শারদাপীঠের দেবী ভাদ্রের শুক্লা অষ্টমী তিথিতে জাগ্রত হন

‘পীঠনির্ণয় তন্ত্র’ মতে একান্ন সতীপীঠের মধ্যে চতুর্থতমটি কাশ্মীরে অবস্থিত। ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনে খণ্ডিত হয়ে সেখানে দেবী সতীর কণ্ঠ পতিত হয়েছিল। তন্ত্রগ্রন্থটির শ্লোকে লেখা আছে—

‘কাশ্মীরে কণ্ঠদেশশ্চ ত্রিসন্ধ্যেশ্বর ভৈরবঃ।

মহামায়া ভগবতী গুণাতীত বরপ্রদা।।’

অর্থাৎ দেবী এখানে ‘মহামায়া’ নামে পূজিতা; আর তাঁর ভৈরবের নাম, ‘ত্রিসন্ধ্যেশ্বর’।

 

এবার মুশকিলটা হচ্ছে যে, কাশ্মীর তো কোন ছোট্ট জনপদ নয়। বহু প্রাচীনকাল থেকেই একটি বৃহৎ ভূখণ্ড ‘কাশ্মীর’ নামে সুপরিচিত। রাজনৈতিক পালাবদলে তার ইতিহাসও বেশ রোমাঞ্চকর এবং প্রাচীন। ফলে, কাশ্মীরের ঠিক কোথায় দেবীর কণ্ঠ পতিত হয়েছিল, সেই পীঠস্থান আজও নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।

যদিও দেবী সতীর প্রকৃত পীঠের দাবিদার হয়ে রয়েছেন  তিনটি মন্দিরতীর্থ—‘শারদাপীঠ’, ‘অমরনাথ’ এবং ‘ক্ষীরভবানী’। কিন্তু এই তিনটি পীঠের কোনটিতেই আবার দেবীর নাম ‘মহামায়া’ নয়; এবং তাঁর ভৈরবের নামও ‘ত্রিসন্ধ্যেশ্বর’ নয়। তবুও বিভিন্ন তথ্য ও তত্ত্বের আধার সামনে রেখে বেশিরভাগ ভক্তপণ্ডিত ‘শারদাপীঠ’কেই ‘পীঠনির্ণয়’-এর উদ্দিষ্ট চতুর্থ সতীপীঠ হিসেবে গ্রহণ করতে চান।

শারদাপীঠ বেশ প্রাচীন একটি তীর্থ। পাহাড় ঘেরা এই পীঠকে কেন্দ্র যে গ্রাম গড়ে উঠেছিল, সেই গ্রামের নামও হয়ে উঠেছিল ‘শারদা’। মধুমতী নদীর তীরে এই শাক্ততীর্থ গড়ে উঠেছিল। কিন্তু প্রাচীন সেই মধুমতী নদীর নাম কালের চক্রে পরিবর্তিত হয়ে হয়েছে ‘নীলম’।

এই পীঠ এখন পাক অধিকৃত কাশ্মীরে অবস্থিত। ১৯৪৭ সালের আগে পর্যন্ত এখানে কাশ্মীরের পণ্ডিত সম্প্রদায়ের মানুষ তো বটেই; সারা ভারতের তীর্থপ্রেমী ভক্তেরা এই পীঠ দর্শন করতে যেতেন। প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শুক্লা অষ্টমী তিথিতে তাঁরা এই মন্দিরতীর্থে অবশ্যই আসতেন। এই সময়টি ভারি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, মানুষের বিশ্বাস, এই সময় দেবী জাগ্রত হন। এ-সময় পুজো করলে তিনি সহজেই কৃপা করেন। এই বিশ্বাসের পেছনে রয়েছে এই তীর্থ গড়ে ওঠার কিংবদন্তি।

কিংবদন্তি অনুযায়ী, এই তীর্থ গড়ে উঠেছিল ঋষি পুলস্ত্যের তপস্যার ফলে। তখনও দেবী সতীর কণ্ঠের শিলারূপ আবিষ্কৃত হয়নি। দেবীর পীঠও গড়ে ওঠেনি। ফলে, পুলস্ত্য জ্ঞানলাভের জন্য দেবী সরস্বতীর অনুগ্রহ পেতে তাঁকে তুষ্ট করার জন্য না-জেনেই এই পীঠে উপস্থিত হন। তপস্যার পূর্বে পুণ্যসলিলা গঙ্গায় অবগাহনের জন্য পুলস্ত্য তাঁকে আবাহন করেন। তাঁর প্রার্থনায় তুষ্ট হয়ে দেবী গঙ্গা হিমালয়ের বুক চিরে প্রবাহিত হন। তখন তাঁর জলে স্নান করে পুলস্ত্য তপস্যায় বসেন। তারপর দীর্ঘ তপস্যার শেষে দেবী ভাদ্র মাসের শুক্লা অষ্টমী তিথিতে পুলস্ত্যকে কৃপা করেন। নেমে আসেন রাজহংসের রূপ ধরে। বলেন দেবী সতীর পতিত অঙ্গে পবিত্র এই পীঠের কথা। তারপর পুলস্ত্যকে কৃতার্থ করে দান করেন জ্ঞানের ভাণ্ডার।

ক্রমে পুলস্ত্যের মুখ থেকে দেবী সতীর পীঠকথা প্রচারিত হয়। আবিষ্কৃত হয় শিলা। পুণ্যক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয় শক্তিমন্দির। কিন্তু পুলস্ত্য যেহেতু দেবী সরস্বতীর কাছ থেকে অনুগৃহীত হয়েছিলেন, তাই সরস্বতীকেই তিনি শক্তিরূপে পূজা করতে শুরু করেন। সরস্বতী বিদ্যার দেবী, তাই মন্দির হয়ে ওঠে স্বাভাবিকভাবেই জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র।  

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় আট হাজার উচ্চতায় অবস্থিত শারদাপীঠ শাস্ত্র ও জ্ঞানচর্চার অন্যতম পীঠস্থান হিসেবে এতটাই বিখ্যাত ছিল যে, সপ্তম শতকে হিউয়েন সাং এই পীঠে কিছুদিন জ্ঞানচর্চার জন্য অধিষ্ঠান করেছিলেন। কলহন, শঙ্করাচার্য প্রমুখ পণ্ডিত ও সাধকের জ্ঞানক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল এই পীঠ। কলহন তাঁর ‘রাজতরঙ্গিণী’ গ্রন্থে এই পীঠভূমিকে ‘শারদা দেশ’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। দ্বাদশ শতকের বিদেশি পর্যটক আল-বিরুনীর রচনায় এই পীঠের পরিচয় পাওয়া যায়। পরিচয় পাওয়া যায় মুঘল যুগের পণ্ডিত আবুল ফজলের রচনাতেও।

চোদ্দ শতকে মুসলিম আক্রমণের আগে পর্যন্ত শাক্তপীঠ হিসেবে জ্ঞানপীঠ হিসেবে শারদাপীঠ ছিল গৌরবের কেন্দ্র। কিন্তু এই সময় সুলতান সিকান্দারের হিন্দু মন্ত্রী শুহভট্টের নেতৃত্বে এই পীঠের ব্যাপক ক্ষতি হয়। আগেই বলেছি যে, এই পীঠে দেবী সরস্বতীরূপে পূজিতা হতেন। কলহনের রচনা থেকে জানা যায় যে, মন্দিরে দেবীর একটি অপূর্ব সুন্দর কাষ্ঠনির্মিত মূর্তি অর্থাৎ দারুবিগ্রহ ছিল। মূর্তির পিছনের চালচিত্র ছিল সোনায় নির্মিত। সে-সব এই আক্রমণে লুঠ ও ধ্বংস হয়ে যায়।

উনিশ শতকে রাজা গুলাব সিং সেই ভগ্ন মন্দিরের কিছু কিছু সংস্কার করেন। তখন মন্দিরে পূজিত হত একটি চারকোনা শিলাখন্ড, সতীকণ্ঠের শীলারূপ হিসেবে। গুলাব সিং-এর ব্যবস্থাপনায় শাক্তভক্তেরা এই পীঠে পুজো ও তীর্থের জন্য পাক অধিকারের আগে পর্যন্ত যাতায়াত করতেন।

পাক অধিকৃত হওয়ার পর এই মন্দির-সংলগ্ন অঞ্চল প্রথমে পাশ্তুন উপজাতিদের দখলে চলে যায়। তখন পূজারিদের দলটি এই অঞ্চল ছেড়ে চলে যায়। এবং তখন থেকেই মন্দির প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। পরে এই দীর্ঘ সময় ধরে মন্দিরটি দেখভাল করেন স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। তারই মাঝে ২০০৫ সালের এক ভূমিকম্পে এই মন্দির প্রায় ভেঙে পড়ে, ভেঙে পড়ে তার চারপাশের প্রাচীরও।

২০০৭ সালে পাকিস্তান সরকারের কাছে কাশ্মীরী পণ্ডিতদের একটি দল এই মন্দির দর্শন করতে চেয়ে আবেদন জানান, কিন্তু তাঁদের আবেদন খারিজ হয়ে যায়। ২০১৭-১৮-এর একটি খবরে দেখা যায় যে, মন্দির এলাকার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁদের উদ্যোগের কথা জানতে পেরে মন্দির চত্বরের মাটি তুলে পৌঁছে দেন কাশ্মীরী পণ্ডিতদের সেই দলটির হাতে।  এটা তাঁদের অসাধারণ এক সৌভ্রাতৃত্বমূলক মানসিকতার পরিচায়ক।

যাই হোক, সরকারি তরফে উদ্যোগের ফলে গত বছর কয়েকজন তীর্থযাত্রী ভগ্নমন্দিরে গিয়ে ভাদ্রমাসের বিশেষ দিনটিতে দেবীর উপাসনা করে এসেছিলেন। এ-বছর তাঁরা সেই স্থানে নতুন একটি মন্দির তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন; উদ্যোগ নিয়েছেন লুপ্ত তীর্থকে পুনরুদ্ধার করে আবার সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে...                                               

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...