সতীপীঠঃ চট্টগ্রামের কন্যাকুণ্ডের বিলুপ্তপ্রায় সতীতীর্থে রয়েছেন রহস্যময়ী 'মা সর্বাণী'

আজ থেকে একশ বছর আগেও গম গম করত কন্যাশ্রম সতীপীঠ। পাণ্ডা-পুরোহিতের রমরমা ছিল। ছিল কামরূপের অধীন। তখনও এই তীর্থ বিদেশ হয়ে যায়নি। কেননা, স্বাধীনতার লগ্ন আসতে এবং ভাগাভাগির পর্ব আসতে তখনও বিস্তর দেরি ছিল। তখনও যাতায়াতের সুব্যবস্থা না-থাকলেও ভক্ত বা তীর্থযাত্রীদের ভিড়ের কমতি ছিল না। কিন্তু এখন এই তীর্থ দুর্গম শুধু নয়, বিস্মৃতপ্রায় এবং বিদেশে অবস্থিত। কেননা, তা এখন বাংলাদেশের অধীন।

বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড উপজেলার কুমিরা খালের কাছে অবস্থিত এই সতীপীঠ। পূর্বে পীঠস্থানটিকে 'কন্যাশ্রম' নামেই ডাকা হত। 'পীঠনির্ণয় তন্ত্র' গ্রন্থে একটি শ্লোকে রয়েছে সেই স্থাননাম ও পীঠকথা--

'কন্যাশ্রমে চ পৃষ্ঠং মে নিমেষো

ভৈরবস্তথা সর্বাণী দেবতা তত্র...।'

অর্থাৎ, এই কন্যাশ্রম তীর্থেই ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হয়ে দেবী সতীর পীঠ বা পৃষ্ঠদেশ পতিত হয়েছিল। দেবী এখানে 'সর্বাণী' নামে বিরাজিতা এবং তাঁর ভৈরবের নাম, 'নিমেষ'।

বহু পূর্বে এই তীর্থস্থানে দেবী সর্বাণীর একটি ইঁটের তৈরি মন্দির ছিল। আর এই মন্দিরের পাশেই ছিল কুমারীকুণ্ড। এই কুণ্ড তখন ছিল ভক্ত-তৈর্থিকদের কাছে এক পরম আকর্ষণের বিষয়। সেই আকর্ষণের বিবরণ এই সময়ের তীর্থযাত্রীদের লেখা থেকে জানা যায়। মন্দির ও আকর্ষণীয় কুণ্ড নিয়ে এটি ছিল একদা অপূর্ব এক তীর্থ। মন্দিরটি কখন ও কীভাবে নষ্ট হল, তার বিশ্বাসযোগ্য বিবৃতি পাওয়া যায় না। শোনা যায়, এক থেকে দেড় শতাব্দী পূর্বের কোন একসময়  এই মন্দিরের পাথরের তৈরি মূর্তি নাকি চুরি যায়। তারপর থেকে মন্দিরে ভক্ত সমাগম কমতে কমতে তা বিস্মৃতির দিকে এগোতে থাকে। স্থানীয়রাও এই তীর্থ সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়েন। এখন এমন অবস্থা যে, স্থানীয় কাউকে না-নিয়ে কিছুতেই এই বিলুপ্তপ্রায় তীর্থভূমিতে যাওয়া যায় না। কুণ্ডের আশেপাশে খুঁজলে এখনও সেই বিনষ্ট মন্দিরের ইঁটের চিহ্ন দেখা যায়।

আজ থেকে একশ বছর আগে বহু কষ্ট স্বীকার করে এই তীর্থে এসেছিলেন গোষ্ঠবিহারী ধর । তিনি তাঁর 'সচিত্র তীর্থ-ভ্রমণ-কাহিনী' গ্রন্থে এই তীর্থভ্রমণের বিবরণ সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করেছেন। সেই বিবরণের কোথাও তিনি দেবীর মন্দিরের উল্লেখ করেননি,  তিনি বর্ণনা করেছেন কুমারীকুণ্ড দর্শনের অভিজ্ঞতা। তাই বলা যায় যে, এই সময়ের বহু আগেই মন্দির বিনষ্ট হয়ে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছিল। তিনি কুমারীকুণ্ড সম্পর্কে যা লিখেছেন, সেটি ঐতিহাসিক বিবরণ। তাই সেটি হুবহু এখানে তুলে দিচ্ছি:

'কুমারীকুণ্ড নামক তীর্থটী এক অদ্ভুত দৃশ্য! ইহা একটি অগ্নিময় জ্বলন্ত জলকুণ্ড। এখানে মন্ত্র উচ্চারণপূর্বক সংকল্পসহকারে জল স্পর্শ করিতে হয়, কেহ বা স্নান করেন; তৎপরে এখানে পিতৃপুরুষদিগের উদ্দেশে তর্পণ এবং দেবতাদিগের উদ্দেশে হোম করিতে হয়। আমাদিগের পুরোহিত ঠাকুর বলিলেন, যাহারা কুমারী কুণ্ড ও বাড়বানলে স্নান করিতে ইচ্ছা করেন, তাহারা উভয় কুণ্ডতেই স্নান করিতে পারেন কিন্তু যাহারা দুই কুণ্ডে স্নান না করিবেন; তাহারা কুমারীকুণ্ডে সংকল্পপূর্ব্বক জল স্পর্শ, তর্পণ ও হোম করিলে একই তীর্থ ফল প্রাপ্ত হইবেন, সন্দেহ নাই। তাঁহার উপদেশ মত আমরা কুমারীকুণ্ডের জল স্পর্শ করিয়া অপরাপর নিয়মগুলি পালনপূর্ব্বকএখান হইতে দুইখানি গোশকট ভাড়া করিয়া বাড়বানলকুণ্ডের পাদদেশে উপস্থিত হইলাম।'

গোষ্ঠবিহারীর বিবরণে দেখাই যাচ্ছে যে, এই তীর্থ বঙ্গবাসীর কাছে কতটা আকর্ষণীয় এবং অবশ্যগম্য ছিল। তাঁর বিবরণের বাইরে এই তীর্থ সম্পর্কে আর কিছু ইতিহাস পাওয়া যায় না। এমনকি মন্দিরটি কেমন ছিল, তাতে অধিষ্ঠিতা দেবী কেমন ছিলেন--তাও জানা যায় না। আসলে, কালের নিয়মে সমস্তই তো লয় হয়, এও হয়েছে। যাই হোক, এই তীর্থের উদ্ভবের মূলে মহাভারতে একটি কাহিনি রয়েছে। আসুন সেটি এখন আপনাদের সংক্ষেপে শোনাই:

সে যুগে গর্গমুনির একটি কন্যা ছিল। সেই কন্যা মনের মতো বর পাওয়ার জন্য শুরু করল এক দীর্ঘ তপস্যা। কন্যা সেই তপস্যায় এতটাই লীন হয়ে গেল যে, তার দিন, মাস, বছর কিছুই খেয়াল রইল না। কিন্তু এদিকে তার বয়সও থেমে রইল না। সে তপস্যা করতে করতেই একদিন বৃদ্ধা হয়ে গেল।

তখন একদিন দেবর্ষি নারদ তার সামনে এসে তাকে মনে করালেন যে, সে তপস্যা করতে করতে বৃদ্ধা হয়ে গেছে। এই অবস্থায় তার আর তপস্যা করে কী হবে! মনের মতো বর পাওয়া তো দূরের কথা, কেউই তাকে এখন বিয়ে করবে না। অথচ বিবাহ না-করলে তার উদ্ধারও হবে না।

এ-কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই কন্যা সচেতন হয়ে বিলাপ করতে শুরু করল। এবার কী হবে! দেবর্ষি নারদ তখন তাকে উপদেশ দিলেন যে, যে-অরণ্যে সে তপস্যা করছে, সেই অরণ্যের কোন ঋষিকুমারকে অনুরোধ করতে বিবাহের জন্য।

কথাটা কন্যার মনে ধরল। সে অরণ্যে ঘুরতে ঘুরতে এক যুবক ঋষিকুমারের দেখা পেল। অতীব সুন্দর ও যুবক সেই ঋষিকুমারের নাম, শৃঙ্গবান। তাকে কন্যার খুব মনে ধরল। এবং তাকেই বিয়ের জন্য সে খুব অনুনয় বিনয় করতে লাগল। কিন্তু বৃদ্ধা কন্যাকে শৃঙ্গবান কিছুতেই বিয়ে করতে রাজি হল না। তখন দৈবাবাণী হল, দেবতারা তার কাছে অনুরোধ করলেন কন্যাকে বিয়ের জন্য। দেবতাদের অনুরোধ ফেলতে পারল না শৃঙ্গবান। কিন্তু এই বৃদ্ধাকে পত্নী হিসেবে সারাজীবনের জন্য মেনে নিতেও তার মন চাইল না। ফলে, তিনি শর্ত দিল কন্যাকে। বলল, বিয়ে করবে ঠিকই, কিন্তু একরাতের জন্য। বেশ, তাই সই। কন্যা তাতেই রাজি হল।

বিয়ের পর রাতে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। কন্যা তপের ক্ষমতায় আবার সুন্দরী যুবতী হয়ে গেল। তার সেই অপূর্ব রূপ দেখে এবার শৃঙ্গবান চাইল তার সঙ্গে সারাজীবন কাটাতে। তা শুনে কন্যা হাসল। শর্তভঙ্গ করে তো সম্পর্ক স্থায়ী করা যাবে না। শর্তভঙ্গ হলে বিশ্বাস ভঙ্গ হবে। বিশ্বাস না-থাকলে সম্পর্ক কীসের!

পরদিন সকালেই স্বামীকে ছেড়ে কন্যা চলে গেল তার তপস্যা স্থলে। সেখানে একটি আশ্রম তৈরি করল। সেই আশ্রমের নাম হল, 'কন্যাশ্রম'। কালক্রমে এই আশ্রমের নামেই অরণ্যের এই স্থানটির নাম হয়ে উঠল। আশ্রম একদিন হারিয়ে গেল। রয়ে গেল আশ্রমের পাশের কুণ্ডটি। সেটি সেই কন্যারই তপস্যাকালের কথা, তার দীর্ঘ কুমারীত্বের কথা মনে রেখে পরিচিত হল, 'কুমারীকুণ্ড' নামে। এখনও সেই কুণ্ডে জলের ওপর অগ্নিশিখায় কন্যা প্রাকৃতজনের কাছে প্রকট হন--এমনটাই মানুষের বিশ্বাস।...

ছবিঃ প্রতীকী

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...