু এইবার ভাগ্য সাথে না থাকায় বাঘিনীর কবলে অঞ্জয়ের প্রান যায়। ঐ ঘটনার পর থেকেই অঞ্জয়ের আত্মা সুন্দরবনের গভীর অরণ্যে ঘুরে বেড়ায় এবং নিজের শিকার খোঁজে। তাই ঐ এলাকার বাসিন্দাদের কাছে উক্ত আলো অঞ্জয়ের নামানুসারে আলেয়া বলেই পরিচিত। শুধু তাই নয় গভীর রাতে দেখতে পাওয়া এই সকল আলোগুলিকে তারা মাঝিদের আত্মা মনে করেন যারা আলেয়ার কবলে পরে প্রান হারিয়েছেন। এই সকল আলো সাধারণ মানুষকে যেমন বিভ্রান্ত করে বিপদে ফেলে আবার কখনও কখনও তাদের বিপদ হতে রক্ষা করে থাকে।
যদিও এই ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করলে দেখা যাবে সুন্দরবনের জলমগ্ন জায়গায় বিপুল পরিমাণে ফসফরাস এবং মিথেন পাওয়া যায় সর্বত্র আর এই দুই গ্যাসের বিক্রিয়ার ফলে আগুন জ্বলে ওঠে। দূর থেকে দেখলে একে আলো মনে হয়। বৈজ্ঞানিক ভাষায় এটি আলেয়া নামে পরিচিত। তবে সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ এই তথ্য মানতে নারাজ। তাদের ধারণা আলোর বেশে আত্মারা ঘুরে বেড়ায়।