তাকে ‘কাশী’ই বলুন বা ‘বেনারস’ অথবা ‘বারাণসী’—তা শুধু একটি স্থাননাম নয়; প্রতিটি ধর্মপ্রাণ হিন্দুর কাছে তা অবিমুক্তিক্ষেত্র। কেননা, এই ক্ষেত্রে বিরাজ করছেন স্বয়ং অবিমুক্তেশ্বর শিব। তিনি এখানে মানুষকে তার সমস্ত কর্মফল ও ঐহিক যোগ থেকে অবিমুক্ত করে মোক্ষ দান করেন। তাই জীয়ন্তে তো বটেই, এমনকি মরণের পরেও মানুষের জন্য এই পবিত্র স্থান ভক্তের কাছে মোক্ষতীর্থ। ভক্তের বিশ্বাস, কাশীতে মরলে আর পুনর্জন্ম হয় না। স্বয়ং শিব মৃতের কানে তারকব্রহ্ম মন্ত্র দিয়ে তার ঐহিক যোগের নাড়ি ছেদন করে তাকে মুক্ত করে দেন। মুক্ত পাখি যেমন আর খাঁচায় ফেরে না, তেমনি মোক্ষ পেয়ে মানুষ আর সংসারের খাঁচায় ফিরে আসে না। সে শিবসঙ্গ লাভ করে অনন্তকালের জন্য শিবলোকের অধিবাসী হয়।
কাশী যেমন বিশ্বনাথের জন্য প্রসিদ্ধ, তেমনি প্রসিদ্ধ কালভৈরবের জন্যও। ঘোর কালো তাঁর গায়ের রঙ। রুপোর চোখ সর্বদা জ্বাজ্বল্যমান। তিনি সোনার সিংহাসনে আসীন। পাশেই রয়েছে তাঁর বাহন, ভীষণদর্শন এক কুকুর। কালভৈরব শিবের ভীষণ, কঠোর ও কঠিনরূপের প্রতিমূর্তি। তিনি এই ভীষণমূর্তি ধারণ করেছিলেন ব্রহ্মার প্রতি ক্রোধবশত।
আসলে, ব্রহ্মাকে আমরা সকলেই চতুরানন বলেই জানি; কিন্তু পুরাণকালে তিনি ছিলেন পঞ্চানন। অর্থাৎ, তাঁর পাঁচটি মাথা বা মুখ ছিল। সেই মাথা বা মুখটি ছিল ওপরের দিকে। চারটি দিকে ব্যাপ্ত সেই চার মুখে শাস্ত্রকথা বললেও একদা নিজেকে সকলের চেয়ে, এমনকি শিবের চেয়েও বড় বলে প্রমাণ করতে পঞ্চম মুখটি দিয়ে ব্রহ্মা শিব-নিন্দে শুরু করলেন।
তারপর থেকেই ব্রহ্মা যখন তখন সুযোগ পেলেই 'অসভ্য বাঘছালধারী', 'এক-মুন্ডী'—বলে শিবকে উপহাস করতে শুরু করলেন। আপাত-শান্ত শিবও অবশ্য উদাসীন হয়ে ক্রমাগত সে-সব উপেক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু, এই উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে একদিন ব্রহ্মা খুব বাড়াবাড়ি শুরু করলেন; ভিখারি বলে, মূর্খ বলে, অক্ষম বলে, নিকৃষ্ট তমোগুণ-জাত বলে শিবকে বারবার অপমান করতে লাগলেন। তখন শিব আর কিছুতেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারলেন না, অসম্ভব রেগে গিয়ে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ এক ভীষণ পুরুষের রূপ ধারণ করলেন।
শিবকে এভাবে রাগিয়ে দিতে পেরে ব্রহ্মা যেন আরও মজা পেলেন, প্রবল উৎসাহে পঞ্চম মুখ দিয়ে নিন্দের বন্যা বইয়ে দিতে লাগলেন। তখন রুদ্ররূপী শিব প্রচণ্ড একটি হুঙ্কার ছেড়ে বাঁ-হাতের নখ দিয়ে ব্রহ্মার সেই নিন্দুক মুখটি খুলি অর্থাৎ করোটিশুদ্ধ উপড়ে নিলেন। অমনি অসম্ভব যন্ত্রণায় ব্রহ্মার পাগলপারা অবস্থা হল, তিনি চিৎকার করতে করতে ত্রিভুবন জুড়ে ছুটতে লাগলেন, কিন্তু কোথাও শান্তি পেলেন না। অন্যদিকে ব্রহ্মাকে শাস্তি দিয়ে শিবও স্বস্তি পেলেন না। তাঁর হাতে আঁঠার মতো আটকে গেল সেই করোটি। কিছুতেই হাত থেকে সেটা আর মুক্ত করতে পারলেন না! তখন তিনি নিরুপায় হয়ে ছুটলেন স্রষ্টা বিষ্ণুর কাছে। চোখের সামনে দুই অঙ্গজের বিরোধ দেখে বিষ্ণু তখন নিতান্তই অসুখী এবং অসন্তুষ্ট হয়ে বসে ছিলেন। এই অবস্থায় অসহায় শিব বিষ্ণুর কাছে হাজির হয়ে তাঁকে প্রণাম করলেন। জানতে চাইলেন এই করোটি থেকে মুক্তির উপায়।
অবশেষে বিষ্ণুর উপদেশে শিব বারাণসীধামে এসে গঙ্গায় স্নান করে বসলেন এক কঠিন তপস্যায়। তাঁর দীর্ঘ ত্যাগ ও তপস্যায় একদিন বিষ্ণু তুষ্ট হলেন। তখন তাঁর আশীর্বাদে শিবের হাত থেকে খসে পড়ল ব্রহ্মার করোটি। তিনি মুক্ত হলেন। ‘করোটি’র আর-এক নাম, ‘কপাল’। তাই যে-স্থানে তপস্যা করায় শিবের হাত থেকে করোটি বা কপাল মোচিত হল, সেই স্থান পুরাণে ‘কপালমোচন’ নামে প্রসিদ্ধ হল। শিব নিজে কপালমুক্ত হয়েও এই স্থান থেকে বিদায় নিলেন না, তিনি মানুষকে অহংকার ও বিদ্বেষমুক্ত হয়ে মুক্তির কথা মনে করিয়ে দিতেই ভৈরবরূপে অধিষ্ঠিত হয়ে রইলেন এই স্থানে। বিশ্বনাথের মন্দির থেকে দেড়-দুই কিমি দূরেই রয়েছে কালভৈরবের মন্দির। কাশী পরিক্রমায় প্রতিটি তীর্থযাত্রীই এই মন্দিরে অবশ্যই একবার তাঁর চরণে প্রণতি জানিয়ে আসেন।
আপনারা সকলেই জানেন যে, যে তীর্থে ভৈরব থাকেন, সেই তীর্থে দেবী আদ্যাশক্তিও থাকেন। থাকেন সতীপীঠের অধিষ্ঠাত্রী হয়ে। কালভৈরব যেমন সেই পুরাণকাল থেকে বারাণসীকে রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে নগরকোটালরূপে সমস্ত কাশীবাসীর কাছে পূজিত হয়ে আসছেন; তেমনি তীর্থযাত্রীদের কাছে পূজিত হয়ে আসছেন কাশী-সতীপীঠের দেবী বিশালাক্ষীর রক্ষাকর্তা ভৈরবরূপে। কেননা, দেবীকে দর্শন ও পূজন করার পর ভৈরবকে পুজো ও দর্শন না-করলে সম্পূর্ণ তীর্থফল লাভ করা যায় না।
হ্যাঁ, কাশীর সতীপীঠে দেবীর নাম ‘বিশালাক্ষী’। ‘তন্ত্রচূড়ামণি’ গ্রন্থে এই পীঠ সম্পর্কে বলা হয়েছে—
‘বারাণস্যাং বিশালাক্ষী দেবতা কালভৈরবঃ
মণিকর্ণীতি বিখ্যাতা কুণ্ডলঞ্চ মম শ্রুতেঃ।।’
এই শ্লোকের অর্থ, বারাণসীতে বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হয়ে দেবীর কানের ‘মণিকর্ণিকা’ নামের কুণ্ডল পতিত হয়েছিল। দেবী এখানে ‘বিশালাক্ষী’ নামে অধিষ্ঠিতা, আর তাঁর ভৈরবের নাম ‘কালভৈরব’।
দেবীর ‘মণিকর্ণিকা’ নামের কুণ্ডল যেখানে পতিত হয়েছিল, সেই স্থান ‘মণিকর্ণিকা’ নামেই প্রসিদ্ধ। কাশীর যে সমস্ত ঘাট অত্যন্ত পবিত্র বলে গণ্য করা হয়, তার মধ্যে ‘মণিকর্ণিকা ঘাট’ অন্যতম। কাশীর পৌরাণিক রাজা হরিশ্চন্দ্রর স্মৃতিবিজড়িত ঘাটে শবদাহ হয়, আর হয় এই মণিকর্ণিকাতেও। তবে এখন হরিশ্চন্দ্র ঘাটে খুব কমই শবদাহ হতে দেখা যায়, কিন্তু মণিকর্ণিকায় চিতার আগুন কখনও নিভতে দেখা যায় না। একটার পর একটা শব সেখানে আসে দাহের জন্য। ভক্তদের বিশ্বাস, এখানে স্বয়ং শিব চিতায় লগ্ন প্রতিটি শবের কানে তারকব্রহ্ম মন্ত্র দিয়ে তাকে মুক্ত করে দেন। প্রশ্ন হল, এই ঘাটে শিব কেন সর্বদা বিরাজ করছেন? কারণ, তিনি যাঁর রক্ষকর্তা তথা ভৈরব, সেই আদ্যাশক্তি স্বয়ং এই শ্মশানের পিছনে ও বিশ্বনাথ মন্দিরের নিকটস্থ সতীপীঠেই বিরাজ করছেন।
ভক্তদের বিশ্বাস, দেবী সতীর মণিকর্ণিকা-কুণ্ডল বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হওয়ার পর তা মাটিতে পতিত হওয়ার পরই শিলারূপ ধারণ করে। সেই শিলাই এখন পূজিত হয়। তাই কাশীর বিশালাক্ষী মন্দিরে কোন দেবীমূর্তি বা বিগ্রহ দেখা যায় না। তবে গর্ভগৃহে দু’খানা কালো পাথর দেখা যায়। একখানা বড়। এটি পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রাচীন যে শিলাটি দেবীর কুণ্ডল হিসেবে দেখা হয়, সেটি আকারে বেশ ছোট। সেটি রয়েছে গর্ভগৃহের ভেতরে একটু পিছনের দিকে। এ-কথা সবাই হয়তো জানেন না। তবে যিনি এই রহস্যের কথা জানেন, তিনি অবশ্যই সেই এই প্রাচীন শিলাটিকে দর্শন করে প্রণতি জানিয়ে ধন্য হন।
দেবীর মূর্তি নেই ঠিকই, তবে যে পৌরাণিকমন্ত্রে দেবীকে ভজনা করা হয়, সেখানে দেবীর রূপের বিবরণ আছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, দেবীর গাত্রবর্ণ ঠিক যেন সোনার মতো সমুজ্জ্বল। দেবী পরিধান করছেন রক্তের মতো লাল বস্ত্র। দেবীর গলায় মুণ্ডমালা। তিনি শিবের শায়িত শরীরের উপর সলাজে দাঁড়িয়ে। দেবীর দুই হাত। এক হাতে খড়্গ, অন্য হাতে ঢাল। আসলে, দেবীর নাম ‘বিশালাক্ষী’, কেননা, তিনি তাঁর বিশাল অক্ষি বা চোখ দিয়ে জগতের সমস্ত অন্যায়-অত্যাচার অবলোকন করে তাকে অসি দিয়ে সংহার করে শান্তি স্থাপন করেন। আর সকল ভক্তজনকে প্রশান্তি দান করেন। তাই দেবী যুদ্ধ সাজে সজ্জিতা হয়েও শান্তিদায়িনী, মুক্তিদায়িনী ও কৃপাময়ী মা। তাঁর বিশাল অক্ষিতে ধরা পড়ে জগতের সমস্ত আতুর। তাদের কেউই তাঁর কৃপা থেকে তাই বঞ্চিত হয় না।
ভাদ্রমাসে দেবীর মন্দিরে বিশেষ উৎসব পালিত হয়। উৎসবের নাম, ‘কাজলী তিজ’। এই উৎসব নারীদের। এতে স্বামীর দীর্ঘজীবন কামনা করে নারীরা কৃষ্ণা তৃতীয়াতে উপবাসব্রত পালন ও সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে দেবীর উপাসনা করেন। তাছাড়া এর মধ্য দিয়ে দেবীকে তুষ্ট করে অনেকেই আপন সহোদরের জন্যও বিশেষ আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। এছাড়া নবরাত্রি অনুষ্ঠানও এই মন্দিরে সাড়ম্বরে পালিত হয়। এই উপলক্ষ্যে বিশেষ পুজোয় দেবীর কৃপা পেতে মন্দিরে ভিড় জমান হাজার হাজার ভক্ত।।...