হাসিমুখে ফাঁসির দড়ি বরণ করেছিলেন বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসু

হাসিমুখে ফাঁসির দড়ি বরণ করেছিলেন বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসু

বিচারের প্রহসনে বিপ্লবী সত্যেন বসুর ফাঁসির দিন ধার্য হল, ১৯০৮ সালের ২১ নভেম্বর। সময়, ভোর।

সত্যেন তখন ছাব্বিশ বছরের তরুণ। মা চাইলেন সন্তানকে শেষবারের মতো দেখতে। কিন্তু সত্যেনের মন তাতে সায় দিল না। মা সামনে এলে কেমন করে তিনি তাঁর করুণ সজল চোখের দিকে চাইবেন! তাতে আবেগের বাঁধ ভেঙে যদি ফাঁসির দড়ি গলায় বরণ করে নিতে কষ্ট হয়! না না, সে তিনি পারবেন না।

তবু মা নাছোড় হলেন। জন্মের মতো চলে যাবে যে সন্তান, তাকে শেষবার দেখবেন না! যত কষ্টই হোক...!

সত্যেন মাকে কিছুতেই যখন ঠেকিয়ে রাখতে পারলেন না, তখন শর্ত দিলেন—দেখো মা, যদি তুমি আমার কাছে এসে চোখের জল না ফেল, তাহলে আমি তোমার সঙ্গে দেখা করব। আমি বীরের মতো মরতে চাই মা, আমাকে দুর্বল করে দিয়ে সেই গৌরব থেকে যেন বঞ্চিত করো না!

মা শর্ত মেনে প্রেসিডেন্সি জেলে গেলেন ছেলের সাথে দেখা করতে। একটুও চোখের জল ফেললেন না। স্থির চোখে প্রাণ ভরে শুধু বীর সন্তানকে দেখলেন। সেই দৃষ্টি দেখে সত্যেনের মনে হল মা বুঝি কষ্ট পাচ্ছেন। তাই প্রবোধ দেওয়ার মতো করে বললেন, মা, লোকে পুণ্যের জন্য কাশী বিশ্বনাথের চরণে নিজের প্রিয় ফলটি দান করে; ভাবো তুমি না-হয় তেমনি করে আমায় দেশমায়ের চরণে দান করেছ! কষ্ট পেয়ো না মা।

মা ধীরে ধীরে বললেন, আমি কষ্ট পাচ্ছি না বাছা। আমি যেমন তোমার মা, তেমনি এই দেশও তোমার মা। তোমার বলিদানে তাঁর অধিকার আমার চেয়েও বেশি। সন্তান বীর না হলে সেই বলিদান সম্ভব হয় না!...কষ্ট হচ্ছে না, তোমার মতো বীরসন্তানের গর্ভধারিণী হয়ে আমার গর্ব হচ্ছে বাবা!

চোখের জল আড়াল করতে কষ্ট হয়। তবু মা সেই কষ্ট আড়াল করেছিলেন। কথা রেখেছিলেন। সন্তানকে দেওয়া শেষ কথা। এভাবেই সত্যেন আর মায়ের শেষ সাক্ষাৎ ঘটেছিল সেদিন।

সত্যেন—সত্যেন্দ্রনাথ বসু। বীরভূমি মেদিনীপুরের বীরসন্তান। ১৮৮২ সালের ৩০ জুলাই তাঁর জন্ম হয়। পিতা অভয়চরণ বসু ছিলেন মনীষী রাজনারায়ণ বসুর ছোট ভাই। সত্যেন্দ্রনাথেরা ছিলেন পাঁচ ভাই। তিনি দ্বিতীয়। বড়দা জ্ঞানেন্দ্রনাথ ছিলেন বিপ্লবী।

বিপ্লবে জ্ঞানেন্দ্রনাথের হাতেখড়ি হয়েছিল রাজনারায়ণের কাছেই। কেননা, রাজনারায়ণ সেই সময় মেদিনীপুরের কলেজিয়েট স্কুলে প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ছাত্রদের মধ্যে বৈপ্লবিক চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে তিনি এই সময় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথের বালক বয়সে তিনি দেওঘর চলে যান। তাই বিপ্লবে সত্যেনের দীক্ষা হয় বড়দা জ্ঞানেন্দ্রনাথের কাছে।

রাজনারায়ণের কন্যা ছিলেন অরবিন্দ ঘোষের মা। সেই সূত্রে জ্ঞানেন্দ্রনাথ ও সত্যেন ছিলেন তাঁর মামা। সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন নিয়ে অরবিন্দ কলকাতায় ‘যুগান্তর’ নামের বৈপ্লবিক গুপ্ত সমিতি গড়ে তোলার পর তাতে জ্ঞানেন্দ্রনাথ যোগ দেন।

মেদিনীপুরে গুপ্ত সমিতি গড়ে ওঠে হেমচন্দ্র কানুনগোর হাত ধরে। সত্যেন হয়ে ওঠেন তাঁর প্রধান সহযোগী। হেমচন্দ্র সেই মহান বিপ্লবী, যিনি পরে নিজের বসতবাটি বিক্রি করে প্যারিসে পাড়ি দেন বোমা তৈরি শেখার জন্য। বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে বোমা তৈরি ও তার ব্যবহার তাঁর জন্যই সম্ভব হয়েছিল। ক্ষুদিরাম বসুকে বৈপ্লবিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন তিনিই। কিংসফোর্ড হত্যার চেষ্টায় ক্ষুদিরামের ব্যবহৃত বোমাটিও তাঁর তৈরি।

যাই হোক, ১৯০২ সালে হেমচন্দ্র যখন মেদিনীপুরে গোপন বিপ্লবী দলটি গড়ে তুললেন; তখন মেধাবী ছাত্র সত্যেন মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলেই চাকরি করছেন। দুজনে মিলে দলটিকে শক্তিশালী ও সুসংবদ্ধ করে তোলায় মন দিলেন। তারপর ১৯০৫ সালে কার্জনের বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যখন দিকে দিকে আন্দোলন গড়ে উঠল, বইল স্বদেশিয়ানার জোয়ার। তখন এঁরা প্রকাশ্যে একটি ছাত্রভান্ডার গড়ে তুললেন। ব্যায়ামচর্চা, শরীরশিক্ষা, কর্মশিক্ষার আড়ালে চলতে লাগল বৈপ্লবিক কার্যকলাপ ও সংগঠনের কাজ। বৈপ্লবিক আদর্শকে যুবক-তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে এই সময় তাঁরা  মেদিনীপুরে আয়োজন করলেন একটি কৃষিমেলার। সত্যেন সেই মেলায় ক্ষুদিরামকে দিয়ে বিলি করালেন ‘সোনার বাংলা’ নামের বৈপ্লবিক ইস্তাহার। আর সেটা করতে গিয়ে ক্ষুদিরাম পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন। তখন আসরে নেমে কৌশলে ক্ষুদিরামকে মুক্ত করলেন স্বয়ং সত্যেন। বৈপ্লবিক কাজের সঙ্গে ক্ষীণ যোগের আভাস পেয়ে স্কুল সত্যেনকে বরখাস্ত করল।

চকরি গেল। ভালোই হল। এবার আর আড়াল না-রেখে পুরোদমে বৈপ্লবিক কাজকর্মে নেমে পড়লেন সত্যেন। সশস্ত্র সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বন্দুক সংগ্রহ করতে শুরু করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই বে-আইনি বন্দুক রাখার দায়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন। বিচারে তাঁর দু’মাসের জেল হয়ে গেল।

ঠিক এই সময় গোপন সূত্রে খবর পেয়ে পুলিশ হানা দিল ‘যুগান্তর’-এর আড্ডায়। তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন কানাইলাল দত্ত, সত্যেন বসু, অরবিন্দ ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, বারীন ঘোষ, নরেন গোঁসাই প্রমুখ অনেক বিপ্লবী। ধরা পড়লেন সকলে। তাঁদের সকলকেই মানিকতলা বোমা মামলায় জেলে ভরে দেওয়া হল। বিপ্লবীদের ওপর শুরু হল সমিতির গোপন কথা বের করে আনার জন্য আকথ্য অত্যাচার। তবু বিপ্লবীরা কিছুতেই গোপনসত্য ফাঁস করলেন না। কিন্তু তাঁদের মধ্যে শুধু একজন ভয়ে পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করতে রাজি হল, সে হল নরেন গোঁসাই।

নরেন গোঁসাই শখের বিপ্লবী। খুব বেশিদিন দলে যোগ দেয়নি। খুব বেশি সে জানেও না। তবু যেটুকু সে জানে, তা রাজসাক্ষী হয়ে বলে দিলে সকলের বিপদ, আন্দোলনের জন্যও ক্ষতিকর। নরেনের এই রাজসাক্ষী হওয়ার কথা বন্দিদের মধ্যে গোপনসূত্রে পৌঁছে গেল। সিদ্ধান্ত হল নরেনকে অবিলম্বে সরিয়ে ফেলতে হবে। তাকে সরানোর দায়িত্ব নিলেন কানাইলাল আর সত্যেন।

এবার প্রয়োজন হল নরেনের কাছাকাছি আসার জন্য ছলনার। সত্যেন শুরু করলেন শ্বাসকষ্টের অভিনয়; কানাইলাল অসহ্য পেটের যন্ত্রণার। দুজনকেই নিয়ে আসা হল জেলের হাসপাতালে। সেখানে হেমচন্দ্রের কারসাজিতে এসে গেল দু’জনের জন্য দুটো পিস্তল। তখন সত্যেন পুলিশকে জানালেন যে, আর যন্ত্রণা তাঁর পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না, তিনি বিপ্লবীদের গোপন কথা সব বলে দিয়ে মুক্তি পেতে চান। তবে সব কথা বলার আগে নরেন গোঁসাই-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আলোচনা সেরে নিতে চান। এই প্রস্তাবে খুশি হয়ে পুলিশ অমনি নরেনকে তাঁর কাছে হাজির করল। নরেনও সঙ্গী পেয়ে খুশি হল। বসল এসে সত্যেনের বিছানায়।

বিছানায় বুক অব্দি ঢাকা চাদরের নীচে পিস্তল উঁচিয়ে সত্যেন প্রস্তুত ছিলেন; নরেন বসতেই গুলি করলেন। গুলি লাগল তাঁর উরুতে। আহত নরেন তারস্বরে চিৎকার করে পালাতে চাইল। গুলির শব্দে সচকিত নরেনের প্রহরী ছুটে এল, সত্যেন তার হাতে গুলি করলেন। সে পড়ে গেল। তখন পিস্তল হাতে কানাইলাল যোগ দিলেন। পলায়মান নরেনকে সত্যেন ও কানাই ধাওয়া করে দুজনে পর পর পাঁচটি গুলি করলেন। জেলের মাঠে মুখ থুবড়ে বিশ্বাসঘাতক নরেন মরে পড়ে রইল।

নরেনের মৃত্যুতে মানিকতলা বোমার মামলা আর সেভাবে সাজাতে পারল না ইংরেজের পুলিশ। কিন্তু কোর্ট নরেনহত্যা মামলায় সত্যেন ও কানাইকে সাজা দেওয়ার মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেল। কানাই সব দোষ নিজের ঘাড়ে তুলে নিলেন। সবাই ভাবল সত্যেন বুঝি ছাড়া পেয়ে যাবেন। কিন্তু ইংরেজের বিচারকদের সেটা পছন্দ হল না। তারা দুজনকেই ফাঁসির হুকুম দিল।

সত্যেন ও কানাই দুজনে প্রস্তুত হয়েই ছিলেন ফাঁসির জন্য। পরিণাম জেনেই তাঁরা দায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছিলেন। পরিণাম জেনেই বিপ্লবের অগ্নিপথে পা রেখেছিলেন। তাই হাসিমুখেই মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিলেন।

ইংরেজ সত্যেনকে ফাঁসি দিয়েছিল, কেননা তারা তাঁকে অত্যন্ত ভয় পেয়েছিল। হাসিমুখে যে মানুষটা ফাঁসির দড়ি বরণ করতে পারেন, সে মানুষ তাদের কাছে ভয়ঙ্কর। তাঁর মৃতদেহকেও ভরসা করতে পারেনি। ফাঁসির ভোরে জেলখানার বাইরে অসংখ্য জনতার ভিড় দেখে তারা বুঝতে পেরেছিল তাঁর মৃতদেহ বিপ্লবের গণজোয়ার ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তাই সত্যেনের দেহ পরিবারের হাতে তুলে না-দিয়ে গোপনে দাহ করে দিয়েছিল তারা...                          

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...