'ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ।
মামকাঃ পান্ডবাশ্চৈব কিমকুর্বত সঞ্জয়।।'
এটি শ্রীমদভাগবতগীতার প্রথম শ্লোক। এই শ্লোক আসলে একটি প্রশ্ন। যেখানে, ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে কুরু ও পাণ্ডবেরা যুদ্ধের জন্য সমবেত হয়ে এখন কী করছেন--ধৃতরাষ্ট্র এটাই জিজ্ঞেস করছেন সঞ্জয়কে। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, গীতার প্রথমেই কুরুক্ষেত্রকে 'ধর্মক্ষেত্র' বলে অভিহিত করা হল। কিন্তু কেন হল?
আসলে মহাভারতের যুদ্ধপর্বের বহু আগে থেকেই কুরু, পাণ্ডব ও সাধারণের কাছে কুরুক্ষেত্রের ভূমি ধর্মক্ষেত্র হিসেবেই সশ্রদ্ধ মর্যাদা পেয়ে এসেছে। সেই ক্ষেত্র ধর্মক্ষেত্র হয়ে ওঠার পেছনে দুটি কাহিনি রয়েছে। যথা:
প্রথম কাহিনিটি মহাভারতে রয়েছে। তাতে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, প্রথম যুগে কুরুক্ষেত্র ছিল এক বিস্তীর্ণ পতিতভূমি। তখন এই ভূমি 'সমন্তপঞ্চক' নামে পরিচিত ছিল। এই ভূমির অধিকারী ছিলেন রাজা কুরু। তিনি রাজা হিসেবে যেমন মহান ছিলেন, তেমনই ছিলেন ধর্মচর্যার অনুগত। একদিন তিনি ভাবলেন যে, বিস্তীর্ণ এই ভূমি নিছক পতিত হয়ে থাকবে কেন! তাকে ধর্মচর্চার বিস্তৃত ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ব্যস, এ-কথা মনে হতেই তিনি শুরু করে দিলেন প্রচেষ্টা। তাঁর এই মহান প্রচেষ্টায় প্রীত হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এলেন রাজা কুরুকে আশীর্বাদ জানাতে।
দেবরাজ ইন্দ্র কুরুকে বললেন যে, এই ধর্মস্থল যেহেতু কুরুর অধীনস্থ ও তাঁর একক প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে, তাই এই ধর্মস্থলের নাম হবে, 'কুরুক্ষেত্র'। এবং এই ভূমিতে যে বা যারা মৃত্যুবরণ করবে, সে বা তারা সাক্ষাৎ মোক্ষ লাভ করবে। ইন্দ্রের আশীর্বাদের এই শেষ চরণটি মাথায় রেখেই রাজা কুরুর উত্তরসূরি পাণ্ডব ও কৌরবেরা কুরুক্ষেত্রেই মরণপণ যুদ্ধের আয়োজন করেছিলেন যাতে রণভূমিতে যাঁদের মৃত্যু হবে, তাঁরা সকলেই মোক্ষলাভ করতে পারেন। এবং কার্যক্ষেত্রে সেটাই হয়েছিল।
এবার আসি দ্বিতীয় প্রসঙ্গ অর্থাৎ কাহিনিতে। এটি প্রথম কাহিনির সঙ্গে একইসূত্রে বাঁধা। সেই সূত্রটি কি, তাই-ই আমরা এখন বিশ্লেষণ করে খুঁজে বার করবো। আগের কাহিনি শোনার পরই মনে প্রশ্ন জাগে, রাজা কুরু অত্যন্ত সচেষ্ট হয়ে যে ধর্মক্ষেত্র গড়ে তুললেন, সেই ধর্মস্থান কোন দেব বা দেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত হল? সেই স্থান কার মাহাত্ম্যে প্রসিদ্ধ হল? প্রশ্নের উত্তর মহাভারতে নেই। কিন্তু তার সূত্র আছে জনশ্রুতিতে। সেখানে বলা হচ্ছে যে, এই ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণের উপদেশে দেবী ভদ্রকালীর আরাধনা করেছিলেন তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন। তিনি দেবীর কাছে মানত করেছিলেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবেরা জয়ী হলে দেবীর থানে ঘোড়া দিয়ে পুজো দেবেন। ভক্তদের বিশ্বাস, অর্জুনের আরাধনায় তুষ্ট হয়ে দেবী পাণ্ডবদের যুদ্ধ জয়ে সহায়তা করেন। এবং অর্জুনও তাঁর মানত পূর্ণ করেন ঘোড়া দিয়ে দেবীর পুজো সম্পন্ন করে।
সুতরাং, পুরাণ ও জনশ্রুতি মিলিয়ে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, কুরুর রাজত্বলাভের আগে থেকেই কুরুক্ষেত্রের ভূমিতে দেবী ভদ্রকালীর থান বা নিবাস ছিল। কিন্তু দেবীর থান সেই আগাছামণ্ডিত পতিতভূমির জঙ্গলে ঢাকা পড়েছিল এবং সাধারণের পক্ষে সেখানে পূজা দেওয়া বা নিত্যদর্শনের তেমন সুযোগ ছিল না। কুরু উদ্যোগী হয়ে এই ভূমিকে পরিষ্কার করিয়ে দেবীতীর্থ বা ধর্মক্ষেত্রে রূপান্তরিত করেন।
এখন কথা হচ্ছে যে, দেবী ভদ্রকালী কে? তাঁর এখানে অবস্থিতির কারণটিই বা কী? দেবী ভদ্রকালী হলেন সাক্ষাৎ আদ্যাশক্তি। তিনি দেবী সতীর শিলাঅঙ্গের প্রতিমারূপ। আসলে, এই স্থানটি দেবীর অবস্থিতির কারণ, এটি একান্নপীঠের অন্যতম এক সতীপীঠ। এখানে ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হয়ে দেবী সতীর ডান পায়ের গুল্ফ পতিত হয়েছিল। দেবী এখানে 'ভদ্রকালী' নামে পূজিতা, তাঁর ভৈরবের নাম 'স্থাণু'।
শোনা যায় যে, যেখানে দেবী সতীর পায়ের গুল্ফ পাতিত হয়েছিল, সেখানে একটি কূপ বা কুয়োর সৃষ্টি হয়েছিল। সেই কূপকে সামনে রেখেই দেবীর সুবিশাল, সুন্দর ও অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন মন্দির গড়ে উঠেছে। মূল রাস্তা থেকে মন্দিরে প্রবেশের আগে সুবিশাল মর্মর ফটক। সেই ফটকে প্রবেশ করলেই দু'পাশে সুদৃশ্য বাগিচা আর মধ্যিখানে বাঁধানো রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে খানিকটা এগোলে তারপর মন্দিরের মূল প্রবেশদ্বার। এই দরজায় প্রবেশ করলে প্রথমেই চোখে পড়ে উঁচু করে বাঁধানো একটি কুয়ো। এটিই হচ্ছে, সেই কুয়ো, যা দেবী সতীর অঙ্গ পতনের ভারে সৃষ্টি হয়েছিল। দেবীর অঙ্গ যেহেতু শিলাভূত হয়ে মাটির গভীরে প্রবেশ করেছে, তাই তাকে আর খুঁজে তুলে আনা যায়নি। ভক্তদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য কুয়োর উপরিভাগ পরবর্তীকালে একটি পাথরের পদ্ম নির্মাণ করে আংশিকভাবে ঢেকে দেওয়া হয়েছে, আর এই পদ্মের উপর স্থাপিত হয়েছে মর্মরনির্মিত দেবীর ডান পা। স্থানটি ঘিরে অসংখ্য ঘন্টা টাঙানো রয়েছে। ভক্তজন প্রথমে এখানে পুজো দেন, ঘণ্টাধ্বনি করেন, তারপর মানত করে কূপের নিকটে সুতো ও ঢিল বাঁধেন; এরপর প্রতিমা দর্শন ও পূজনের জন্য গর্ভগৃহে প্রবেশ করেন।
গর্ভগৃহের দেবীমূর্তি আড়াই-তিন ফুট লম্বা। দেবী এখানে করালবদনী কালী। তাঁর গলায় মুণ্ডমালা। সুদৃশ্য বসন ও আভরণে তিনি সুসজ্জিতা। মাথায় বহুমূল্য মুকুট। তাঁর চারটি হাত। দুই বাম হাতে খড়্গ ও ছিন্ন শির। দুই ডান হাতে বরাভয়। গর্ভগৃহে পুজো নিবেদন করে ভক্তজন এখানে অর্জুনের কাহিনি স্মরণ করে মাটি, চিনামাটি, সোনা ও রুপোর ঘোড়া দিয়ে মানত করেন। তারপর করেন মন্দির পরিক্রমা। গর্ভগৃহের বাইরে চতুর্দিক ঘিরে গলিপথের মতো পরিক্রমার পথ রয়েছে। পরিক্রমাকালে দেবী ভক্তের বামে থাকেন। আর ডান দিকে এক একটি কক্ষে অবস্থান করতে দেখা যায় দেবী সরস্বতী, গায়ত্রী, নারায়ণ প্রভৃতি দেবদেবীদের। এঁদের অর্ঘ্য দিতে দিতেই ভক্তেরা পরিক্রমা সম্পূর্ণ করেন।
দেবী ভদ্রকালী মন্দিরের বিশেষত্ব হচ্ছে, রাখিপূর্ণিমার দিন ভক্তেরা দেবীর থানে এসে নিজের ও পরিবারের সুরক্ষিত জীবনের প্রার্থনা জানিয়ে সুতো বেঁধে দিয়ে যান। এছাড়া হিন্দি-বলয়ের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, আশ্বিন মাসে দেবীকে ঘিরে মন্দিরে বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে নবরাত্রি অনুষ্ঠান পালিত হয়। চৈত্র মাসে শিবরাত্রিও বেশ ধুমধামের সঙ্গে এখানে যাপন করা হয়। উৎসব উপলক্ষে প্রচুর ভক্তের সমাগম হয় এখানে। সত্যি বলতে কী, শুধু এইসব বিশেষ সময়ে নয়, সারা বছরই এই পীঠে অসংখ্য ভক্তসমাগম হয়ে দেশের নানান প্রান্ত হতে। কেননা, উত্তর ভারতে যাঁরা তীর্থ করতে যান, তাঁরা প্রত্যেকেই দেবীর এই অপূর্ব পীঠস্থান দর্শন করে নয়ন সার্থক করে আসেন।...