সতীপীঠঃ বৈষ্ণবক্ষেত্র বৃন্দাবনের মহিমাময়ী ‘মা কাত্যায়নী’

‘সেই বৃন্দাবনের লীলা অভিরাম’, অবিরাম স্রোতে বয়ে চলেছে আজও। বৃন্দাবন বা মথুরা যাই-ই বলুন না কেন, এই দুই তীর্থের নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মানসে মূর্ত হয়ে ওঠে এক যুগলমূর্তি, যে মূর্তিতে অচ্ছেদ্য আবেগে পার্থিব ও অপার্থিব প্রেমদানের কথা বলছেন শ্রীরাধা আর শ্রীকৃষ্ণ। তবুও এই তীর্থ শুধু বৈষ্ণবতীর্থ নয়, এই তীর্থ পঞ্চোপাসক হিন্দুর সমন্বয়ের তীর্থ। দেখুন, প্রতিটি ধর্মেই সাম্প্রদায়িক বিভেদ রয়েছে; যেমনঃ খ্রিস্টধর্মে ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট, ইসলামধর্মে শিয়া ও সুন্নি, বৌদ্ধধর্মে হীনযান ও মহাযান, জৈনধর্মে শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর, হিন্দুধর্মে শাক্ত, শৈব, সৌর, গাণপত্য ও বৈষ্ণব। প্রতিটি ধর্মে বিভিন্নভাবে এই সাম্প্রদায়িক ভেদ দূর করার কমবেশি চেষ্টা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধর্মসংস্কারকের নেতৃত্বে। হিন্দুধর্মে এই প্রচেষ্টারই একটি দিক আজও আমাদের চোখে পড়ে একই তীর্থভূমিকে অনেক সম্প্রদায়ের তীর্থভূমি করে এবং এক উপাস্যকে অনেকের উপাস্য করে তোলার মধ্য দিয়ে। আর এরই প্রকৃষ্ট এক উদাহরণ আমাদের সাধের তীর্থভূমি, উত্তর প্রদেশের বৃন্দাবন।

vrindaban-satipeeth

বৃন্দাবন শ্রীকৃষ্ণের বাল্য থেকে যৌবন অব্দি জীবনের লীলাভূমি। সেই লীলাতে এসে মিলিত হয়েছেন শ্রীরাধা। বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে গোপ, গোপী, গোপিনী এবং সমস্ত সাধারণ মানুষ। ফলে, সেই লীলার ব্যাপ্তি ও প্রভাব হয়েছে সুদূরপ্রসারী। জনমানসে সুনীতি, অভেদনীতি ও সুশিক্ষার উপকরণ জোগাতে তাই সচেতনভাবেই ধর্মীয়মিলনের উদাহরণ এই লীলার মধ্যে যুক্ত করা হয়েছে। যেমনঃ

শৈবদের আরাধ্য দেবতা একমাত্র শিব। বৃন্দাবনে প্রাচীন এক শিবের মন্দির রয়েছে। কিংবদন্তি অনুসারে, এই শিব শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলায় অংশ নিতেন। এমনকি গোপীবেশ ধারণ করে তিনি শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলাতেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাই এই শিবকে ‘গোপেশ্বর’ বা ‘গোপীশ্বর’ শিব বলা হয়। বৈষ্ণব-আরাধ্য শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন লীলার সঙ্গে শৈবদের দেবতা শিবের এই যে সমন্বয় ও সম্মিলন দেখানো হয়েছে বারে বারে, এতে সম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথাই কিন্তু সচেতনভাবে বলা হচ্ছে। বৃন্দাবনের ভূমিতে সৌর সম্প্রদায়ের আরাধ্য সূর্যের পুজো প্রসঙ্গ তো ভাগবতে রয়েছে, এখনও স্নানের সময় ভক্তজন সূর্য প্রণাম করেন।

শাক্তদের আরাধ্যা দেবী কালী ও দুর্গা এবং তাঁদের বিভিন্ন রূপ। কালীর সঙ্গে শিব তো অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, এ-কথা আমরা সকলেই জানি। আবার শক্তিপীঠ যদি একান্ন সতীপীঠের একটি হয়, তাহলে সেই পীঠের আরাধ্যা দেবীর ভৈরব হিসেবে শিবের উপস্থিতি অবশ্যম্ভাবী। এভাবেই শৈবদের শিবের সঙ্গে শাক্তদের শক্তিকে জুড়ে দিয়ে সচেতনভাবে সাম্প্রদায়িক মিলনের চেষ্টা করা হয়েছে। আবার এই শক্তিদেবীর কালিকামূর্তিকে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে অভেদ এবং শ্রীরাধিকার পূজ্যা—এভাবে দেখানো হয়েছে। কাহিনি অনুসারে, রাধাকৃষ্ণের প্রেম রাধার স্বামী আয়ানকে সঙ্গে নিয়ে হাতেনাতে ধরতে গিয়েছিলেন ননদী কুটিলা। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের লীলায় তাঁরা কুঞ্জবনে গিয়ে দেখলেন যে, শ্রীরাধা কালোবরণ শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে প্রেম করছেন না, করছেন কৃষ্ণকালী অর্থাৎ শ্যামাকালীর পুজো। আবার দেবী দুর্গা বা কাত্যায়নীর ব্রতপুজো করে গোপিনীদের শ্রীকৃষ্ণকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার বাসনা পূর্ণ হয়েছিল। সুতরাং এভাবে শাক্ত, শৈব ও বৈষ্ণবের মেলবন্ধন বারে বারে ঘটানো হয়েছে বৃন্দাবনের এই লীলাভূমিতে; বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত হিন্দুধর্মের ধারাকে মিলনের ধারাপথে বইয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করা হয়েছে। তাই এই তীর্থ সমস্ত ভক্তজনের কাছে বিশেষ।

সংস্কারে ও সাধনায় বৈষ্ণব এবং শাক্তের বিরোধের যে ক্ষত, তা নিরাময় করতে শ্রীকৃষ্ণলীলার মধ্যে দেবী শক্তির অন্যতম রূপ দেবী যোগমায়ার প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ঘটানো যেমন হয়েছে, দেবী শক্তির বিভিন্ন রূপের উপাসনা যেমন করানো হয়েছে, তেমনি বৃন্দাবনধামে দেবী সতীর একান্নপীঠের অন্যতম এক পীঠের প্রতিষ্ঠাও ঘটানো হয়েছে। শোনা যায়, বৃন্দাবনের কেশীঘাটে ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হয়ে দেবী সতীর কেশরাশি পতিত হয়েছিল। এবং সেই কেশরাশি শিলায় রূপান্তরিত হয়ে পীঠ গড়ে উঠেছে। অনেকেই মনে করেন যে, কেশীঘাটের নাম দেবীর পতিত কেশরাশির জন্যই হয়েছে, তা ঠিক নয়। মথুরার রাজা কংস শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামকে হত্যার জন্য অনেক অসুর, দৈত্য ও দানবীকে পাঠিয়েছিল। এদেরই একজন হল, কেশীদৈত্য। শ্রীকৃষ্ণ এই কেশীদৈত্যকে যমুনা কিনারে বধ করেন। তিনি যেখানে তাকে বধ করেন, সেই স্থান দৈত্যের নামে ‘কেশীঘাট’ নামে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে।

বৃন্দাবনের এই সতীপীঠের আরাধ্যা দেবীর নাম, ‘যোগমায়া’। কিন্তু লোকসাধারণের কাছে তিনি ‘উমা’ ও ‘কাত্যায়নী’ নামেই অভিহিতা হয়ে থাকেন। দেবীর গায়ের রঙ সোনার মতো উজ্জ্বল। সেই উজ্জ্বলতা আনতে দেবীর ছলনবিগ্রহ তৈরি হয়েছে ব্রোঞ্জ দিয়ে। দেবীর চারটি হাত। সেই হাতে রয়েছে অস্ত্রমালা ও বরাভয়। দেবীর হাতে অস্ত্র থাকলেও মুখে তাঁর অপার প্রসন্নতা। সেই প্রসন্নতায় রয়েছে আশ্রয়ের আশ্বাস। দেবীর সঙ্গে দেবীর তলোয়ার ‘উজ্জ্বল চন্দ্রহাস’-ও এখানে পূজিত হয়। ভক্তজনের বিশ্বাস, দেবী রোগ-ভয় থেকে ভক্তদের রক্ষা করেন। দেবীর ভৈরবের নাম, ‘ভূতেশ্বর’। তাঁর মন্দির রয়েছে ভূতেশ্বর রোডে। তন্ত্রগ্রন্থে বৃন্দাবনের এই পীঠ সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

‘বৃন্দাবনে কেশজালমুমা নাম্নী চ দেবতা

ভূতেশো ভৈরব স্তত্র সর্বসিদ্ধিপ্রদায়কঃ।’

 

নবরাত্রি উৎসব এই মন্দিরে খুব ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়। নিত্যদিন ভক্তজনের ভিড় থাকে এই মন্দিরে। প্রতিদিন প্রচুর দর্শনার্থী পর্যটক এই মন্দিরে আসেন। তাছাড়া এই দেবীর পুজো ও ব্রত করে গোপিনীরা শ্রীকৃষ্ণকে স্বামী হিসেবে পেয়েছিলেন; এ-কথা মাথায় রেখেই এখনও কুমারী মেয়েরা মনের মতো স্বামী পাবার জন্য এই মন্দিরে পুজো দিতে আসেন। তবে দেবীর যে মন্দিরটি এখন ভক্তজন দেখেন, তা বেশিদিনের পুরনো নয়; ১৯২৩ সালে স্বামী কেশবানন্দ এই মন্দির নির্মাণ করান। মার্বেল পাথরে নির্মিত এই মন্দির যেন শান্ত, সৌম্য, সমাহিত এক শান্তির আশ্রয়। এই মন্দিরে দেবী উমা কাত্যায়নীর পাশাপাশি শিব, বিষ্ণু, গণেশ, সূর্য—পঞ্চোপাসক হিন্দুর পাঁচটি সম্প্রদায়ের সকলের আরাধ্য দেবদেবীর পুজো করা হয়। ফলে, এই মন্দির শুধু এক শাক্ত মন্দির নয়, একান্নপীঠের অন্যতম এক মন্দির নয়; এই মন্দির হিন্দুদের এক ধর্মীয় মিলনকেন্দ্র।।...  

              

   

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...