মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী। পৌরাণিক ও ইতিহাসপ্রসিদ্ধ এক স্থান। পৌরাণিক, কেননা এই স্থান শ্রীকৃষ্ণ থেকে বুদ্ধদেব সকলের স্মৃতিধন্য; ঐতিহাসিক, কেননা, এই স্থান রাজা বিক্রমাদিত্য, কবি কালিদাস, সম্রাট অশোকের স্মৃতিবিজড়িত। তাছাড়া এই স্থান যেমন এক বিখ্যাত শৈবতীর্থ, তেমনই বিখ্যাত এক শাক্ততীর্থও বটে। সমগ্র ভারতবর্ষজুড়ে যে বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গ রয়েছে, তারই একটি রয়েছে প্রসিদ্ধ শিপ্রা নদীর তীরে এখানকার ভৈরব পাহাড়ে। মহাদেব এখানে ‘মহাকাল’ নামে পূজিত হন। তাঁর মন্দিরের সন্নিকটেই রয়েছে রুদ্রসাগর সায়র। সেই সায়রের তীরে রয়েছে দেবী সতীর পীঠমন্দির। মন্দিরটি একান্নপীঠের অন্যতম। পীঠের আরাধ্যা দেবী ‘হরসিদ্ধি’ আর তাঁর ভৈরব হলেন এই ‘মহাকাল’।
‘পীঠনির্ণয়’ তন্ত্রগ্রন্থে এই স্থানকে ‘অবন্তী’ বলা হয়েছে। ‘অবন্তী’ উজ্জয়িনীর প্রাচীন নাম। তন্ত্রগ্রন্থটি অনুযায়ী ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হয়ে এখানকার শিপ্রা নদীর তীরে ভৈরব পাহাড়ের অরণ্যে দেবীর ওষ্ঠ পতিত হয়েছিল। এখানে পতনের কারণ এই স্থান ছিল শিবের প্রিয়। তাছাড়া শিপ্রা নদী পুণ্যসলিলা এক নদী। কেননা পুরাণ মতে, এই নদীর জলে অমৃতবিন্দু পতিত হয়েছিল। এই পীঠস্থানে দেবীর কোন মূর্তি নেই। রয়েছে একটি শিলাখণ্ড। সেই শিলায় আঁকা রয়েছে তান্ত্রিকযন্ত্র ও কিছু মন্ত্র। সেই সঙ্গে শিলাতে সিঁদুর দিয়ে চোখ-মুখও আঁকা রয়েছে। দেবী এই শিলাতেই পূজিতা হন।
দেবী এখানে অত্যন্ত জাগ্রতা। কেননা, স্বয়ং মহাদেব তাঁকে তপস্যার মধ্য দিয়ে জাগ্রত করেছিলেন। কীভাবে করেছিলেন, তাই নিয়ে ‘স্কন্দ পুরাণ’-ঘেঁষা একখানা কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছেঃ
যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সেই সময় উজ্জয়িনীর ভৈরব পাহাড় ছিল গভীর এক অরণ্যে আবৃত। সেই অরণ্যের নাম ছিল ‘মহাকাল বন’। তো, সেই সময় অসুরলোকে ত্রিপুরাসুর নামের এক অসুর দারুণ ক্ষমতা লাভ করে বসেছিল। তার ওপর কঠিন তপস্যা করে ব্রহ্মার কাছ থেকে বর আদায় করে নিয়েছিল যে, শিবের হাতে ছাড়া আর অন্য কারও হাতে সে মরবে না। মরবে না শিবের অর্জিত বিশেষ অস্ত্র ছাড়া।
ত্রিপুরাসুর ভেবেছিল যে, শিব সর্বদাই ধ্যানে মগ্ন থাকেন, অকালে তাঁর ধ্যান ভঙ্গ করলে তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। তাই অসময়ে তাঁর ধ্যান ভাঙানোর সাহসই কেউ করে না, তার ওপর তাঁকে দিয়ে বিশেষ অস্ত্র অর্জন করানো তো আরও দুষ্কর। ফলে, শিব সহজে তাঁকে হত্যা করতে আসবেন না, সেও অত সহজে মরবে না। সুতরাং, ব্যাপারটা প্রায় অমরত্বের মতোই যেন দাঁড়াল আর কী! যেই না একথা ভাবা, অমনি তার আসুরিক প্রবৃত্তি বহুগুণে বেড়ে তাকে বেপরোয়া করে তুলল। তাতেই সে স্বর্গ আক্রমণ করে দেবতাদের মেরেধরে সেখান থেকে বিতাড়িত করে ত্রিলোকের অধীশ্বর হয়ে বসল। ‘ত্রাহি ত্রাহি’ রব তুলে পরাজিত ও বিতাড়িত দেবতারা ব্রহ্মার শরণ নিলেন। ব্রহ্মা আবার সকল দেবতাদের নিয়ে এ কাজের অধিকারী মহাদেবের শরণে এলেন।
ব্রহ্মাসহ দেবতারা যথাবিহিত বন্দনা ও পূজার মধ্য দিয়ে শিবকে তুষ্ট করে তাঁর ধ্যানভঙ্গ ঘটালেন। তারপর সব শুনে শিব দেবতাদের সহায় হয়ে দুষ্টের দমন করতে রাজি হলেন। তিনি পাড়ি দিলেন মহাকাল বনে। সেখানে গিয়ে দেবী সতীর অঙ্গ পতনের স্থানে গিয়ে তপস্যায় বসলেন। শুরু করলেন দেবী শক্তির আরাধনা। আরাধনা করতে লাগলেন তাঁর রুদ্ররূপিণী চণ্ডিকা মূর্তির। দীর্ঘ ও কঠোর তপস্যার পর দেবী শক্তি তুষ্ট হয়ে দেখা দিলেন মহিষমর্দিনী চণ্ডিকারূপে। বললেন, হে দেব, তোমার তপে আমি তুষ্ট, বল কী বর চাও?
শিব তখন দেবীকে প্রণতি জানিয়ে ত্রিপুরাসুরের বৃত্তান্ত বর্ণনা করে বললেন, হে দেবী, আমাকে এমন এক অস্ত্র দান কর, যা দিয়ে আমি ত্রিপুরাসুরকে বধ করতে পারি।
দেবী তখন মহাদেবের হাতে এক কালান্তক অস্ত্র তুলে দিলেন। যে অস্ত্রের নাম, ‘পাশুপত অস্ত্র’। এই অস্ত্র দিয়েই ভীষণ সংগ্রামের শেষে মহাদেব ত্রিপুরাসুরকে বধ করে দেবতাদের হাতে পুনরায় স্বর্গরাজ্য ফিরিয়ে দিলেন, ত্রিজগতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করলেন।
ত্রিপুরাসুরের বিরুদ্ধে এই বিজয়ের কথা স্মরণে রাখতে দেবতারা ‘অবন্তী’র নাম ‘উজ্জয়িনী’ রাখেন। ‘উজ্জয়িনী’ কথাটা এল ‘উজ্জিত’ থেকে, যার অর্থ, ‘পরাজয়’। অর্থাৎ, এই স্থানে মহাদেব তাঁর প্রবল শত্রুকে পরাজিত করেছিলেন।
দেবী তো জাগ্রতা হলেন, কিন্তু তাঁর তো একজন ভৈরব চাই। ভৈরব ছাড়া শক্তিমাহাত্ম্য সম্পূর্ণ হয় না। তাই শক্তিপীঠে দেবীদর্শনের পরই তাঁর ভৈরবকে দর্শন করতে হয়। নইলে তীর্থের ফল লাভ হয় না। ভৈরবরূপে মহাকাল এই শক্তিপীঠে কীভাবে আবির্ভূত হলেন, সে-কথাও জানা যায় এক পৌরাণিক কাহিনি থেকেঃ
পুরাকালে এই অঞ্চলে বেদপ্রিয় নামে এক ব্রাহ্মণ বাস করতেন। তাঁর ছিল চারটি যুবা পুত্র। পিতা ও পুত্রেরা সকলেই ছিল যথেষ্ট ধার্মিক, বিদ্বান ও পুণ্যবাণ শিবভক্ত। তারা বেশ নির্বিঘ্নেই ধর্মকর্মে কালাতিপাত করছিল, কিন্তু হঠাৎ একদিন তাতে বাধা হয়ে দাঁড়াল এক অসুর। সেই অসুরের নাম ‘দূষণ’। দেবতার বলে বলীয়ান হয়ে সে নিজেই নিজেকে দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইল। দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে ত্রিলোকের অধীশ্বর হয়ে নিজের পূজা সর্বত্র প্রচলিত করতে চাইল। ক্রমে ধর্মের চর্চা বন্ধ করে, সত্যের পথ নষ্ট করে ঘোর অধর্ম প্রতিষ্ঠা করল। ঘোষণা করল, কোথাও যদি কেউ দেবতাদের পুজো করে তাহলে সে তাদের নিজের হাতে বিনষ্ট করবে।
সকলেই দূষণের এই ঘোষণায় ভয় পেয়ে আরাধ্য দেবতাদের পুজো বন্ধ করে দিল। কিন্তু শিবভক্ত বেদপ্রিয় ও তার সন্তানেরা আপন আরাধ্য শিবের পুজো বন্ধ করল না। স্নানের পর তারা মাটির মূর্তি গড়ে নিত্যদিনের মতোই শুরু করল শিবের আরাধনা। সেই খবর পেয়ে হুঙ্কার ছেড়ে নিমেষে ছুটে এল দূষণ। তাদের হত্যা করতে উদ্যত হল। সম্মুখে উদ্যত মৃত্যু দেখে বেদপ্রিয়রা শিবের শরণ নিল। প্রকৃত ভক্তের এই বিপদে শিব চুপ করে রইলেন না। অমনি মাটির লিঙ্গের স্থানে বিকট শব্দ করে মাটি বিদীর্ণ করে উঠে এলেন বিরাট ও বীভৎস মহাকালরূপে। তিনি অসুরের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছেড়ে ক্রোধের আগুন দিয়ে তাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিলেন। ভক্তদের দূষণের অত্যাচার থেকে রক্ষা করলেন।
মহাকালের কৃপা এভাবে লাভ করে ব্রাহ্মণেরা বিপদ থেকে উদ্ধার হয়ে প্রথমেই তারা জগতের হিতের কথা ভাবল। করজোড়ে মহাকালের কাছে প্রার্থনা করল যে, হে প্রভু, তুমি যেমন আমাদের রক্ষা করলে, কৃপা করলে; তেমনি সকলকে কৃপা করতে চিরদিনের জন্য এখানেই অধিষ্ঠান কর।
মহাকালরূপী শিব এই নির্ভীক ও নিষ্ঠ ভক্তদের এমন পরহিতচিন্তা দেখে মুগ্ধ হলেন। তাই তাদের মনোরম অনুরোধ আনন্দের সঙ্গেই রক্ষা করলেন। অত্যন্ত তুষ্ট চিত্তে ‘তথাস্তু’ বলে আবির্ভাবকালে মাটি বিদীর্ণ হয়ে যে গর্ত তৈরি হয়েছিল, সেই গর্তের মধ্যে জ্যোতির্লিঙ্গরূপে বিরাজমান হলেন। মহাকাল মন্দিরে গেলে দেখবেন, তাই আজও মন্দিরের গর্ভগৃহে মহাকাল শিব লিঙ্গরূপে বিরাট এক গর্তের মধ্যে বিরাজ করছেন।
এবার বলি দেবী আদ্যাশক্তি এখানে ‘হরসিদ্ধি’ নামে অভিহিতা হলেন কেন, সেই কাহিনিঃ
কিংবদন্তি অনুসারে, একবার শিব আর শক্তি দুজনে অবসর যাপন করছিলেন পাশাখেলার মধ্য দিয়ে। এমন সময় চণ্ড ও প্রচণ্ড নামের দুই বিচকুটে অসুর সেখানে উপস্থিত হল। তারা নানারকম উৎপাতের মধ্য দিয়ে খেলায় মগ্ন মহাদেবকে উত্যক্ত করে আমোদ করতে লাগল। তাতে মহাদেব বিরক্ত হলেন, তাঁর ভ্রু কুঞ্চিত হল; কিন্তু তিনি খেলা ছেড়ে উঠলেন না।
স্বামীকে প্রসন্ন করতে এবং নিজেও প্রসন্ন থাকতেই শক্তি এই খেলার আয়োজন করেছেন। তাতে স্বামীর বিরক্তি শক্তির দৃষ্টি এড়াল না। বিরক্তির দুই মূর্তিমান কারণও তিনি দেখলেন। দেখলেন তাদের অসহ্য উৎপাতের নানান দৃষ্টান্ত। আর সহ্য হল না। ভীষণ রাগ হল। পাশেই পড়েছিল বিশাল একটা মুগুর। দেবী চণ্ড মূর্তি ধারণ করে সেই মুগুর দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়েই দুই অসুরকে বধ করে ফেললেন।
শক্তিকে এমন অনায়াসে দুই অসুরকে বধ করতে দেখে শিব প্রসন্ন হলেন। তাঁর কুঞ্চিত ভ্রু এবার স্বস্থানে ফিরে এল। দেবীকে বললেন, হে দেবী, আমারই ইচ্ছে করছিল এই দুই বিরক্তিকর অসুরকে এভাবে বধ করতে, কিন্তু খেলা ছেড়ে উঠতে পারছিলাম না। তুমি উদ্যোগী হয়ে নিজের হাতে আমার সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ করেছ। তাই আজ থেকে তোমার নাম হোক, ‘হরসিদ্ধি’!
হরের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে যেভাবে দেবী ‘হরসিদ্ধি’ হয়েছিলেন; সেভাবেই তিনি সমস্ত ভক্তদের সিদ্ধি দান করেন। তাদের মনের বাসনা পূর্ণ করেন। দেন পুণ্যপথের সন্ধান।
হরসিদ্ধি ইতিহাসপ্রসিদ্ধ রাজা বিক্রমাদিত্যের পরম আরাধ্যা দেবী। দেবী তন্ত্রমতে পূজিতা হন। শোনা যায়, বিক্রমাদিত্য তন্ত্রমতে কঠিন তপস্যা করে দেবীকে তুষ্ট করে দেবীর কৃপালাভে সমর্থ হয়েছিলেন। বিক্রমাদিত্যের কাল কত শত বছর আগেকার কাল। তাঁরও বহু যুগ আগে থেকে সময়ের প্রবাহ বেয়ে দেবী হরসিদ্ধি ভক্তজনকে সিদ্ধি দান করে সিদ্ধিদায়িনীরূপে মঙ্গলময়ী হয়ে আজও উজ্জয়িনী আলো করে বিরাজ করছেন।...