মানিকের মানিক তিনি। কথায় বলে না, জহুরি ঠিকই জহর চেনেন। সত্যজিৎও দ্বিধা করেননি সৌমিত্রকে চিনে নিতে, আসলে ইতিহাস বুঝি এইভাবেই সৃষ্টি হয়। অনেকেই হয়ত একে সাধারণ স্বজনপোষণ বলে ইতি টেনে দেন, কিন্তু সত্যি কি তাই?
যখন দু-জন মানুষ একইসঙ্গে বহুদিন কাজ করছেন, তখন তাঁদের মাঝে যে বোঝাপড়া তৈরি হয়, সে জিনিসের কি কোনও তুলনা হয়? হয়ত সেই সাবলীল সম্পর্ক এবং একে অন্যের পরিপূরক হয়ে ওঠাই নির্দেশক ও অভিনেতা জুটির জন্ম দেয়। এই ভাবেই মানিকের মানস পুত্রের জন্ম হয়েছিল।
আমরা বলি, হা করলে হাওড়া বুঝি। ঠিক সেরকমই পরিচালক সত্যজিৎ কী চাইতেন, সেটা ভালই বুঝতেন সৌমিত্র এবং সত্যজিৎ হয়ত অন্য কারো মধ্যে এই ভরসাটা পেতেন না। তবে আরেকটি কারণ, সত্যজিৎ যেহেতু ভারতীয় সিনেমার অন্যতম ও প্রথম গল্পকথক এবং তিনি যে ঘরানার ছবি করতেন প্রধানত; সেখানে তিনি তথাকথিত প্রথম সারির ছবিগুলিতে কম মুখ দেখানো হিরোদের চাইতেন; যেমন বরুন চন্দ্র, ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। তাই বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা ও অভিনয়শৈলী মালিক সৌমিত্রই তাঁর ফার্স্ট চয়েস হতেন।
আবার বলতে পারি তিনি কিছু কিছু চরিত্র হয়ত সৌমিত্রকে ধরে নিয়েই চিত্রনাট্য লিখছিলেন, যেমন একদা ফেলুর ইলাস্ট্রেশন সম্পর্কে তিনি নিজেই বলতেন লোকে তাঁকে জিজ্ঞাসা করতেন, ছবিগুলো কি সৌমিত্রকে দেখেই আঁকেন? একথা ঠিক যে, তিনি পরবর্তীতে অভিনেতা অনুযায়ী ইলাস্ট্রেশন করেছিলেন। প্রথমে জটায়ুর যা ছবি ছিল; সন্তোষ দত্ত অভিনয় করার পরেই গল্পের বইয়ের পাতার জটায়ু আস্তে আস্তে সন্তোষ হয়ে উঠেছিলেন চেহারায়।
ভারতীয় সিনেমা তার আগে পর্যন্ত নায়ক-নায়িকা জুটি দেখে অভ্যস্ত ছিল, এই প্রথম জুটি হল পরিচালক ও অভিনেতার। পৃথিবীর ইতিহাসে যা বিরলতম ঘটনা। সত্যজিতের ৩৪ ছবির মধ্যে ১৪ টির নায়কই সৌমিত্র!
অপরাজিত, অপু ট্রিলজির দ্বিতীয় ছবি। যেখানে শৈশব থেকে অপু কৈশোরে পৌঁছাচ্ছে, উপযোগী অভিনেতা খুঁজছেন মানিকবাবু। সৌমিত্রও গিয়েছেন কাজ পেতে। সৌমিত্রকে দেখেই সত্যজিৎ বলে উঠলেন, 'এই রে আপনি যে একটু বড় হয়ে গেলেন'। এই প্রথম দেখা আর বাকিটা ইতিহাস। পরবর্তী চার দশকে তৈরি হয়েছে একের পর এক মাস্টারপিস! অপু ট্রিলজির শেষ ছবি অপুর সংসার থেকেই ম্যাজিকের শুরু, ছবিটি ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায়। পৃথিবীর দর্শকের কাছে সমাদৃত এই ছবিতে অপুর সংসার জীবন তুলে ধরা হয়েছে। সৌমিত্র এখানে একেবারে সাধারণ এক যুবক। বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করছেন। ভাড়া বাড়িতে থাকা, চাকরি খোঁজা, অপর্ণার সঙ্গে বিয়ে, আর্থিক সমস্যা, কাজলকে জন্ম দিতে গিয়ে অপর্ণার মৃত্যু। তারপর অপুর বোহেমিয়ান জীবনের শুরু এবং সেখান থেকে পিতা-পুত্রের বন্ধুত্বের সম্পর্কে শেষ হয় ছবি। মনে পড়ে সেই দৃশ্য, তুমি যাবে আমার সঙ্গে ? তুমি কে ? আমি...আমি বন্ধু। বাবা ছেলের এ দৃশ্য ভারতীয় সিনেমায় তদানিন্তন সময় অকল্পনীয়, আজ তা খুব বেশি দেখা যায় না।
সত্যজিতের এই প্রথম পুরুষ হলেন নিতান্ত সাধারণ এক ছেলে, হয়ত আপনার আমার মধ্যের যেকোনও কেউ, সেই ছেলে থেকে বাবা এবং কাজলের বন্ধু হওয়ার গল্প বলে এই ছবি।
সত্যজিতের দ্বিতীয় পুরুষ হলেন ১৯৬০-এ মুক্তি পাওয়া দেবী, এখানে দ্বিতীয় পুরুষ হলেন এক অসহায় স্বামী, উমাপ্রসাদ। যার স্ত্রী দয়াময়ী ধীরে ধীরে মানুষ সৃষ্ট ভগবানে পরিণত হয়।
১৯৬১-তে মুক্তি পায় রবিঠাকুরের তিনটি গল্প নিয়ে তিনকন্যা, যার সমাপ্তি গল্পের নায়ক হলেন তৃতীয় পুরুষ, অমূল্য। সে গ্রামের ছেলে, শহর থেকে গ্রামে ফেরে তারপর এক ডানপিটে মেয়েকে দেখতে যায় এবং শেষটা অভিপ্রেত মধুরেন সমাপয়েতেই হয়। এও এক সাধারণের গল্প। যা রবিঠাকুর বলে গিয়েছেন।
চতুর্থ পুরুষ হলেন অভিযানের নরসিংহ, সে একজন চালক। কঠিন, বাস্তববাদী, জীবনের সাথে লড়াই করা এক চরিত্র। শেষটায় পরিণত হয় তাঁর ভালোবাসা, ছবিটি মুক্তি পায় ৬২-তে। গল্পকার ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
১৯৬৪-তে তিনি হাজির হন পঞ্চম পুরুষ হিসেবে, রবিঠাকুরের নষ্টনীড় অবলম্বনে চারুলতা ছবিতে। এখানে চারুর একাকিত্ব লাঘবে অমল আসেন এবং সম্পর্কের এক অদ্ভুত টানাপোড়েন ফুটে ওঠে পর্দায়। আসলে সম্পর্কের জাল বুনতে রবি ঠাকুরের জুড়ি মেলা ভার। সেই সঙ্গে নির্দেশক সত্যজিৎ! আর যায় কোথায়।
পরের বছর ৬৫-তে, ষষ্ঠ পুরুষ আসেন কাপুরুষ হয়ে, এক চিত্রনাট্যকার যার সাথে চা বাগানে দেখা হয় তাঁর প্রাক্তনের।
প্রায় পাঁচ বছর পর, ১৯৭০-এ মুক্তি পায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বণে অরণ্যের দিনরাত্রি। চার বন্ধুর একটি অরণ্যে অবসর যাপনের গল্পে সপ্তম পুরুষ আসেন অসীম হয়ে, যে শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত ধনী যুবক। বন্ধুদের অরণ্য অভিযান, সেইখানে জীবন সঙ্গীনিকে খুঁজে পান সঞ্জয়।
১৯৭৩-এ তিনি হয়ে উঠলেন গ্রামের দুর্ভিক্ষপীড়িত এক ব্রাহ্মণ, এই অষ্টম পুরুষের আবির্ভাব হল অশনি সংকেত ছবির দ্বারা। যা বিভূতিভূষণের কলমের অনবদ্য একটি সৃষ্টি।
নবম এবং দশম পুরুষে তিনি গোয়েন্দা, মানিকের নিজের সৃষ্টি, প্রদোষ চন্দ্র মিত্র।আমাদের ফেলুদা সায়েস্তা করলেন মন্দার বোস, ভবানন্দ থেকে মগনলাল মেঘরাজকে। ১৯৭৫ এবং ১৯৭৯ সালে, পরপর দুবার সোনারকেল্লা আর জয় বাবা ফেলুনাথে ফিরলেন সৌমিত্র।
১৯৮০-তে একাদশ পুরুষ উদয়ন পন্ডিত। যার শিড়দাঁড়াটা শক্ত ছিল, পাঠশালাও খুলেছিলেন শেষটায়, হীরক রাজার দেশে রাজকেও পাঠ পড়ালেন, 'দড়ি ধরে মারো টান রাজা হবে খান খান'। ছোটদের ছবিতে বড়দের কথা বললেন সত্যজিত। হেরে গেল ফ্যাসিবাদ।
১৯৮৪-তে আবার রবীন্দ্রনাথ। এবার দ্বাদশ পুরুষ হলেন ঘরে বাইরের সন্দীপ। বন্ধুর স্ত্রীকে ভালোবেসে ফেলা জাতীয়তাবাদী নেতা। এতেও ধরা পড়ে সম্পর্কের টানাপোড়েন।
ত্রয়োদশ পুরুষ হলেন গণশত্রুর ডাক্তার অশোক গুপ্ত। ১৯৮৯ সালের এই ছবিতে তিনি ক্ষমতাধর অসাধু রাজনৈতিক ব্যক্তি ও ধর্মবিশ্বাসের অন্ধ অনুগামীদের বিরুদ্ধে ঘোষণা করেন জেহাদ এবং মানুষের শত্রুতে পরিণত হওয়ার অশোক গুপ্ত শেষে হয়ে ওঠেন হিরো। এখানে সৌমিত্র আধা শহর বা মফ:স্বলের প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক।
চোদ্দতম পুরুষের নাম প্রশান্ত, আনন্দ মজুমদারের চার ছেলের এক ছেলে। ছবির নাম শাখা প্রশাখা, মুক্তি পায় ১৯৯০ সালে।
চোদ্দকলা পূর্ণ হল কিন্তু প্রকৃত অর্থে বলতে গেলে, বলতে হয় সাড়ে চোদ্দ। ওই সুকুমারের পত্রিকা সাড়ে বত্রিশ ভাজার মতোই।
সত্যজিৎ, সুকুমার রায়ের জীবনীনির্ভর এক তথ্যচিত্র তৈরি করেন। সেখানেই একটি দৃশ্যে রামায়ণের কথা আসে। ঐখানেই সাড়েতম পুরুষ হয়ে সৌমিত্র আসেন রামের চরিত্রে। এছাড়াও সত্যজিতের চিত্রনাট্য নিয়ে সন্দীপ রায় তৈরি করেন উত্তোরণ। সেখানে সৌমিত্র ছিলেন চিকিৎসক, গ্রামের কুসংস্কারের হাত থেকে শত চেষ্টা করে, রুখে দাঁড়িয়েও তিনি রোগীকে বাঁচাতে পারেননি।
তপেন চট্টোপাধ্যায় একবার সৌমিত্র বাবুকে বলেছিলেন, আচ্ছা মানিকদার ব্যাপার কী বলো তো? তিনি গ্রামের ব্রাহ্মণ সাজাচ্ছেন তোমাকে আবার কোর্ট পরা গোয়েন্দাও বানাচ্ছেন তোমায়। এ ভারী অন্যায়। এর উত্তর হল রসায়ন, মনের মিল হলেই যা তৈরি হয়।
শুধু কি ছবি, নাকি তার বাইরেও অন্য কিছু ছিল তাঁদের সম্পর্কে। এক্ষণ, বাংলার অন্যতম এক সবুজপত্র। যার সহ সম্পাদনা করতেন সৌমিত্র। সেই পত্রিকার নামাঙ্কন থেকে শুরু করে প্রচ্ছদ আঁকা, সবই করেছেন সত্যজিৎ। তাঁর ছবির চিত্রনাট্যও প্রকাশিত হয়েছে এক্ষণে। এ তো গেল শুধুই কর্মজীবনের সম্পর্ক! এর বাইরেও ছিল আরও অনেকটা, যা সৌমিত্রকে করে তুলেছিল সত্যজিতের সৌমিত্র, সত্যজিতের মানসপুত্র।