সত্যজিৎ রায়ের ছায়াছবির সম্পাদনা-শিল্পী দুলাল দত্ত

চিত্রপরিচালক ও ক্যামেরাম্যান লোকেশনে গিয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রী, যন্ত্রপাতি, লোকলস্কর নিয়ে ফিল্ম বা ভিডিও তুলে নিয়ে আসেন। সম্পাদনাকক্ষে বসে সেই সব ফিল্ম বা ভিডিওর অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দিয়ে প্রয়োজনীয় অংশগুলো বিভিন্ন পদ্ধতিতে ফিল্ম-এডিটার বা চিত্রসম্পাদক এমনভাবে পাশাপাশি জুড়ে দেন, যাতে দর্শক ছবির কাহিনির নিটোল ও জমজমাট অগ্রগতি দেখতে পান; সেই সঙ্গে ছবির বিভিন্ন মুহূর্ত দর্শকের কাছে বিশেষ ব্যঞ্জনাময়ও হয়ে ওঠে। এই কাজটা সবাই পারেন না, এ বেশ গুণী শিল্পীর কাজ। আর তেমনই এক গুণী শিল্পী তথা চিত্রসম্পাদক ছিলেন দুলাল দত্ত।

সম্পাদনায় দুলাল দত্তের শিল্পীমনের ছোঁয়া আমরা দেখতে পাই সত্যজিতের সমস্ত ছবির পরতে পরতে। তার মধ্যে ধরুন ‘অপরাজিত’ (১৯৫৬) ছবির কথাই। সেখানে কাশীতে হরিহরের মৃত্যুকাল উপস্থিত। সর্বজয়া তালপাতার পাখায় হাওয়া করছে। অপু গঙ্গা থেকে জল নিয়ে আসে। সর্বজয়া সেটা হরিহরের মুখে দেয়। তখনই হরিহর মারা যায়।–এটা হচ্ছে একটা সিকোয়েন্স। দুটো দৃশ্যের সংঘাতে এই সিকোয়েন্সটি তৈরি হচ্ছে। ভেতরের দৃশ্যে হরিহর মৃত্যুযন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে, তাকে পাখার বাতাস দিতে দিতে সর্বজয়া অধীর হয়ে অপুর আসার অপেক্ষায় রয়েছে; বাইরের দৃশ্যে অপু জল নিয়ে গঙ্গার ঘাট বেয়ে ধীরে ধীরে গলি পেরিয়ে ঘরে আসছে। এখানে মায়ের অপেক্ষা আর অপুর আসা; এই দুই দৃশ্য কতক্ষণ পাশাপাশি পর্দায় রাখলে দর্শকের মনে গভীর উদ্বেগ তৈরি হবে, দর্শক হরিহরের কষ্ট ও সর্বজয়ার উদ্বেগের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠবে—সেই সিদ্ধান্ত সম্পাদককেই নিতে হয়; সেখানেই তাঁর মুন্সিয়ানা। এবার দ্বিতীয় ব্যাপারটা আসুন খেয়াল করিঃ এই সিকোয়েন্সে সম্পাদক যেভাবে সর্বজয়ার উদ্বেগের সঙ্গে ও হরিহরের কষ্টের সঙ্গে দর্শককে একাত্ম করলেন; ছবির কাহিনির প্রয়োজন তাতেই মিটে গেছে। কিন্তু দুলালবাবু এখানেই নিজের কাজ শেষ করেননি; তিনি হরিহরের মৃত্যুর মুহূর্তটির সঙ্গে সঙ্গে শার্প কাট করে এক ঝাঁক পায়রা উড়ে যাওয়ার শট জুড়ে মৃত্যুটিকে আরও ব্যঞ্জনাময় করে তুলেছেন। দর্শকেরা বোঝেন, পাখির এই ওড়া সাধারণ ওড়া নয়, এতে যেন হরিহরের প্রাণপাখিই উড়ে গেল। এভাবে সাধারণ মৃত্যু অসাধারণ কাব্যিক ব্যাপ্তি পেল। আর এখানেই দুলালবাবুর কৃতিত্ব।

E4TubssVkAECoyN (1)

কোন ছবি নিপাট ও স্মার্ট হয়ে ওঠার পেছনে সম্পাদকের অবদান অনেকখানি। কিন্তু দর্শক-সাধারণ তাঁর কোন খোঁজ রাখেন না। কোনদিন কোন সম্পাদকের নামে সিনেমার টিকিট বিক্রি হয় না। অথচ সম্পাদকের কাজ ভালো না-হলে ভালো অভিনয়, ভালো পরিচালনা সত্বেও পুরো ছবিটাই জলাঞ্জলি যেতে পারে। তবুও সম্পাদক অন্তরালের শিল্পী হয়েই থেকে যান চলচ্চিত্রলোকে। এ-ব্যবস্থা আজকের নয়, চলচ্চিত্রের শৈশব থেকেই চলছে। দুলালবাবু এসব জেনেও সেই যৌবনে এই সম্পাদনাকর্মের দিকেই কেন জানি না আকৃষ্ট হয়েছিলেন।

১৯২৫ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন চন্দননগরে। এই সময়টা বাংলা তথা ভারতীয় ছায়াছবির শৈশবকাল। নির্বাক যুগ। তাঁর বালক বয়সে এসে ছায়াছবি সবাক হয়। আর সেই ছায়াছবি দেখতে দেখতেই তাঁর সাধ হয় চলচ্চিত্রের কর্মী হওয়ার। ষোল-সতের বছর বয়স হতে-না-হতেই শুরু হয়ে যায় এ কাজে আত্মনিয়োগের প্রস্তুতি। শুরু হয় কলকাতার স্টুডিওগুলোতে যাতায়াত। যোগাযোগ ও আলাপ-সালাপের সূত্রে সুযোগ ঘটে বম্বে যাওয়ার। একজন মেকআপ আর্টিস্টের সহকারী হিসেবে। এই সুযোগ হাতছাড়া করেননি দুলালবাবু। পাড়ি দিয়েছিলেন বম্বে। কাজ জুটেছিল এক স্টুডিওতে। স্টুডিওতে গিয়ে দেখলেন একপাশে ফিল্মের এডিটিং চলছে। জটিল, সূক্ষ্ম এবং এলাহী ব্যাপার। ব্যাপারটার প্রতি আগ্রহ বাড়ল। প্রতিদিন সময় বের করে হানা দিতে শুরু করলেন এডিটিংরুমে। এটা আবার চোখে পড়ল সেই সময়ের উদীয়মান পরিচালক ভি শান্তারামের। তিনি দুলালবাবুকে পরামর্শ দিলেন, অন্তর থেকে যে-কাজ ভালো লাগছে, সেই কাজই করতে। তাঁর পরামর্শ দুলালবাবু আশীর্বাদের মতো মাথা পেতে নিলেন। সেটা ১৯৪১ সাল।

যোগাযোগ ঘটে গেল আবার। কলকাতার চিত্রপরিচালক ও সম্পাদক অর্ধেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ হল। তাঁর সঙ্গে যোগ দেবার কথা হল। ব্যস, দুলালবাবু কলকাতায় এসে তাঁর তত্ত্বাবধানে চিত্রসম্পাদনার কাজ শিখতে শুরু করলেন। বেশ ক’বছরের অভিজ্ঞতা পেরিয়ে ১৯৫৫ সাল নাগাদ স্বাধীনভাবে কাজ শুরু করলেন ‘দেবত্র’ ছবির সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। কানন দেবীর স্বামী হরিদাস ভট্টাচার্য ছিলেন এই ছবির পরিচালক। অহীন্দ্র চৌধুরী, কানন দেবী, উত্তম কুমার এই ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রী। দুলালবাবু যখন এই ছবির কাজ করছেন তখন সত্যজিৎ রায় বেশ কিছুদিন ‘পথের পাঁচালী’র শ্যুটিং করে ফেলেছেন; খুঁজছেন ভালো একজন সম্পাদক। এই পরিস্থিতিতেই তাঁর সঙ্গে আলাপ হল সত্যজিতের।

সেই আলাপ কীভাবে হল, তা ‘অপুর পাঁচালী’ গ্রন্থে লেখা সত্যজিতের জবানিতেই আপনাদের শোনাইঃ

‘...যেটুকু যা কাজ হয়েছে, ইতিমধ্যে তার এডিটিংয়ের জন্য আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ি। বংশী আমার সঙ্গে এক চিত্র-সম্পাদকের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। ভদ্রলোকের নাম দুলাল দত্ত। এ যখনকার কথা, দত্তমশাই তখন সবে একটা ফিচার-ফিল্ম সম্পাদনা করেছেন। তবে অ্যামেচার হিসেবে তার আগেও তিনি গোটা কয়েক ছবির এডিটিং করেছিলেন বটে। এখন অবশ্য তিনি একজন অগ্রগণ্য চিত্র-সম্পাদক।’

‘পথের পাঁচালী’ থেকে ‘আগন্তুক’ অব্দি অর্থাৎ প্রথম থেকে শেষ অব্দি সত্যজিতের সমস্ত ছবিতেই সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন দুলালবাবু। শুরু থেকেই দু’জনের পারস্পরিক বোঝাপড়ায় এমন একটা আত্মিক যোগসূত্র তৈরি হয়েছিল যে, দু’জনেই একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছিলেন। ‘পথের পাঁচালী’ যেমন সত্যজিৎকে বিশ্বের দরবারে পরিচিতি দিয়েছিল, তেমনই দুলাল দত্তের প্রতিভাকেও চিনিয়েছিল। বিদগ্ধ দর্শক জানেন, কোন কাজে কার মুন্সিয়ানা খেয়াল করতে হয়। সত্যজিতের ছবিতে যে অনন্যসাধারণ কাব্যিক ব্যঞ্জনা প্রস্ফুটিত, তাতে দুলাল দত্তের সম্পাদনারও যথেষ্ট অবদান—এ তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁরা দেখেছিলেন সত্যজিতের ভিন্ন ভিন্ন ছবিতে দুলালবাবুর ভিন্ন ভিন্ন এডিটিং স্টাইল; এই বহুমুখীনতায় তাঁরা মুগ্ধ হয়েছেন। আমেরিকান চিত্রপরিচালক, চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক ও অভিনেতা মার্টিন স্করসেসে তো স্পষ্টতই বলেছেনঃ

‘তাঁর সম্পাদনার ধরণ প্রতিটি ছবিতেই বেশ আলাদা, একে-অপরে মিল প্রায় নেই বললেই চলে।  ‘মহানগর’, ‘চারুলতা’, ‘নায়ক’ ও ‘আগন্তুক’-এ তাঁর কাজ ইওরোপ ও হলিউডের সম্পাদকদের মতো অত্যন্ত উঁচুদরের।’

এ তো গেল আন্তর্জাতিক এক চলচ্চিত্রশিল্পীর কথা। দুলালবাবুর কাজ বাঙালি তথা ভারতীয় সিনেমা জগতের মানুষ কতটা সমীহের চোখে দেখেন বা দেখতেন তারও যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। হৃষিকেশ মুখার্জি নিজে অত্যন্ত গুণী চিত্রপরিচালকের পাশাপাশি স্বনামধন্য চিত্রসম্পাদকও ছিলেন। তিনি নবীন চিত্রসম্পাদকদের উপদেশ দিতেন, দুলালবাবুর কাজ অনুসরণ করতে। এ থেকেই বোঝা যায়, হৃষিকেশ তাঁকে শ্রদ্ধার কোন উচ্চ আসনে বসিয়েছিলেন! সমসময়ের মানুষের কাছে এই স্বীকৃতি ও শ্রদ্ধা দুলালবাবু এভাবেই নিজগুণে পেয়ে এসেছেন; চলচ্চিত্র যতদিন বেঁচে থাকবে, ইতিহাস ততদিন স্মরণে রাখবে তাঁর অবদান। কেননা, দুলালবাবুর কাজ আলোকবর্তিকার মতো সমসময়কে পথ দেখিয়েছে, বর্তমানকে দেখাচ্ছে, আগামিকেও দেখাবে

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...