উত্তর প্রদেশের ‘এলাহাবাদ’ এখন ‘প্রয়াগরাজ’। সকলেই জানেন যে, প্রয়াগরাজের প্রয়াগতীর্থ ভুবনবিখ্যাত। এই তীর্থে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী—এই তিনটি পবিত্র নদীর মিলন বা সঙ্গম ঘটেছে। তাই এই মিলনস্থলকে ত্রিবেণীসঙ্গমও বলা হয়। প্রতি বারো বছর অন্তর এই তীর্থে অনুষ্ঠিত হয় কুম্ভমেলা। এই মেলার জাঁক ও মাহাত্ম্যের কথা দেশবিদেশের সকলেই জানেন। তবে শুধু কুম্ভমেলার জন্যই এই তীর্থ বিখ্যাত এমনটা নয়, এই তীর্থে রয়েছে বিখ্যাত ও জাগ্রত একটি সতীপীঠও। এই পীঠই প্রয়াগতীর্থকে নিত্যদিন জাগিয়ে রাখে।
‘তন্ত্রচূড়ামণি’ গ্রন্থে এই পীঠ সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
‘অঙ্গুলিবৃন্দং হস্তস্য প্রয়াগে ললিতা ভবঃ।’
অর্থাৎ, এই প্রয়াগতীর্থে ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হয়ে দেবী সতীর দশটি আঙুল পতিত হয়েছিল। দেবী এখানে ‘ললিতা’ নামে আরাধ্যা; আর তাঁর ভৈরব হলেন ‘ভব’। এই সতীপীঠে তিনটি মন্দির রয়েছে। ‘অক্ষয়বট’, ‘মীরাপুর’ ও ‘আলোপী’। ‘অক্ষয়বট’ হল অক্ষয়বটের নীচে নির্মিত ভৈরব ভবের মন্দির; আর ‘অলোপী’ মন্দিরটি হল আমাদের আকাঙ্ক্ষিত সতীমন্দির। ত্রিবেণী ঘাটের উত্তর-পূর্বদিকে অবস্থিত এই মন্দিরে দেবীর কোন বিগ্রহ নেই। রয়েছে শুধুই পাথরের বেদি। বেদিতে চারহাত পরিমিত গর্ত রয়েছে। তাতে রয়েছে জল। সেই জল স্বয়ং মা গঙ্গা বলে মনে করা হয়। গর্তের ওপরে ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে একটি কাঠের ছোট পালকি, এই পালকি হল দেবীর আসন। তাই একেই দেবীর প্রতীক হিসেবে পূজা করা হয়।
দেবী ললিতা এখানে বিঘ্ননাশিনী সর্বমঙ্গলা। তিনি দেব, মানব—সকলের বিঘ্ন দূর করে সবার মঙ্গল করেন। তাঁর এই মাহাত্ম্য বিষয়ে একটি কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছেঃ
পুরাণের যুগে ভণ্ডাসুর নামে এক প্রবল পরাক্রমী অসুর ছিল। সে একবার মহাদেবকে তুষ্ট করতে কঠোর তপস্যা শুরু করল। দিনের পর দিন চলে গেল, বছরের পর বছরও চলে গেল। তবু তাঁর নিষ্ঠায় এতটুকু কার্পণ্য দেখা গেল না। তার এই নিষ্ঠা দেখে মহাদেবেরও তুষ্ট না-হয়ে আর উপায় রইল না। তিনি ভণ্ডাসুরকে অনুগ্রহ করতে আবির্ভূত হলেন তার সামনে। জানতে চাইলেন কী তার প্রার্থনা। ভণ্ডাসুর অমরত্ব চাইল। মহাদেব হাসলেন। বললেন, অমরত্ব শুধু তপের নিষ্ঠা দিয়ে অর্জন করা যায় না বৎস, তা সুকৃতি দিয়ে অর্জন করতে হয়। তোমায় বরং আমি এই বর দিচ্ছি যে, যুদ্ধে তুমি অজেয় থাকবে!
বর দিয়ে মহাদেব অদৃশ্য হলেন। ভণ্ডাসুর অমরত্ব না-পেলেও যে বরটি পেয়েছে, তাতেই সে মহাখুশি হয়ে গেল। কেননা, তাকে হত্যা করতে হলে আগে যুদ্ধে পরাজিত করতে হবে; সেটাই যদি কেউ করতে না-পারে, তাহলে তো তার মৃত্যু হবে না, তাহলে তো বলতে গেলে সে অমরই! ব্যস, এই ছক এভাবে মাথায় বসে যেতেই সে বেপরোয়া হয়ে গেল। বিরাট বিরাট ও ভয়ঙ্কর সব সৈন্যসামন্ত জুটিয়ে স্বর্গ, মর্ত, পাতাল সব একে একে যুদ্ধ করে জয় করে ফেলল। নিজে স্বর্গের রাজা হয়ে সমস্ত দেবতাদের স্বর্গ থেকে প্রবল অত্যাচার করে বিতাড়িত করল। শুধু তাই নয়, মর্তে দেবতাদের পুজো বন্ধ করে দিয়ে নিজের পূজা প্রচলিত করে ফেলল। দেবতারা তার অত্যাচারে দুর্গম পাহাড়ের গুহায় গিয়ে আত্মগোপন করলেন।
স্বর্গের রাজা হয়ে ভণ্ডাসুরের সাধ হল ইন্দ্রের পত্নী শচীর মতো এক রানি পাবার। শচীর মতো কেন, শচীকেই রানি হিসেবে পাবার বাসনা হল তার। দেবরাজ ইন্দ্র পালিয়ে বেড়ানোর এই দুর্দিনে সঙ্গে শচীকে রাখা সমীচীন মনে করেননি; ভেবেছিলেন, কী দরকার তাঁকে এই কষ্টের জীবনে টেনে আনার; তাই তাঁকে শিবের কৈলাস-সদনে পার্বতীর কাছে রেখে গিয়েছিলেন। এই সংবাদ গেল উচাটন ভণ্ডাসুরের কানে। সে সটান চলে গেল কৈলাসে। কৈলাসের রক্ষার ভার তখন গণপতি গণেশের হাতে। সে গণেশকে সরাসরি আদেশ দিল অন্দর থেকে শচীকে এনে তার হাতে তুলে দিতে।
আদেশটি ভণ্ডাসুর কড়া সুরে বেশ তর্জন করেই দিয়েছিল। ফলে, সে-কথা অন্দর থেকে মা পার্বতী স্পষ্টই শুনতে পেলেন। শুনতে পেয়ে অমনি রাগে তিনি অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। অসুরের স্পর্ধা তো কম নয়! তাঁরই আশ্রয় থেকে কিনা একজন আশ্রিতা নারীকে বের করে তার হাতে তুলে দেওয়ার আদেশ দেয়! প্রচণ্ড ক্রোধে দেবী পার্বতী চণ্ডীমূর্তি ধারণ যুদ্ধং দেহি তেজে আক্রমণ করলেন ভণ্ডাসুরকে। দেবী স্বয়ং অদ্যাশক্তি। তিনিই সকল শক্তির আধার। তাঁর কাছে অজেয় বা অপরাজেয় বলে কিছু নেই। দেবী তাই প্রচণ্ড ক্রোধে ভণ্ডাসুরকে পরাজিত করে হত্যা করতে উদ্যত হলেন।
দেবীর এই মনোভাব বুঝতে পেরে স্বয়ং ব্রহ্মা তখন আর থাকতে পারলেন না। তিনি দেখলেন যে, দেবী যদি ভণ্ডাসুরকে পরাজিত করেন বা হত্যা করেন; তাহলে মহাদেবের বর মিথ্যে হয়ে যায়! তাই তিনি সামনে আবির্ভুত হয়ে দেবীকে স্মরণ করিয়ে দিলেন সে-কথা। দেবী প্রচণ্ড ক্রোধের বশে বিস্মৃত হয়েছিলেন মহাদেবের বরের কথা। মনে পড়তে অমনি নিরস্ত হলেন। কোন শাস্তি না-দিয়েই ভণ্ডাসুরকে মুক্তি দিলেন।
দেবীর হাত থেকে মুক্তি পেয়ে মহাদেবের বরটিকে মারাত্মক রক্ষাকবচ বুঝতে পেরে ভণ্ডাসুর আরও বেপরোয়া হয়ে গেল। সে মনের জ্বালা মেটাতে আরও আরও অত্যাচারী হয়ে উঠল। তখন সেই অত্যাচার সহ্য করতে না-পেরে দেবতারা 'ত্রাহি ত্রাহি' রব তুলে মহাদেবের শরণ নিলেন। ভণ্ডাসুরকে হত্যার অনুমতি চাইলেন। সমস্ত বিবরণ শুনে মহাদেব ভণ্ডাসুরের প্রতি দারুণ বিরক্ত হলেন, তার ওপর থেকে তুষ্টি নিবৃত করলেন; তাকে হত্যার অনুমতি দিলেন। এও বললেন যে, স্বয়ং আদ্যাশক্তি ললিতা এই অসুরকে হত্যার অধিকারিণী। হে দেবগণ, যাও তাঁকে আবাহন কর!
মহাদেবের অনুমতি ও আদেশ পেয়ে দেবতারা দেবীর আবাহনে এক বিরাট যজ্ঞের আয়োজন করলেন। কতদিন এই যজ্ঞ চলল, তবু দেবী প্রসন্ন হলেন না। যজ্ঞের হবি শেষ হয়ে গেল, সমিধ শেষ হয়ে গেল। তখন দেবতারা আপন আপন দেহের মাংস কেটে যজ্ঞবেদিতে আহুতি দিতে শুরু করলেন। চরম এই পরীক্ষা নেওয়ার পর তবে দেবী যেন প্রসন্ন হলেন। যজ্ঞের অগ্নিশিখা থেকে রক্তবস্ত্রে ও আভরণে সজ্জিতা দেবী এক অগ্নিবলয়ের মধ্যে অবির্ভুতা হলেন। দেবীর সর্বাঙ্গ যেন অগ্নিময়; দেবীর চতুর্ভুজ ভীষণ করাল অস্ত্রময়। দেবীর ওষ্ঠে একাধারে আবাহনের প্রসন্নতা, অন্যদিকে অসুরের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ।
দেবী দেবতাদের বরাভয় দান করে অগ্নিময় রথে আরোহন করে তীব্র বেগে ছুটলেন অসুরনিধনের জন্য। ভণ্ডাসুরের মুখোমুখি হতেই শুরু হল বীভৎস যুদ্ধ। দীর্ঘ সংগ্রামের পর দেবী সেই অপরাজেয় অসুরকে পরাজিত করে হত্যা করতেই দিকে দিকে শুরু হল শঙ্খধ্বনি, পুষ্পবৃষ্টি, উলুধ্বনি। সেই সব মঙ্গলধ্বনির মাঝে দেবী স্বয়ং স্বর্গরাজ্যে দেবতাদের পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করে সকলের নিত্য আরাধ্যা হলেন।
আগেই বলেছি যে, দেবী প্রয়াগের যে মন্দিরে বিরাজ করছেন, সেই মন্দিরের নাম, 'অলোপা'। আসলে, এটা দেবীরই ডাক নাম। ললিতাই অলোপা, অলোপাই ললিতা। দেবীর এমন নাম কেন, তাই নিয়ে পুরাণকথা যেমন রয়েছে, তেমনি এই অঞ্চলে একটি কিংবদন্তিও প্রচলিত রয়েছে। শুনুন:
'অলোপা' কথার অর্থ, 'যাঁকে লোপ করা নয় না'। শিব যখন দেবী সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে ধ্বংসলীলায় মেতেছিলেন, তখন দেবতারা বুঝেছিলেন যে, যতক্ষণ দেবী সতীর অস্তিত্ব শিবের কাছে থাকবে, ততক্ষণ শিবকে নিরস্ত করা যাবে না। তাই দেবীর অস্তিত্ব বিলোপ করতে চেয়ে ভগবান বিষ্ণু সুদর্শন দিয়ে দেবীকে খণ্ডে খণ্ডে কেটে ফেলেছিলেন। তবুও তাঁকে বিলুপ্ত করতে পারেননি। সতীপীঠে শিবকে ভৈরব করে তাঁর সান্নিধ্যেই অধিষ্ঠিত হয়েছেন বারে বারে। দেবীর প্রতিটি অঙ্গই এক এক দেবী হয়ে উঠেছেন। এমনকি তাঁর দশটি আঙুলও বাদ যায়নি, প্রয়াগতীর্থে তা হয়েছে 'দেবী ললিতা'। তাই এই দেবীকে ভক্তরা 'অলোপা' নামেও ডেকে থাকেন।
অন্যদিকে দেবী শুধু যে নিজেকেই লোপ হতে দেননি, এমন নয়; কোন নারীকেই তিনি লুপ্ত বা বিপর্যস্ত হতে দেন না। যেভাবে তিনি চণ্ডীরূপে শচীকে রক্ষা করতে অস্ত্রধারণ করেছিলেন, তেমনই প্রয়াগে এক কন্যাকে রক্ষা করতেও কৃপাময়ী হয়ে উঠেছিলেন।
আসলে, পুরাকালে যেখানে দেবীর পীঠ রয়েছে, শোনা যায়, সেখানে ছিল এক ঘন জঙ্গল। সেই জঙ্গলে ছিল ডাকাতের ভয়। সন্ধে হলেই এরা পথিককে মেরে তার সবকিছু কেড়ে নিত। পথিকেরও এই জঙ্গলে না-এসে উপায় থাকত না, কেননা, জঙ্গলের মাঝখান দিয়েই ছিল যাতায়াতের পথ। একবার এই পথ দিয়েই বরকনেকে পালকিতে চাপিয়ে বরযাত্রীর দল বাড়ি ফিরছিল। দ্রুত পা চালিয়েও জঙ্গলের পথ ধরতে তাদের সন্ধে হয়ে গেল। এক্ষেত্রে মনে ভয় থাকলেও খানিক সাহস দেখাল তারা। ভাবল, দলে অনেকে আছে, ডাকাতেরা সাহস করবে না আক্রমণ করতে।
কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য, ডাকাতেরা সদলে আক্রমণ করল তাদের। দলের সকল পুরুষকে মেরে ফেলল তারা। মেয়েদের হত্যা করে তাদের অলঙ্কার হরণ করতে যেই পালকির দিকে গেল, অমনি দেখল কেউ কোত্থাও নেই! চারিদিকে ডাকাতের দলের লোক ঘিরে রেখেছে, তার মধ্যে মেয়েরা গেল কোথায়!
আসলে হয়েছে কী, দেবী আপন মায়ায় মেয়েদের আপন আশ্রয়ে লুকিয়ে নিরাপদে জঙ্গলের বাইরে বের করে দিয়েছেন। কেননা, প্রার্থনা-বিহনেই দেবী নারীদের প্রতি সর্বদা সদয় হয়ে অনুগ্রহ করেন। আর জানান দেন যে, এই গুপ্ত ও লুপ্ত তীর্থের মধ্যেও তিনি লুপ্ত হয়ে যাননি; বরং স্বমহিমায় মঙ্গলময়ীরূপে বিরাজ করছেন। দেবীর এই মহিমার কথা স্মরণ করেই পরবর্তীকালে যখন জঙ্গল কেটে লুপ্ততীর্থ উদ্ধার হল, তখন দেবীকে ভক্তসাধারণ 'মা অলোপা' নামে সম্বোধন করতে শুরু করেন।
দেবীর নিত্যপুজোয় নিত্যদিন ভক্তকুলের প্রভূত সমাগম তো হয়ই; কিন্তু নবরাত্রি ও শিবরাত্রির জাঁকজমকই আলাদা। নবরাত্রিতে দেবীর বিশেষ আরাধনা চলে সারারাত্রিব্যাপী আর শিবরাত্রিতে দেবীর ভৈরব ভবকে কেন্দ্র করে চলে বিরাট উৎসব। আর এই দুই উৎসবে এই দুই দেবদেবীর কাছে কৃপা পেতে ভিড় জমান কয়েক লক্ষ ভক্ত। ফি বছর।...