সতীপীঠঃ শ্রীহট্টের দেবী 'জয়ন্তী' একদা নররক্তে পূজিতা হতেন

বর্তমান বাংলাদেশের শ্রীহট্ট। সেখানে রয়েছে ‘জয়ন্তীয়া’ নামের জনপদ। এই জনপদেই রয়েছে সুপ্রাচীন ও সুবিখ্যাত এক সতীপীঠ। পীঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নাম, ‘জয়ন্তী’। পীঠস্থানটি পূর্বে ঘন অরণ্যে আবৃত ছিল। পাঁচশো বছর আগে এক অলৌকিক ঘটনার মধ্য দিয়ে দেবী এইস্থানে সাধারণের সামনে প্রকাশিত হন। তখন দেবীর পীঠ ঘিরে গড়ে ওঠে জনপদ। কালক্রমে দেবীর নামেই পীঠস্থানসহ সমগ্র জনপদটি ‘জয়ন্তী’ বা ‘জয়ন্তীয়া’ নামে পরিচিত হয়েছে। এই স্থানটিতে দেবীর উপস্থিতির কথা তন্ত্রগ্রন্থ ‘তন্ত্রচূড়ামণি’-তে বর্ণিত হয়েছেঃ

‘জয়ন্ত্যাং বামজঙ্ঘা চ জয়ন্তী ক্রমদীশ্বরঃ’।

সংস্কৃত এই শ্লোকাংশটির অর্থ, জয়ন্তা বা জয়ন্তীয়া নামক স্থানে দেবীর বামজঙ্ঘা বা বাম ঊরু পতিত হয়েছিল। এখানে দেবীর নাম, ‘জয়ন্তী’ এবং তাঁর ভৈরবের নাম ‘ক্রমদীশ্বর’।

ভক্তদের বিশ্বাস যে, ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হওয়ার পর জয়ন্তীয়ার অরণ্যে দেবীর বাম ঊরু পতিত হয়ে তা চতুষ্কোণ শিলায় পরিণত হয়। সেই পৌরাণিক কাল থেকে দেবী শিলারূপে এই অরণ্যে গুপ্তভাবে অবস্থান করে প্রকাশিত হলেন আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে। দেবীর এই সাধারণের সামনে প্রকাশিত হওয়ার ঘটনাটি যেমন অলৌকিক, তেমনই বীভৎস।

তখন জয়ন্তীয়ার এই বিস্তৃত পাহাড় ও অরণ্যঘেরা অঞ্চলের রাজা ছিলেন বড়গোঁসাই। রাজা ছিলেন ঘোর শাক্ত। তন্ত্রাচারে বিশ্বাসী। রাজগুরুও ছিলেন একজন ঘোরতর তান্ত্রিক। রাজা এবং গুরুদেবের কাছে হামেশাই নানান তান্ত্রিকের আনাগোনা চলত। রাজ্যের প্রজারা আর-পাঁচটা রাজ্যে যেমনভাবে শোষিত, শাসিত বা অবহেলিত হয়; সেভাবেই হচ্ছিল। ব্যাপারটা এতটাই গা-সওয়া হয়ে উঠেছিল যে, তা নিয়ে রাজা বা প্রজা কারও কোন হেলদোল ছিল না। অরণ্যঘেঁষা জনপদের বালকেরা ছোট থেকেই রাখালিকেই আপন কর্তব্য বলে বুঝে গিয়েছিল এবং তাতেই অভ্যস্ত ছিল।

তা, ছেলেরা জঙ্গলের ভেতরে গাইগরুদের চরতে ছেড়ে গাছে চড়ত, বুনো ফল খেত, বুনো ফুল তুলত, জঙ্গলের ভেতরের স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠা দীঘিতে ঝাঁপ দিয়ে চান করত, সাঁতার কাটত। নানান খেলা খেলত। এমনিভাবেই তাদের দিন কাটত। কিন্তু হঠাৎ তার মধ্যেই একদিন ঘটে গেল এক অদ্ভুত ঘটনা।

সে-বার রাজবাড়ির শক্তিপুজো দেখতে গেল ছেলেরা তাদের বাপমায়ের সঙ্গে। দেখল কী জাঁক, কী জমক! কত লোক! পুজোয় রাশি রাশি ফুল, মালা, নৈবেদ্য, কতশত ছাগ, সমবেত সকলের সামনে হাঁড়িকাঠে তাদের বলি দেওয়া, ছাগবৃন্দের ত্রাহি চিৎকার, থিকথিকে রক্ত—এসব দেখে তারা একেবারে বিহ্বল হয়ে গেল। যে ব্যাপার বিহ্বল করে, মানুষমাত্রেরই সেটা নকল করতে ইচ্ছে করে। এই সব ছেলেদেরও ইচ্ছে জাগল পুজো পুজো খেলার। তাদের সেই নিত্যদিনের খেলার স্থল; জঙ্গলের ভেতরের দীঘির পাড়ে আয়োজন হল খেলার। পাড়ে ছিল চতুষ্কোণ এক প্রস্তরখণ্ড, তাকেই দেবী হিসেবে সাজিয়ে নিল তারা—বনের ফুল দিয়ে, বুনোগাছের পাতা দিয়ে। সিঁদুর ফল ঘষে সেই পাথরের বুকে এঁকে দিল লাল চিহ্ন। তারপর দীঘির জলে স্নান করে শুরু করল নিজেদের মতো করে পুজো। সেই বালকদের সরল, সহজ অথচ আন্তরিক পুজোয় বহুবছর ধরে সুপ্তদেবীর যেন নিদ্রাভঙ্গ হল। এই অবসরে বালকেরা শক্তিপুজোয় দেখে আসা বলিদানের বিষয়টিও অভিনয় ও অনুকরণ করতে গেল। একটি বালক ছাগ হয়ে ‘ম্যা ম্যা’ করে ডাকতে লাগল, যেমন আর্তনাদের ডাক সে শুনেছিল রাজার পুজোয়। আর একটি বালক কুশের খড়্গ তৈরি করে তাকে বলি দিতে উদ্যত হল। এ তাদের কাছে নিছক খেলা, বাস্তবের অনুকরণ। কিন্তু ব্যাপারটা এইখানে এসে আর খেলা রইল না, হাতের কুশখড়্গ যেই না বালকটি ছাগ-সাজা বালকের ঘাড়ে ছুঁইয়েছে, অমনি সেই ছাগ-সাজা বালকের ধড় ও মুণ্ড আলাদা হয়ে গেল! রক্তে ভেসে গেল ধরাতল! 

সকলে এই আচম্বিত বীভৎস ঘটনায় হতচকিত হয়ে গেল। কুশের খড়্গে এভাবে কারও মুণ্ডপাত করা যায় না। তবে কী করে এটা হল! কেন ঘটল এমন অনভিপ্রেত ঘটনা! ঘটনার আকস্মিকতায় বালকেরা সকলে যেন অচেতন পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল। তারপর একটু একটু চেতন আসতেই দারুণ অনুশোচনা মনে জাগল, মনে হলঃ এ আমরা কী করে ফেললাম! হাত-পা থর থর করে কাঁপতে শুরু করল। ভীষণ ভয় চেপে বসল সমস্ত অঙ্গে। ভয় পেলে বা কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেললে বালকেরা আর দাঁড়ায় না অকুস্থলে, এরাও তাই ছুট দিল বাড়ির দিকে।

ঘটনাটা গভীর জঙ্গলে ঘটলেও জঙ্গলের গভীরতায় হারিয়ে গেল না। ঠিক জানাজানি হয়ে গেল খানিকক্ষণের মধ্যেই। অমনি হুলুস্থূল উঠল রাজ্যময়। খবর শুনে রাজা বড়গোঁসাই-ও নড়েচড়ে বসলেন। তান্ত্রিক গুরুদেবকে নিয়ে তিনি সদলে হাজির হলেন অকুস্থলে, ব্যাপারটা-কী দেখতে। দেখে গুরুদেব ও তিনি বুঝলেন যে, বিষয়টা একেবারেই সাধারণ না। এর মধ্যে লুকিয়ে আছে কোন গূঢ় রহস্য। গুরুদেব বসলেন ধ্যানে। ধ্যানে বুঝলেন যে, বালকদের পূজিত শিলা কোন সাধারণ শিলা নয়, তা হচ্ছে দেবী সতীর বাম জঙ্ঘার শিলাভূত রূপ। সেই রূপে স্বয়ং আদ্যাশক্তি ‘জয়ন্তী’ নামে বিরাজ করছেন। এতদিনে দেবী পুজো পেয়ে সুষুপ্তি থেকে জাগরিত হয়েছেন, তাই প্রদত্ত প্রতীকী বলি গ্রহণ করে নিয়েছেন। এ-কথা শুনে রাজা তো সানন্দে অধীর হলেন। তাঁর রাজ্যে দেবী আদ্যাশক্তি স্বয়ং জাগরিত হয়েছেন! তবে তো তাঁকে এই অরণ্যে একাকী রাখা যাবে না! তিনি যে তাঁর ইষ্টদেবী। তাঁকে তো রাজবাড়িতে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

রাজার আদেশে তাঁর লোকলস্কর এল সেই পাথরকে জঙ্গল থেকে নিয়ে গিয়ে রাজবাড়ির চৌহদ্দিতে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, পাথরটি অনেক লোক অনেক প্রচেষ্টার পরও একচুল নড়াতে পারল না। সেটা দেখে গুরুদেব রাজাকে বললেন যে, দেবী স্বয়ং চান না এই স্থান থেকে অন্য কোথাও গিয়ে অধিষ্ঠিত হতে। এটিই তাঁর পীঠভূমি। তাঁকে এখানেই প্রতিষ্ঠিত করা হোক।

গুরুদেবের কথায় রাজা পীঠভূমির জঙ্গল পরিষ্কার করিয়ে মন্দির তৈরি করালেন। দেবীকে মহাসমারোহে বিধিমতে প্রতিষ্ঠিত করলেন। সবই হল, কিন্তু এই দেবীর পূজায় একটা অত্যন্ত নৃশংস ঘৃণ্য প্রথা চালু রয়ে গেল প্রায় তিনশো বছর ধরে। দেবীর বিশেষ পূজায় এই মন্দিরে নরবলি হত। ভিন রাজ্য থেকে লোক ধরে এনে কিংবা টাকাপয়সার লোভ দেখিয়ে বিভিন্ন সময়ে এই মন্দিরে নরবলি হয়েছে। আর প্রচার করা হয়েছে, এ-সব মানুষ দেবীর চরণে নিজেকে উৎসর্গ করতে স্বেচ্ছায় এসেছে! এই অমানবিক ও ঘৃণ্য প্রথা রদ হয় ইংরেজ আমলে এসে। ১৮৩২ সালে রাজা রাজেন্দ্র সিংহ নওগাঁ থেকে কয়েকজন প্রজাকে ধরে এনে দেবীর থানে বলি দেন। এই নৃশংস ঘটনার কথা যায় ইংরেজ সরকারের কানে। সরকার রাজাকে রাজ্যচ্যুত করে শাস্তি দেয় এবং তখন থেকেই এখানে নরবলি বন্ধ হয়।

দেখুন কিংবদন্তি থেকে আসল ইতিহাস খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত সুকঠিন। বালকদের গল্পে কুশের খড়্গে ছাগ-সাজা বালকের মুণ্ডচ্ছেদের ঘটনাটি পাঁচশো বছরের ইতিহাসে একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। যেহেতু রাজা ও তাঁর গুরুদেব তান্ত্রিকক্রিয়ায় আসক্ত ছিলেন এবং তাঁদের সঙ্গে বিবিধ তান্ত্রিকদের নিত্য যোগাযোগ ছিল; এখান থেকেই অনুমান করা যায় যে, একটা মিথ বা পুরাণকথা নির্মাণের জন্যই এ-তাঁদেরই কারোর মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে থাকতে পারে গূঢ় তান্ত্রিকপ্রক্রিয়ার অঙ্গ হিসেবে। পরে সেটা ঢাকতেই রাখালদের গল্পের সঙ্গে জুড়ে প্রচার করা হয়েছে। দেবী যদি সত্যিই নরবলি চাইতেন, তাহলে রাজার রাজ্যপাট বিজাতীয়র হাতে এভাবে অগৌরবের সঙ্গে নষ্ট হয়ে যেত না।  

যাই হোক, রাজা গেছেন। রাজ্যপাট গেছে। কুপ্রথা গেছে। দেশভাগ হয়েছে। দেবস্থানের জৌলুস ফিকে হয়েছে। তবু জয়ন্তীয়ায় দেবীর মন্দিরটি আজও কোনরকমে টিকে রয়েছে। মন্দিরের গর্ভগৃহে একটি ছোট্ট গর্তের মধ্যে চারকোণা কালো পাথরটি রয়েছে, যেটিকে শিলাভূত সতীঅঙ্গ মনে করা হয়। ভক্তেরা মনে করেন যে, এই এক পাথরেই দেবী জয়ন্তী এবং তাঁর ভৈরব ক্রমদীশ্বর একত্রে অবস্থান করছেন। স্বাভাবিকভাবেই এখানে দেবীর ভৈরবের জন্য আলাদা কোন মন্দির নেই।

তবে দেবীর আত্মপ্রকাশ-কাহিনির সেই প্রাচীন দীঘিটি আজও রয়েছে মন্দিরের পাশে। পাঁকবিহীন প্রস্তরবহুল স্থানের দীঘিটিতে অল্প জল থাকলেও স্বাভাবিকভাবেই তা ঘোলা হয় না। অনেকেই এই ঘোলা না-হওয়ার মধ্যে দেবীর কৃপা খোঁজেন। অলৌকিকতা খোঁজেন। আসলে কিন্তু এটা একটা সাধারণ ঘটনা।...                                     

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...