গোদাবরী। দক্ষিণের পুণ্যসলিলা পবিত্র এক নদী। গঙ্গায় স্নান করলে যেমন সমস্ত পাপ বিনষ্ট হয় বলে ভক্তেরা বিশ্বাস করেন, তেমনই বিশ্বাস রয়েছে এই নদী সম্পর্কেও। তাই এই নদীকে বলা হয়, ‘দক্ষিণ ভারতের গঙ্গা’। পুরাণ মতে, এ-নদীকে ‘দক্ষিণের গঙ্গা’ নামে অভিহিত করার পেছনে নিছক পুণ্যযোগ রয়েছে এমন নয়, এ-নদী আসলেই গঙ্গা। এ-বিষয়ে একটি কাহিনি রয়েছে, সেটা হলঃ
ত্র্যম্বকেশ্বরের ব্রহ্মগিরি পর্বতের পাদদেশে একদা ছিল গভীর অরণ্য। সেখানেই ছিল ঋষি গৌতমের আশ্রম। এই আশ্রমে পত্নী অহল্যাকে নিয়ে তিনি তপস্যা, দেবচিন্তা আর শাস্ত্রচর্চায় দিনাতিপাত করছিলেন। আশ্রমের নিকটেই খানিকটা জঙ্গল পরিষ্কার করে তিনি আশ্রমের প্রয়োজনীয় অন্নের সংস্থান করতে একদা ধানের চাষ করেছিলেন। একদিন তাঁর সেই ধানের ক্ষেতে একটা বুনো গরু ঢুকে ক্ষেতের ধান যত না খাচ্ছিল, তার চেয়ে বেশি নষ্ট করছিল। আর এটাই চোখে পড়ল ঋষির। তিনি হাঁ হাঁ করে ছুটে এলেন। গরুটিকে তাড়ানোর জন্য হাতের কাছে কিছু না-পেয়ে একগোছা দুব্বো ঘাস ছিঁড়ে তা-ই দিলেন তার দিকে ছুঁড়ে। সেই ঘাস লাগল গরুর গায়ে। আর তাতেই ঘটে গেল অঘটন। তিনি তপঃসিদ্ধ ঋষি, তাই তাঁর ছোঁড়া ঘাসও গিয়ে গরুর গায়ে শত মুগুরের আঘাত হানল। সেই আঘাত সহ্য করতে না-পেরে গরুটি তীব্র এক আর্তনাদ ছেড়ে তৎক্ষণাৎ মারা গেল। আর অমনি ঋষি গৌতম গোহত্যার পাপে দারুণ পাপিষ্ঠ হলেন। সমস্ত ঋষিগুণ তাঁকে ত্যাগ করল।
তখন ভারি হাপিত্যেশ করতে করতে ঋষি মহাদেবের শরণ নিলেন। দারুণ তপে মহাদেবকে তুষ্ট করে সেই ঘোর পাপ হতে শুদ্ধির নিদান চাইলেন। মহাদেব তাঁকে বললেন, ভগীরথের আবাহনে ধরায় নেমে আসা পতিতপাবনী গঙ্গায় স্নান করলেই সকল পাপ বিনষ্ট হয়। ফলে, তাতে স্নান করে ঋষি গৌতম অচিরেই গোহত্যাজনিত পাপ থেকে সহজেই মুক্ত হতে পারবেন।
মহাদেব বললেন বটে গঙ্গাস্নানের কথা; কিন্তু তা যে উত্তরের নদী। ঋষির আশ্রম থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে তার ধারাপথ। সেখানে যাওয়া বহু শ্রম ও সময়ের ব্যাপার। এতদূর যেতে গিয়ে পথে ঋষিগুণহীন গৌতম যদি আরও কোন গুরুতর পাপ করে বসেন! তাতে যদি আরও অঘটন ঘটে! এটা মনে হতেই তিনি মহাদেবকে অনুরোধ করলেন, তাঁর আশ্রমের পাশ দিয়ে পুণ্যদায়িনী গঙ্গার একটি ধারা তিনি যদি কৃপা করে প্রবাহিত করে দেন, তাহলে তাঁর ও দশের মঙ্গল হবে। কেননা, তার ধারায় ঋষি যেমন সহজে শুদ্ধ হতে পারবেন, তেমনি যুগে যুগে দক্ষিণের ভক্তজনও সহজে গঙ্গামায়ের সান্নিধ্য লাভ করতে সমর্থ হবেন।
ঋষি গৌতমের এই প্রার্থনা এবং তার পেছনে লোকহিতের লক্ষ্য জেনে ভগবান শিব অত্যন্ত তুষ্ট হলেন। তিনি গঙ্গার একটি ধারা ঋষির আশ্রমের পাশ দিয়ে প্রবাহিত করে দিলেন। সেই ধারায় স্নান করে ঋষি শুদ্ধ হলেন। তিনি এই নদীতে স্নান করে গোহত্যার পাপ থেকে মুক্ত হলেন বলে নদীর নাম হল, ‘গোদাবরী’। আবার এই নদী গৌতমের প্রার্থনায় প্রবাহিত হল বলে, একে পুরাকালে ‘গৌতমী’ নামেও অভিহিত করা হত।
যাই হোক, এই গোদাবরী নদীর তীর মুনি-ঋষিদের পবিত্র যজ্ঞক্ষেত্র ও তপস্যার ক্ষেত্র হিসেবেই শুধু বিখ্যাত নয়, সহস্র সহস্র বছর ধরে এখানে রয়েছে একান্নপীঠের অন্যতম এক সতীপীঠও। এই পীঠ অন্ধ্রপ্রদেশের রাজামুন্ড্রিতে অবস্থিত। তন্ত্রগ্রন্থগুলিতে এই পীঠ ‘গোদাবরীতীর শক্তিপীঠ’ নামেই প্রসিদ্ধ। ‘পীঠনির্ণয়’ তন্ত্রগ্রন্থে বলা হয়েছেঃ
‘গণ্ড গোদাবরীতীরে বিশ্বেশী বিশ্বমাতৃকা
দণ্ডপাণি ভৈরবস্তু...।’
উক্ত শ্লোকাংশটির অর্থ, গোদাবরীতীরে ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হয়ে দেবী সতীর গণ্ড পতিত হয়েছিল। এখানে দেবী ‘বিশ্বেশী’ নামে প্রসিদ্ধা, দেবীর ভৈরবের নাম ‘দণ্ডপাণি’।
‘বিশ্বেশী’ নাম ছাড়াও এখানে দেবী একাধিক নামে পরিকীর্তিতা হন। যথাঃ ‘বিশ্বেশ্বরী’, ‘রঙ্কিনী’ ও ‘বিশ্বমাতুকা’। ভৈরবের ‘দণ্ডপাণি’ ছাড়াও এখানে আরো একটি নাম আছে, সেটি হল, ‘বৎসনাভ’। গোদাবরীতীরের এই পীঠ অনেকের কাছেই ‘সর্বশৈল’ নামে পরিচিত। দেবীর পীঠস্থানটি যে মন্দিরে রয়েছে, সেই মন্দির ‘কোটিলিঙ্গেশ্বর মন্দির’ নামে প্রসিদ্ধ। এই পীঠে দেবীর কোন অংশ পতিত হয়েছিল তা নিয়ে সামান্য মতভেদ রয়েছে; কেউ বলেন ‘গণ্ড’, কেউ বা বলেন ‘বাম গণ্ড’।
দক্ষিণ ভারতের মন্দিরের প্রবেশদ্বারকে বলা হয় ‘গোপুরম’। এই দ্বার প্রস্তর নির্মিত এবং মন্দিরের চেয়েও উঁচু হয়। এর গায়ে পৌরাণিক কাহিনি অসাধারণ শৈল্পিকনৈপুণ্যে খোদাই করা থাকে। গোদাবরীতীরের এই দেবীমন্দিরের গোপুরমের উচ্চতা অন্যান্য মন্দিরের প্রবেশদ্বারের চেয়ে অনেক বেশি। এর উচ্চতা ও নির্মাণশৈলী, ভাস্কর্য এতই অসাধারণ যে, সমস্ত দর্শনার্থী, পর্যটক, ভক্তজন এই প্রবেশদ্বারের সম্মুখে এসে কয়েক মুহূর্ত থমকে যান, বিস্ময়বিমুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকেন এবং এক অনন্য অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
গোপুরম ও দেবীর মন্দির অত্যন্ত প্রাচীন। তার শৈলী, ভাস্কর্যে সেই প্রাচীনত্বের নমুনা ছড়িয়ে আছে। কিন্তু কে, কবে এই গোপুরম বা মন্দির নির্মাণ করেছিলেন, সে-সম্পর্কে কোন তথ্য জানা যায় না। তবে বলা হয়ে থাকে যে, এই মন্দির সহস্রাধিক বছরের পুরনো।
দেবীর মূর্তি কালো পাথরে নির্মিত। রুপোর কারুকার্যময় চালচিত্রে দেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত। মূর্তির মাথায় রত্নখচিত সোনার মুকুট। কপালে রক্তিম শূলতিলক। তীক্ষ্ণ নাসা। নাকে সোনার নথ। উজ্জ্বল দুই চোখের তারা সম্মুখে স্থির। সেই চোখে ক্রোধ। দেবীর কণ্ঠে বহুমূল্য রত্নবিজড়িত বহুবিধ সোনার হার ও মালা। তাঁর অঙ্গে রক্তবস্ত্র। তিনি চতুর্ভুজা। তাতে ধারণ করে আছেন নানান আয়ুধ। দেবী ফুলের মালায় সুসজ্জিতা।
দেখা যাচ্ছে যে, দেবী এখানে রণরঙ্গিণীরূপে অধিষ্ঠিত। তাঁর এই রনংদেহী ভীষণমূর্তি দর্শন করলে আপাতভাবে অন্তরে ভয়ের উদয় হয়। কিন্তু দেবীমূর্তির মধ্যে তা সত্ত্বেও এক অমোঘ মাতৃময়ীরূপের প্রকাশ উপলব্ধি করা যায়। এই উপলব্ধিতে ভয় বেয়ে আসে ভক্তি। এখানে মা রনংদেহী, কেননা, এখানে তিনি রক্ষাকারিণী, রঙ্কিনী। অসহায় সন্তান আক্রান্ত হলে সমস্ত প্রাণীজগতেই মা যেমন রণংদেহী হয়ে ওঠেন সন্তানকে রক্ষার জন্য, মায়ের সেই শাশ্বত চরিত্রটি ধরা আছে এখানে দেবীমায়ের মূর্তিতে। সেই মাতৃসত্তার কাছেই নত হন ভক্ত। শরণার্থী হন।
দেবীর মন্দিরে বছরে দু’বার ‘নবরাত্রি’ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়; মার্চ-এপ্রিল মাসে একবার, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে দ্বিতীয়বার। নবরাত্রিই এখানকার সবচেয়ে বড় উৎসব। প্রতি বারো বছর অন্তর গোদাবরীতীরে ‘পুষ্কর মেলা’ অনুষ্ঠিত হয়। সেই উপলক্ষে দেশের নানান প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ ভক্ত এখানে এসে গোদাবরীর পুণ্যজলে স্নান করে দেবীর চরণে পুজো দিয়ে পাপমুক্ত হন। এই সময় দেবীর মন্দিরে স্বভাবতই এত ভিড় হয় যে তিলধারণের স্থান থাকে না। ‘শিবরাত্রি’ পার্বণও এই মন্দিরে খুব জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়। সাধারণ দিনে সকাল ছ’টা থেকে রাত্তির সাতটা পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে। কিন্তু বিশেষ পার্বণ উপলক্ষে যেহেতু প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়, তাই তাঁদের দর্শন ও পূজনের সময় দিতে এই সময়সীমা স্বাভাবিকভাবেই বাড়ানো হয়। উৎসব উপলক্ষে ফুল ও আলোয় অপরূপসজ্জায় সেজে ওঠে মন্দির। সেই সৌন্দর্যের সাক্ষী হওয়াও এক অনন্য অভিজ্ঞতা।...