সতীপীঠঃ সীতাদেবীর জন্মভূমি মিথিলায় রয়েছেন অভয়দাত্রী মা ‘উমাদেবী’

বিহারের ‘মিথিলা’ আমাদের বড় পরিচিত স্থাননাম। এই স্থান আমাদের শ্রদ্ধার উদ্রেক করে। এই স্থানের সঙ্গে আমাদের এমন শ্রদ্ধাশীল করে তোলার মূলে ভারতের প্রাচীনতম মহাকাব্য বাল্মীকি রচিত ‘রামায়ণ’-এর অবদান রয়েছে। এই গ্রন্থ থেকেই আমরা জানতে পারি যে, এই স্থান ভগবান বিষ্ণুর অন্যতম অবতার পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্রের পত্নী সীতাদেবীর জন্মস্থান। এখানেই হরধনু ভঙ্গ করে সকল বীরের মাঝে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করে শ্রীরামচন্দ্র সীতাদেবীকে বিবাহ করেছিলেন। আমরা সকলেই জানি যে, সীতাদেবী হলেন স্বয়ং মা লক্ষ্মী। আমরা জানি, এসব ত্রেতা যুগের কথা। সেই যুগে মিথিলা সীতাদেবীর পিতা জনক রাজার রাজধানী ছিল। তাই এই স্থানকে ‘জনকপুর’ নামেও অভিহিত করা হয়। এখানে সীতাদেবীর একটি মনোরম মন্দির আছে।

সীতাদেবীর মন্দিরের কাছাকাছি আর একটি মন্দিরের জন্য মিথিলা খুবই বিখ্যাত। সেই মন্দিরেই রয়েছে আমাদের একান্নপীঠের অন্যতম এক সতীপীঠ। এই মন্দির ‘মা উমাদেবী মন্দির’ নামে বিখ্যাত। এই মন্দিরের পীঠস্থানে ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হয়ে দেবী সতীর বাম কাঁধ পতিত হয়েছিল। ‘পীঠনির্ণয়’ তন্ত্রগ্রন্থে স্পষ্টতই বলা হয়েছে যে-

‘মিথিলায়ম্ উমা দেবী বামস্কন্ধো মহোদরঃ’।

শ্লোকাংশটির অর্থ, মিথিলায় দেবী সতীর বামস্কন্ধ পতিত হয়েছিল। দেবী এখানে ‘উমা’ নামে অধিষ্ঠিতা; আর দেবীর ভৈরব মহাদেব এখানে ‘মহোদর’ নামে অধিষ্ঠিত।

সতীপীঠের ওপর গড়ে ওঠা মন্দিরটি পাথরের ছোট্ট টিলার ওপর অবস্থিত। আকারে এই মন্দির সুবিশাল, সুউচ্চ ও এক কথায় অপূর্ব। প্রাচীন এই মন্দিরটির গড়নে দুর্গ ও চারমিনারের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। মন্দিরের মাথায় দুর্গের যেমন প্যারাপিট থাকে, সেই রকম প্যারাপিট রয়েছে। চারপাশে রয়েছে অপূর্ব কারুকাজ করা চারটি চারমিনার। মন্দিরের গায়ে সাদা রঙের বাহার। মাঝে মাঝে মেরুন-সবুজের রঙিন বর্ডার ও নকশা সাদা রঙের বাহারকে আরও বাড়িয়ে এক অসাধারণ সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটিয়েছে। মন্দিরের মূল প্রবেশদ্বার যেমন চওড়া, তেমনি উঁচু। দরজাটি প্রায় একশো ফুট উঁচু। মূল মন্দির ও মিনারের গায়ে আসল ও নকল মিলিয়ে হাজারদুয়ারির মতো অসংখ্য রঙিন দরজা-জানালা। মন্দিরের চারপাশে সবুজের সমাহার। তাতে এই উচ্চতাযুক্ত কারুকৃতির সৌন্দর্য আরও কয়েকগুণ বেড়েছে। মন্দিরের সম্মুখে রয়েছে একটি সুদৃশ্য ও চারদিকে রেলিংঘেরা ফোয়ারা। সন্ধেবেলায় তার সৌন্দর্যই আলাদা। কেননা, ফোয়ারাঘেরা আলোর রঙিন রোশনাই ফোয়ারাঝরা জলে রঙ মিশিয়ে এক অপূর্ব সৌন্দর্য সৃজন করে।

এখানে বলে রাখি যে, উমাদেবীর মন্দিরটি প্রকৃতই একান্নপীঠের সেই পীঠ কি-না, সেখানে সত্যিই দেবীর বামস্কন্ধ পতিত হয়েছিল কি-না-এই নিয়ে মতান্তর রয়েছে। অনেকদিন ধরেই কিছু মানুষের মনে ভুল ধারণা ছিল যে, জানকিমাতার মন্দিরটিই আসল সতীপীঠ। আসলে মন্দিরের প্রাচীনত্ব দেখেই তাঁরা এমন কথা ভাবতেন। এখন অবশ্য সে ভুল ভেঙেছে। অবশ্য বিহারের সহরসাতে অবস্থিত ‘উগ্রতারা মন্দির’কে এখনও অনেকেই একান্ন শক্তিপীঠের একটি বলে মনে করেন। এটি সহরসা স্টেশনের পাশেই অবস্থিত। বিহারেরই সলুনা রেলস্টেশন থেকে নয় কিলোমিটার দূরে যে ‘জয়মঙ্গলা দেবীর মন্দির’ রয়েছে, সেটিকেও আবার অনেকেই মনে করেন যে আসল সতীপীঠ। আবার নেপালের জনকপুরের ‘বনদুর্গা মন্দির’কেও অনেকে আসল সতীপীঠ হিসেবে গণ্য করেন। কিন্তু অধিকসংখ্যক বিশেষজ্ঞদের বিচারে ‘উমাদেবীর মন্দির’ই প্রকৃত সিদ্ধশক্তিপীঠ, একান্নপীঠের অন্যতম পীঠ হিসেবে গৃহীত হয়েছে। মেনে নেওয়া হয়েছে যে, একমাত্র এখানেই দেবী সতীর বামস্কন্ধ পতিত হয়েছিল।

এই উমাদেবীর মন্দিরে দেবী আদ্যাশক্তির মূর্তিরূপে রয়েছেন দেবী দুর্গা। মন্দিরের মূল গর্ভগৃহে কালো পাথরে নির্মিত চালচিত্রসহ চার ফুটের বেশি উচ্চতা বিশিষ্ট দেবীর মূর্তি রয়েছে। দেবী এখানে মহিষমর্দিনী। তাঁর আঠারোটি হাত। তাঁর এই সব হস্তসমূহে রয়েছে বিবিধ আয়ুধ। দেবী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে মহিষাসুরকে বধ করেছেন, তবুও তাঁর মুখমণ্ডলে কিন্তু ক্রোধ বা হিংসার কোন চিহ্নই নেই। চেহারায় যুদ্ধের ক্লান্তিও নেই। তাঁর টানা টানা চোখ অর্ধনিমিলিত। দৃষ্টি নীচের দিকে। ওষ্ঠ-অধরে স্মিত হাসি। দেবী যেন বিঘ্নকারী অসুরকে বধ করে পদতলে স্থিত জগতের শরণাগত ভক্তসন্তানদের দিকে তাকিয়ে এই হাসিতে এই মৃদু কটাক্ষে অভয় দান করছেন। দেবীর মুখমণ্ডল আমাদের সাবেকী মূর্তির মতো গোলাকার নয়, কিছুটা লম্বাটে গড়নের। ঘাড় ঈষৎ অবনমিত। দেবীর মাথায় রতনমুকুট, কণ্ঠে নানাবিধ রতনহার। এবং গলায় ফুলের মালা। দেবীর মূর্তিনির্মাণে প্রাচীন প্রস্তরশিল্পীর অসাধারণ কারুকৃতি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে (যাকে বলে, ‘ডিটেইলস’, তা) বুঝে ওঠার আজ আর তেমন উপায় নেই। কেননা, দেবীর মুখমণ্ডল ও অলঙ্কার ছাড়া সমস্তই রক্তসিঁদুরের প্রগাঢ় প্রলেপে রঞ্জিত।

দেবীকে দর্শন করে পুজো দেওয়া যায় দিনের অনেকখানি সময় ধরে। কেননা, মন্দির সপ্তাহের প্রতিটি দিন সকাল ছ’টা থেকে রাত্তির আটটা পর্যন্ত খোলা থাকে। এই শক্তিপীঠে দুর্গা পুজো, কালী পুজো, নবরাত্রি, দীপাবলি স্বাভাবিকভাবেই খুব ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়। এছাড়াও কার্তিক পূর্ণিমা, অক্ষয় নবমী, শিবরাত্রি, হোলি, নাগপঞ্চমী, জন্মাষ্টমী, রাখিবন্ধন, মধুশ্রাবণী, সরস্বতী পূজা প্রভৃতি পার্বণও খুব জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়। সবচেয়ে বড় কথা, এই স্থান যেহেতু মিথিলাবালা জনকনন্দিনী সীতাদেবীর জন্মভূমি ও শ্রীরামচন্দ্রের লীলাভূমি, তাই এখানে তাঁদের জন্মতিথিও বিশেষ সমারোহের সঙ্গে পালিত হয়। সেই উপলক্ষ্যে বিশেষ উৎসবের আয়োজন করা হয়। রামনবমী, জানকী নবমী (বৈশাখ শুক্লা নবমী)-তে সেই উৎসবে যোগ দিতে এখানে প্রচুর ভক্তজনের সমাগম ঘটে। বিশাল মন্দির প্রাঙ্গণেও তখন আর তিলধারণের স্থান থাকে না।

আসলে, মিথিলায় দেবী আদ্যাশক্তির এই পীঠমাহাত্ম্যের টানে, মন্দিরের অপরূপ সৌন্দর্য দেখে চোখ জুড়োতে এবং বিশেষ বিশেষ পার্বণের সমারোহে শামিল হতে সারা বছরই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তজন এই তীর্থধামে ছুটে আসেন। তারপর ফিরে যান দেবীমাহাত্ম্য বুকে নিয়ে দেবীর আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে আপন আলয়ে; ভাবের ঘর থেকে ভবের ঘরে...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...