‘চিত্রকূট’ নামক পর্বত ও স্থানের কথা কে না জানেন! বাল্মীকি রামায়ণে এই স্থানের কথা প্রথম উল্লিখিত হয়েছে, সেখান থেকেই আমরা জানতে পারি এই স্থান কত না পবিত্র। আদিকবি বাল্মীকির পর মহাকবি কালিদাস, তুলসীদাসের মতো রামগাথার নবরূপকারেরাও এই স্থানের অজস্র গুণকীর্তন করেছেন। আর এই গুণকীর্তন করতে গিয়েই মহাকবি কালিদাস তাঁর রামকথামূলক কাব্যসমূহে শ্রীরামের পদধূলিধন্য রামায়ণের চিত্রকূট পর্বতমালায় উপস্থিত অনেকগুলো চূড়ার মধ্যে যেটি শ্রীরামের বহুস্মৃতি ধারণ করে আছে, তার নাম দিয়েছিলেন, ‘রামগিরি’।
রামায়ণের কালে চিত্রকূট ছিল এক বিস্তৃত ও গহন অরণ্যময় পর্বত। মহর্ষি বাল্মীকি-রচিত রামায়ণের কাহিনি থেকে আমরা জানতে পারি যে, পিতৃসত্য পালনের জন্য শ্রীরাম ভ্রাতা লক্ষ্মণ ও পত্নী সীতাকে নিয়ে যে চৌদ্দ বছর বনবাস যাপন করেছিলেন; তার মধ্যে সাড়ে এগারো বছর যাপন করেছিলেন এই স্থানেই। পিতার মৃত্যু-সংবাদ পেয়ে পিতার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান তিনি এই স্থানেই সম্পন্ন করেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন স্বর্গের সমস্ত দেবতারা, পুণ্যকর্মা সাধু ও ঋষিরা। তাছাড়া সেই সময় এই স্থানে মহামুনি অত্রি, সতী অনসূয়া, দত্তাত্রেয়, মহর্ষি মার্কণ্ডেয়, শরভঙ্গ, সুতীক্ষ্ণ-র মতো মহান দেবাংশীরা বাস করেছেন, তপ করেছেন, সিদ্ধিলাভ করেছেন। কিংবদন্তি অনুসারে, এই চিত্রকূট পর্বতের রামগিরিতীর্থে এসে সন্তকবি তুলসীদাস তাঁর পরম আরাধ্য শ্রীরামচন্দ্রের সাক্ষাৎ দর্শন পেয়ে ধন্য হয়েছিলেন। কাজেই, সমস্ত দেবতা ও মহাত্মাদের পদধূলিধন্য এই স্থান বিশ্বের মহান মাহাত্ম্যময় স্থানগুলির একটি। এবং স্বভাবতই এই স্থান হিন্দুদের কাছে একটি অতি পবিত্র তীর্থভূমি।
তবে চিত্রকূটের রামগিরি শুধুই রামায়ণ-যুগের মাহাত্ম্য বক্ষে ধারণ করে পুণ্যতীর্থ নয়; এই তীর্থ একান্নপীঠের অন্যতম এক সতীপীঠও বটে। শাক্তশাস্ত্র মতে, এই স্থানে ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হয়ে দেবী সতীর ডানদিকের স্তন পতিত হয়েছিল। দেবী সতীর এই পীঠে শক্তিমূর্তিরূপে বিরাজ করছেন মা ‘শিবানী’। আর তাঁর ভৈরবরূপে রয়েছেন দেবাদিদেব মহাদেব, তবে এখানে তাঁর নাম ‘চণ্ড’। প্রসিদ্ধ তন্ত্রগ্রন্থ ‘তন্ত্রচুড়ামণি’-তে তাই বলা হয়েছেঃ
‘রামগিরৌ স্তনান্যশ্চ শিবানী চণ্ডভৈরবঃ।’
রামায়ণের অরণ্যময় ‘চিত্রকূট’ এখন বিশিষ্ট জনপদ। চিত্রকূটের অরণ্য লুপ্ত হয়ে ক্রমে বিকশিত হয়েছে ‘করবী’, ‘সীতাপুর’, ‘কামতা’, ‘খোয়ী’, ‘নয়া গাঁও’ প্রভৃতি গ্রাম। পুণ্যসলিলা মন্দাকিনী নদীর তীরে চিত্রকূট পাহাড় ও এই সকল জনপদ অবস্থিত। চিত্রকূট পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে অঙ্কিত রয়েছে উত্তর প্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের সীমান্তরেখা। কাজেই এই পাহাড়কে ঘিরে দুই রাজ্যে ছড়িয়ে আছে নানান পৌরাণিক আশ্রম, মন্দির ও বিশিষ্টস্থান। রামচন্দ্রের সঙ্গে ভাই ভরতের যেখানে সাক্ষাৎ হয়েছিল, সেখানে রয়েছে ‘ভরতমিলাপ মন্দির’। এছাড়াও রয়েছে ‘অনসূয়া-অত্রি আশ্রম’, মন্দাকিনী নদীর যে ঘাটে শ্রীরাম স্নান করতেন, রয়েছে সেই ‘রামঘাট’। রয়েছে দেবী সীতার স্নানের পুষ্করিণী, ‘সীতা বা জানকি কুণ্ড’। রয়েছে শ্রীরামের বিশ্রামস্থানে ‘স্ফটিক শিলা’। রয়েছে ‘হনুমানধারা’, ‘গুপ্ত গোদাবরী’, ‘ভরতকূপ’। আর শক্তিপীঠে রয়েছেন স্বমহিমায় দেবী শিবানী।
দেবী শিবানীর এই মন্দির সাধারণের কাছে ‘রামগিরি শিবানী মন্দির’ হিসেবেই বেশি পরিচিত। কথিত আছে যে, দেবী সীতা ও প্রভু শ্রীরাম এই দেবীর পুজো করেছিলেন। শ্রীরাম পিতার যে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করেছিলেন, তাও এই পীঠের কাছেই। এই কিংবদন্তিকে মাথায় রেখে সাধারণের বিশ্বাস যে, মন্দাকিনীর পুণ্যসলিলে স্নান করে দেবীর পুজো করে পীঠের নিকটবর্তী স্থানে পিতামাতার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করলে তাঁদের আত্মার সদগতি হয়। তাই অসংখ্য ভক্তজন এখানে এসে পিতামাতার শ্রাদ্ধকর্ম করে থাকেন।
দেবীর মূর্তি কালো পাথরে নির্মিত। তাঁর সুগোল মুখমণ্ডল। ঠোঁট যেন তাম্বুলরাঙা। প্রশান্ত এক স্মিত হাসি সর্বদা বিরাজ করছে তাঁর ঠোঁটে। সেই হাসি আশ্রয় দেয়, প্রশ্রয় দেয়, আর দেয় পার্থিব এক প্রশান্তি। শিবানী মায়ের পটলচেরা দুই চোখ বড়ই মায়াময়। রুপোর পাত দিয়ে সেই চোখের আকার গড়ে তোলা হয়েছে। কপালে আঁকা রয়েছে বিস্তৃত রৌপ্যময় তিলক। রামভূমিতে দেবীর মূর্তিতে শ্রীরামের মতোই কেবলই করুণা বিরাজ করছে, অন্যান্য তীর্থের মতো কোনরকম ক্রুরতা দেবীর মূর্তিতে নেই। তিনি এখানে পূর্ণরূপেই করুণাময়ী মা। দেবীর হাতে কোন অস্ত্র নেই। তাঁর মাথায় সাধারণ দেখতে রত্নমুকুট, কানে কুণ্ডল, অঙ্গ বস্ত্রে আবৃত। হাতে কোন আয়ুধ নেই। তাঁর হস্ত যেন সন্তানকে কোলে তুলে প্রশান্তির পরশ দেবার জন্য আঁচলের তলায় অপেক্ষমান। তাই তাঁকে দর্শন করে অবলীলায় অনুভব করা যায় আমাদের আবহমান মাতৃরূপের পূর্ণসত্তা।
রামভূমিতে অনাবশ্যক অপ্রয়োজনীয় কোন হিংস্রতা নেই। তাই শক্তিপীঠ হলেও এখানে কোন পশুবলি হয় না। করুণাময়ী মা বোধহয় নিজে সেটা চানও না। সমস্ত জগতসংসারই তো তাঁর সন্তান। মা হয়ে কী করে সেই সন্তানের রক্ত তিনি দেখবেন! তবে শাক্তশাস্ত্র মতে বলিদানের রীতি একটি পালিত হয় প্রতীকী আচারের মধ্য দিয়ে। নারকেলের মালাকে এখানে জীব হিসেবে কল্পনা করে তার ভেতরে থাকা জলকে রক্ত হিসেবে কল্পনা করা হয়। আর দেবীর থানে নারকেল ফাটিয়ে তা উৎসর্গ করে বলি-নিবেদনের আচার পালিত হয়। দেবীর থানে মাথা ঠেকিয়ে কপাল রগড়াতে রগড়াতে মনে মনে তাঁর কাছে মানত করলে তা পূরণ হয়, এমনটাই সাধারণের বিশ্বাস। তাই অনেক ভক্তজন এখানে এভাবেই দেবীর কাছে কৃপাপ্রার্থনা জানান।
দেবীর মন্দিরে নবরাত্রি, অমাবস্যা, সোমবতী অমাবস্যা, দীপাবলি, শারদপূর্ণিমা ও মকর সংক্রান্তিতে বিশেষ উৎসব পালিত হয়। দেশের নানান প্রান্ত থেকে প্রচুর ভক্ত এই বিশেষ পার্বণ উপলক্ষে এখানে আসেন। উপোষ করে অনেকেই এই সময় ব্রতপালনও করে থাকেন। এখানে দুর্গাপুজো বেশ ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়। এছাড়া মহাশিবরাত্রির অনুষ্ঠানও এখানে খুব জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়। এই সব উৎসবে সাধারণ ভক্তের সমাগম এতই প্রবল হয় যে, মন্দিরে তিলধারণের স্থান থাকে না। সাধারণ ভক্তদের পাশাপাশি এই সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য সাধুসন্ত এই শক্তিপীঠে আসেন বিশেষ সাধনার উদ্দেশ্যে।
সত্যি বলতে কী, পৌরাণিক কাল থেকে আজ পর্যন্ত চিত্রকূট পর্বতের রূপের হয়তো অনেক পরিবর্তন ঘটেছে, কিন্তু তার সৌন্দর্যের অসাধারণ বিভা এখনও সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি করা যায়। কেননা, বিভিন্ন ঋতুতে এই তীর্থের সৌন্দর্যে এক এক রকমের রূপান্তর ঘটে। সবুজ-শ্যামলী এই পাহাড়-অরণ্যময় তীর্থ তার সেই বর্ণময় সৌন্দর্য ও যুগ যুগ ধরে বয়ে চলা দৈবীমাহাত্ম্য দিয়ে তীর্থযাত্রী, পর্যটক ও ভক্তজনের মনকে শান্ত করে প্রাণকে জুড়িয়ে হৃদয়কে প্রশান্তি দিয়ে অন্য এক মোক্ষের সন্ধান দেয়। আর তার টানেই এই তীর্থে বার বার ছুটে আসেন মোক্ষসন্ধানী মানুষেরা।।...