রাজস্থানের পুষ্করতীর্থ। শক্তিময়ী মা অসীম বালুরাশি ও রুক্ষ্ম পার্বত্যময় ভূমিতে একটুকরো শান্তির আশ্রয় নিয়ে যেন আমাদের জন্য অপেক্ষা করেন। ‘মহাভারত’-এ যেমন এই প্রাচীন তীর্থের কথা উল্লিখিত আছে; তেমনি অজস্র কিংবদন্তিতে পরিকীর্তিত হয়েছে এই তীর্থের গুণগাথা। এই তীর্থ একদিকে যেমন প্রজাপতি ব্রহ্মার পবিত্র যজ্ঞভূমি, তেমনি দেবী সতীর অঙ্গপতনে সৃষ্ট একান্ন শক্তিপীঠের অন্যতম দুই অঙ্গের এক পীঠ।
পুষ্কর তীর্থের উৎপত্তির যে প্রাচীন পুরাণঘেঁষা জনশ্রুতি প্রচলিত আছে, তাই-ই প্রথমে বলে নিইঃ
একদা দেবর্ষি নারদ পরমপিতা ব্রহ্মার কাছে উপস্থিত হয়ে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জগতের মঙ্গলের জন্য একটি প্রার্থনা জানালেন। বললেন এমন এক পবিত্র হ্রদ গড়ে দিতে, যেখানে ভক্তজন অবগাহন করে সমস্ত কলুষ সমস্ত পাপ ধুয়ে পরিশুদ্ধ হতে পারেন। পরমপিতা পুত্রের এই প্রার্থনা শুনে বেশ তুষ্ট হলেন। অবলোকন করলেন পৃথিবীর পানে। ভারতভূমির দিকে। দেখলেন, রাজস্থানের বালুময়ভূমিতে শুদ্ধ ও অবিরল জলের বড় প্রয়োজন। এখানে পুত্রের কথামতো হ্রদ নির্মাণ করলে তা মানবের সমস্ত রকম প্রয়োজন সিদ্ধ করবে। এ-কথা ভেবে ব্রহ্মদেব আপন হাতের লীলাপদ্ম ভূমিতে নিক্ষেপ করলেন। সেই পদ্ম বালু ও প্রস্তরময় ভূমিতে পতিত হয়ে রাবারের বলের মতো তিনবার পড়ল-উঠল-পড়ল; আর তাতেই তিনটি বিশাল সুপেয় ও সুমিষ্টজলের পবিত্র হ্রদের সৃষ্টি হল। অন্তর ও বাহির শুদ্ধিকরণের জন্য মানবের প্রতি এই পুষ্করিণীসকল উৎসর্গ করা হল। কিন্তু মানব কোথায়, তারা তো এই পবিত্র হ্রদের খোঁজ করল না!
তারপর বহুযুগ কেটে গেল। দেবী সতী স্বামীর অপমান সইতে না-পেরে কনখলে পিতা প্রজাপতি দক্ষের যজ্ঞস্থলে আত্মত্যাগ করলেন। তাঁর শবদেহ কাঁধে নিয়ে শিব তাণ্ডব নৃত্য শুরু করলেন। শিবকে থামানোর জন্য ব্রহ্মার পরামর্শে ভগবান বিষ্ণু দেবী সতীর দেহ সুদর্শনে কর্তিত করে তাঁকে মহেশের অঙ্গ থেকে বিচ্যুত করতে চাইলেন। এভাবে দেবী সতীর অঙ্গ হল একান্নটি খণ্ডে বিভক্ত। এই খণ্ডগুলি যেখানে যেখানে পতিত হল, সেখানে সেখানে একটি করে সতীপীঠ গড়ে উঠল। আমাদের আলোচ্য পুষ্কর তীর্থে পতিত হল দেবীর দুই হাতের মণিবন্ধ। একটি পড়ল পাহাড়ের পাদদেশে, অপরটি পড়ল পাহাড়ের ওপর, চূড়ায়। দুই স্থানেই দেবী সতীর দেহের অংশ পতিত হয়ে শিলায় পরিণত হল।
তারপর বহুযুগ কেটে গেল। তবু ব্রহ্মা নির্মিত তীর্থ বা সতীপীঠ—দুই-ই সাধারণের গোচরে এলো না। এটা দেখেই এক কার্তিকের পূর্ণিমা তিথিতে ব্রহ্মার আন্তরিক ইচ্ছে জাগল দারুণ এক যজ্ঞ করে তাঁর নির্মিত পবিত্র পুষ্করিণী ও সতীতীর্থকে পবিত্র-গন্তব্য হিসেবে জনসাধারণের সামনে তুলে ধরতে। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। শুরু হয়ে গেল যজ্ঞের আয়োজন। তাবড় তাবড় ঋষিদের ঋত্বিক হিসেবে নিয়োগ করে ব্রহ্মা নিজে ব্রতী হলেন। যজ্ঞের আসনে বসে তাঁর মনে পড়ল স্ত্রী ছাড়া তো এই যজ্ঞ কিছুতেই সম্পন্ন হবে না। অথচ আপন স্ত্রী সাবিত্রীকে তিনি এই যজ্ঞে আমন্ত্রণই জানাননি! ব্যাপারটা মাথায় আসতেই অমনি তিনি সাবিত্রীকে ডেকে আনতে আদেশ দিলেন। কিন্তু ব্রহ্মা যেহেতু তাঁকে প্রথমে গুরুত্ব দেননি; তাই সাবিত্রী আসবেন বলে কথা দিয়েও তাঁকে জব্দ করার জন্য অযথা দেরি করতে লাগলেন।
এদিকে সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে দেখে ব্রহ্মা খুব অস্থির হয়ে উঠলেন। সাবিত্রীর জন্য যজ্ঞ পণ্ড হবে, এটা তিনি কিছুতেই মেনে নেবেন না। তাই সাবিত্রী আসছেন না দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন দ্বিতীয় বিবাহের। বিবাহ তিনি এক্ষুনি করবেন। তাই ইন্দ্রকে আদেশ দিলেন সত্ত্বর কোন ব্রাহ্মণ কন্যাকে খুঁজে আনার জন্য। ইন্দ্র খুঁজে পেতে এক গোয়ালার কন্যাকে পেলেন। গাভীযোনি ভ্রমণ করে এলে শাস্ত্রমতে গোয়ালার কন্যাও ব্রাহ্মণকন্যার মর্যাদা পান। সেই কথা মাথায় রেখে ইন্দ্র গোয়ালাকন্যাকে এক গাভীর মুখ দিয়ে প্রবেশ করিয়ে তার জন্মদ্বার দিয়ে বের করে আনলেন। এবং কন্যা যেহেতু গাভীযোনি পরিক্রমার মধ্য দিয়ে তথাকথিত শুদ্ধা হয়েছে, তাই তিনি তাঁর নাম দিলেন, ‘গায়ত্রী’। ব্রহ্মা আর বিলম্ব না-করে গায়ত্রীকে বিবাহ করে যজ্ঞ শুরু করলেন।
ওদিকে বিবাহের খবর পেয়েই তড়িৎগতিতে সেখানে উপস্থিত হলেন সাবিত্রী। তিনি প্রচণ্ড ক্রোধে বিরাট আকার ও ভীষণ রূপ ধারণ করে সমস্ত লণ্ডভণ্ড করে ফেলতে চাইলেন। এক পা পাহাড়ের গায়ে রেখে অন্য পা সানুদেশে স্থাপন করে সমস্ত তীর্থভূমি বিনষ্ট করতে চাইলেন। এবং উপস্থিত সকলের প্রতি ক্রূরবাণী বর্ষণ করতে শুরু করলেন। তখন ‘ত্রাহি ত্রাহি’ রবে ব্রহ্মাসহ সমস্ত দেবতারা তাঁকে স্তবে ও ধ্যানে তুষ্ট করে বহু আয়াসে তাঁর ক্রোধ প্রশমিত করতে সচেষ্ট হলেন। দেবতা ও ঋষিদের আকুতিতে শেষ পর্যন্ত দেবী তুষ্ট হলেন। পবিত্র এই ভূমিকে আরও পবিত্র করে তুলতে এই ভূমিকে রক্ষার ভার নিয়ে জগতের মঙ্গলের জন্য পাহাড়ের ঊর্ধ্বদেশে দেবী সতীর এক মণিবন্ধের অধিষ্ঠাত্রী ‘দেবী সাবিত্রী’ রূপে বিরাজিত হলেন চিরকালের জন্য। আর পাহাড়ের নীচে পতিত মণিবন্ধের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে অবস্থিতির জন্য দেবতারা অনুরোধ করলেন দেবী গায়ত্রীকে। ব্রহ্মার উপদেশে দেবী গায়ত্রী দেবতাদের কথায় সম্মত হলেন। এভাবেই ব্রহ্মার কৃপায় ও কর্মে পুষ্করতীর্থ দুই সতীপীঠ সাকার দেবীমূর্তি পেয়ে ধন্য হল।
পৌরাণিক যুগের এই প্রতিষ্ঠা পর্বের পর আরও বহু বহু কাল অতিক্রান্ত হয়ে গেল। কত ভক্ত, কত ভক্তির স্রোত বয়ে গেল এই তীর্থের ওপর দিয়ে। তারপর কালের নিয়মে বিভিন্ন মতাবলম্বী রাজাদের উন্নাসিকতায় এই তীর্থের কথা জনমানসেও ক্রমে ফিকে হতে শুরু করল। অতঃপর একদিন এল বিস্মৃতির কাল।
তখন ব্রহ্মার নির্মিত পবিত্র তিন পুষ্করিণীর মধ্যে একটি বারংবার বালুঝড়ের প্রকোপে মজে গিয়েছে। বাকি দু’টির অস্তিত্ব ক্ষীণ। তীর্থ ভূমিও বালুতে উদ্ভুত কাঁটাগাছে অরণ্যময়। সেই অরণ্যে একদা শিকার করতে এলেন মন্দুরের পুরিহরবংশের রাজা লহোরা। এই ভূমিতে তাঁর আসার কথা ছিল না, যেন নিয়তি নিয়ে এল। এক বুনো শূকরের পিছু ধাওয়া করতে করতে তিনি এখানে উপস্থিত হলেন। তৃষ্ণায় তাঁর গলা শুকিয়ে গেছে, বুকের ছাতি ফাটছে। অত্যন্ত অবসন্ন ও ক্লান্ত। রাজার সঙ্গীসাথী কেউ নেই। রাজা পরিত্যক্ত, একাকী। কারণ, তাঁর সর্বাঙ্গে কুষ্ঠের বিকার। সেকালে এই রোগ হলে শিক্ষিত মানুষেরাও অশিক্ষিতের মতো রুগিকে পরিত্যাগ করত। রাজার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আহারের জন্য শিকার প্রয়োজন, আর এই মুহূর্তে বাঁচার জন্য প্রয়োজন জল। ঠিক এই সময়ই তাঁর চোখে পড়ল ব্রহ্মার সৃষ্টি সেই মজে যাওয়া পুষ্করিণী। রাজা পুষ্করিণীর জল বুক ভরে পান করে তৃষ্ণা মেটালেন, জলে অবগাহন করে অবসন্নতা দূর করলেন। আর সেটা করতে গিয়ে রাজা অবাক হয়ে গেলেন, একী, অবগাহনের সঙ্গে সঙ্গেই যে তাঁর অঙ্গের সমস্ত কুষ্ঠচিহ্ন উধাও হয়ে গেছে! এটা দেখে রাজা একইসঙ্গে পরম আনন্দিত, উল্লসিত ও আশ্চর্য চকিত হলেন। বুঝলেন এই পুষ্করিণী সামান্য নয়, এর মধ্যে কোন দৈব যোগ রয়েছে। তখন পণ্ডিতদের মতামত নিয়ে তিনি পুষ্করিণীর সংস্কার করিয়ে দেবীপীঠ উদ্ধার করিয়ে পুষ্করের পবিত্র মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা করলেন।
আসল কথা হল, এ-সবই দেবীদের বা স্থান মাহাত্ম্য প্রচারের অলৌকিক গালগল্পমাত্র। রাজা ঐতিহাসিক এবং তাঁর এই তীর্থরক্ষার কাহিনিতেও হয়তো সত্যতা রয়েছে; কিন্তু কুষ্ঠনিবারণের কাহিনি নিতান্তই জনশ্রুতি। একমাত্র কিছু মনের রোগ ছাড়া আর কোন রোগই দৈব উপায়ে সারে না। এ-বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকা উচিত এবং কাহিনিকে কাহিনি হিসেবে দেখাই শ্রেয়। কেননা, কুসংস্কার ছড়ানো এ-লেখার উদ্দেশ্য একেবারেই নয়।
যাই হোক, পুষ্করতীর্থ বর্তমানে পর্যটক বা ভক্তজনের ব্যাপক সমাগমে বছরের বিভিন্ন সময়ে এক্কেবারে জমজমাট থাকে। পাহাড়ের নীচে গায়ত্রী দেবী সাধারণের কাছে ‘চামুণ্ডা মাতা’ নামে প্রসিদ্ধা। দেবীর মন্দির এক চূড়া বিশিষ্ট। লাল রঙে আবৃত। পাহাড়ের ওপরের দেবী কিন্তু ‘সাবিত্রী’ নামেই সকলের কাছে পূজিতা হন। পাহাড়ে ওঠার জন্য রোপওয়ে যেমন আছে, তেমনি রয়েছে হেঁটে ওঠার সুন্দর ব্যবস্থা। রয়েছে প্রশস্ত সিঁড়ি। বিশ্রামের স্থান। পাহাড়ের ওপর মন্দির বেশ প্রশস্ত। দুই মন্দিরই কিন্তু খুব বেশি প্রাচীন নয়। দুই দেবীই প্রস্তর নির্মিত, অলঙ্কারে সজ্জিতা। তাঁদের দুজনেরই সৌম্য আয়ত চোখ। আমরা কিংবদন্তি কাহিনিতে দেবীর যে ভয়ংকর রূপের পরিচয় পাই, মূর্তিতে তার ছোঁয়া নেই। দেবীমূর্তিরা ফুট দেড়েক উচ্চতাবিশিষ্ট। কিন্তু তাঁদের রূপে অদ্ভুত এক সম্মোহনী শান্তি আছে, অপরূপ এক আশ্রয় আছে তাঁদের স্মিত মুখে শান্ত দুই চোখে। আর এই আশ্রয়ের টানেই যেন ভক্তজন শত কষ্ট কঠিন পথ অতিক্রম করে ছুটে যান এই তীর্থে, মায়ের মন্দিরে। আসলে, অনাবিল সেই শান্তি আর আশ্রয়ের খোঁজে আমরা সকলেই তো ঘুরে মরছি, তাই না?...