মহারাষ্ট্রের ‘নাসিক’ নগর। বিখ্যাত স্থান। এই নগরের নদীতটে বারো বছরে একবার কুম্ভমেলা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে সংগঠিত হয় কোটি কোটি ভক্তজনের ভিড়। নগরের খ্যাতি শুধুমাত্র এই জন্যই নয়। আসলে, এই নগরের সঙ্গে এবং তার নামকরণের সঙ্গে নানান দৈবীমাহাত্ম্য প্রাচীনকাল থেকেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আসলে এই নগরস্থানে ছোট ছোট ন’টি পাহাড় আছে, এই পাহাড়গুলিকে প্রাচীনকাল থেকেই স্বয়ম্ভূ শিব বলে মনে করা হয়। পূর্বে তাঁদের একত্রে বলা হত, ‘নব শিব’। তারপর যখন ধীরে ধীরে এই স্থান বসতিময় হয়ে উঠল, তখন লোকমুখে ক্রমে ক্রমে ‘নব শিব’ কথাটি পরিবর্তিত হয়ে ‘নাসিক’ স্থাননামটি গড়ে উঠল। সেই প্রাচীনকাল থেকেই ভক্তজনের বিশ্বাস, উক্ত ন’টি পাহাড়েই ভগবান শিবের সঙ্গে মা দুর্গাও একত্রে অবস্থান করেন। এমনই একটি পাহাড়ে রয়েছে দেবী সতীর একান্নপীঠের এক পীঠ। সেই পীঠের আরাধ্যা হিসেবে স্বয়ম্ভূ মূর্তিতে রয়েছেন, দেবী ভদ্রকালী।
আসলে, নাসিক নগরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ‘দক্ষিণ ভারতের গঙ্গা’ গোদাবরী নদী। এই পুণ্যসলিলা নদীর তীরেই রয়েছে ‘পঞ্চবটি’ অঞ্চল। ‘পঞ্চবটি’ নামটি আদিমহাকাব্য ‘রামায়ণ’-এর মহান কাহিনিসূত্রে আমাদের সকলেরই অত্যন্ত পরিচিত। আমরা জানি যে, গোদাবরী নদীর তীরের পঞ্চবটি বনে রঘুকুলতিলক শ্রীরামচন্দ্র পত্নী সীতাদেবী ও ভ্রাতা লক্ষ্মণকে নিয়ে কুটির বেঁধে বাস করতেন। পিতৃসত্যরক্ষার জন্য যে চোদ্দ বছরের বনবাস তাঁরা মাথায় তুলে নিয়েছিলেন, তার অনেকগুলো দিন তাঁরা এই অরণ্যে যাপন করেছিলেন। ফলে, তাঁদের জীবনের বহুবিচিত্র স্মৃতিতে বিজড়িত হয়েছে এই অরণ্য। রামকাহিনির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাটকীয় মুহূর্তগুলির সাক্ষী থেকেছে এই অরণ্য। শূর্পণখার নাসিকা ছেদন, মায়ামারীচ বধ, রাবণের সীতাহরণ সমস্তই ঘটেছে এই অরণ্যে। সত্যি বলতে কী, এই অরণ্যেই রামকাহিনির মোড় ঘুরেছে। তাছাড়া, এই অরণ্য-অঞ্চল আজও যুগান্তরের ঈশ্বর-পুরুষ শ্রীরামচন্দ্র, সীতাদেবী, শ্রীলক্ষণের পবিত্র পদধূলি ধারণ করে আছে। ভক্তজনের কাছে তাই এই ভূমির মাহাত্ম্যই আলাদা।
মাহাত্ম্যময় এই পঞ্চবটি অঞ্চলের ‘জনস্থান’ নামক স্থানেই রয়েছে সেই পাহাড়টি, যেখানে রয়েছে একান্নপীঠের অন্যতম এক পীঠ। পৌরাণিক কিংবদন্তি অনুযায়ী, ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শন কর্তৃক কর্তিত হয়ে এই পীঠে দেবী সতীর চিবুক পতিত হয়েছিল। প্রাচীন তন্ত্রগ্রন্থ ‘তন্ত্রচূড়ামণি’-তে স্পষ্টতই বলা হয়েছে যে—
‘চিবুকে ভ্রামরি দেবী বিকৃতাক্ষ জনস্থলে’।
শ্লোকাংশটির অর্থ, প্রাচীন ‘জনস্থল’, পরবর্তীকালের ‘জনস্থান’ অঞ্চলে দেবী সতীর চিবুক পতিত হয়েছিল। এই পীঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবী আদ্যাশক্তি এখানে ‘ভ্রামরী দেবী’ নামে পূজিতা হন এবং তাঁর ভৈরব মহাদেব পূজিত হন ‘বিকৃতাক্ষ’ নামে।
পুরাণ ও তন্ত্রগ্রন্থে এই পীঠের দেবী ‘ভ্রামরী’ নামে পূজিতা হলেও স্থানীয় মানুষের কাছে তিনি ‘ভদ্রকালী’ নামেই অভিহিতা হন। পুরাণে ভ্রামরী দেবীকে মৌমাছিদের নিয়ন্ত্রা দেবী হিসেবে আরাধনা করা হয়। এই দেবী একইসঙ্গে বরদাত্রী ও অভয়দাত্রী, মা। ‘দেবী মাহাত্ম্য’ গ্রন্থে দেবীর বিস্তারিত উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘দেবী ভাগবত’ পুরাণে জগতের সকল জীবের প্রতি দয়াবতী মাতা রূপে তাঁকে তুলে ধরা হয়েছে; বলা হয়েছে যে, তিনিই সমস্ত জাগতিক ও পরাজাগতিক শক্তির আধার।
দেবী ভ্রামরী তথা ভদ্রকালীর মন্দিরটি দেখতে সাধারণ। তবে তার এই সাধারণ হয়ে গড়ে ওঠার ইতিহাস কিন্তু বেশ আকর্ষণীয়। একটি পাহাড়ের ওপর দেবীর মন্দিরটি অবস্থিত। মন্দিরটি দোতলা, তাতে কোন চূড়া নেই। দেবীর মূর্তিটি প্রাচীনকাল থেকেই পাহাড়ে ছিল না, মূর্তি ঘিরে মন্দিরও ছিল না। দেবী পাহাড়ে অবস্থানের আগে দেবীর মন্দির বা থান ঠিক কোথায় ছিল, জানা যায় না। তবে এটুকু জানা যায় যে, একদা মুসলিম শাসকের ভয়ে দেবীর সেবায়েতরা দেবীমূর্তি গ্রামের বাইরে নিয়ে গিয়ে পাহাড়ের ওপর গোপন স্থানে স্থাপন করেন, যাতে যবনেরা মূল্যবান ধাতুনির্মিত এই দেবীমূর্তির সন্ধান পেয়ে, তা হরণ করতে বা নষ্ট করতে না-পারে।
যাই হোক, পাহাড়ের সেই গোপনস্থানেই শতাব্দীকাল ধরে দেবীর পূজা চলতে থাকে। তারপর আঠেরো শতকের শেষে এসে দেবীর মন্দির তৈরি হয়। ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে হিন্দুরাজা সরদার গণপত রাও পটবর্ধন দীক্ষিত এই মন্দিরটি নির্মাণ করিয়ে দেন। কেউ বলেন ভক্তসেবায়েতদের অনুরোধে তিনি এই মন্দির নির্মাণ করান; কেউ বা বলেন, রাজা আপন ভক্তি ও অন্তরের আর্তিতেই এই মন্দির নির্মাণ করান।
মন্দিরটি নির্মাণের সময় মন্দিরের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ইচ্ছে করেই রক্ষা করা হয়নি। আমরা জানি যে, হিন্দুমন্দিরের মাথায় চূড়া থাকে। প্রাচীন সমস্ত মন্দিরেই এই বৈশিষ্ট্য রক্ষিত হতে আমরা দেখি, এখনও এই রীতি মেনেই মন্দির নির্মিত হয় (বর্তমানের নিতান্তই গ্রাম্য কিছু মন্দির ব্যতিক্রম)। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, দুশো বছর আগে নির্মিত ভদ্রকালী মন্দিরের ওপর কোন চূড়া নেই। আসলে, যখন মন্দির স্থাপিত হয়, তখনও বিধর্মী আক্রমণের ভয়ে মন্দিরের মাথায় কলস স্থাপন করা হয়নি। এই কলস স্থাপন না-করার কারণ, যাতে আক্রমণকারীরা দূর থেকে দেখে বুঝতে না-পারে যে এটা একটা মন্দির। মন্দিরের মাথায় যেহেতু কলস স্থাপন হয়নি, সেহেতু ওই একই কারণ মাথায় রেখে এই মন্দিরে কোন চূড়াও নির্মিত হয়নি।
মন্দিরের গর্ভগৃহে অপূর্ব কারুকাজ করা অপ্রশস্ত সিংহাসন রয়েছে। সেই সিংহাসনে সারি সারি ক্ষুদ্রাকৃতি নবদুর্গার মূর্তি আছে। এই নবদুর্গামূর্তি নাসিকের ন’টি পাহাড়ের প্রতীকী আরাধ্যা দেবী। আর তাঁদের মাঝে মধ্যমণি হয়ে রয়েছেন দেবী ভদ্রকালী। দেবীর মূর্তিটি পনেরো ইঞ্চি উঁচু। অপূর্ব সুন্দর এই মূর্তিটি পঞ্চধাতু দিয়ে তৈরি। দেবীর আঠেরোটি হাত। সেই সকল হাতে রয়েছে নানান অস্ত্রমালা। দেবী শস্ত্রধারিণী হয়েও প্রসন্নবদনা। ভক্তজনের কাছে কল্যাণী। মমতাময়ী মা।
নাসিকের এই ভদ্রকালী মন্দির আকারে যেমন আর-পাঁচটা মন্দিরের থেকে আলাদা, তেমনি চরিত্রগত দিক থেকেও আলাদা। কেননা, এটি শুধু মন্দির না, এটি একটি ‘প্রাচ্যবিদ্যাপীঠ’ বা প্রাচ্যবিদ্যাশিক্ষার বিখ্যাত কেন্দ্র। এখানে প্রাচীন গুরুশিষ্য পরম্পরায় আজও ছাত্রেরা আশ্রম-আবাসিক হয়ে বেদ-বেদাঙ্গ শিক্ষা করেন। ছাত্রেরা নিত্যদিন মন্দিরের আশপাশের ব্রাহ্মণদের গৃহগুলিতে গিয়ে ‘মাধুকরী’ বা ভিক্ষা করেন। তাঁরা যা ভিক্ষা করে আনেন, তা-ই নৈবেদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে মায়ের ত্রিকাল-পূজা সম্পন্ন হয়। এছাড়াও মন্দির-সন্নিহিত প্রবাসী ব্রাহ্মণ বাড়িসমূহ থেকে পালা-ব্যবস্থাপনায় বিশেষ সময়ের পূজা-অর্চনা, নৈবেদ্য ও নানান আচারের প্রয়োজনীয় সামগ্রী আসে।
দেবীর মন্দির প্রতিদিন সকাল ছ’টা থেকে রাত্রি ন’টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এই সময়ের মধ্যে মায়ের পুজো দেওয়া যায়। এর মধ্যে ভোগনিবেদনের সময় ছাড়া মাকে দর্শনও করা যায়। নিত্যপূজা ছাড়াও এই শক্তিপীঠে বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে সারা বছর ধরেই শক্তি উপাসনার সঙ্গে যুক্ত বিশিষ্ট পার্বণমালা উদযাপন করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই, নবরাত্রি উৎসব ও দুর্গাপুজো এখানে অত্যন্ত সাড়ম্বরে পালিত হয়। চৈত্র উৎসবের ধুমধাম কয়েকদিন ধরে চলে। এই উৎসব রামনবমীতে শুরু হয়ে শেষ হয় চৈত্র পূর্ণিমাতে। বিশেষ উৎসবের এই দিনগুলোতে স্থানীয় ভক্তদের পাশাপাশি সারা ভারতের নানান প্রান্ত থেকে ছুটে আসা ভক্তদের ভিড় জমে এই মন্দিরে। প্রত্যেকেই অন্তর নিবেদন করে প্রার্থনা করেন দেবীমায়ের বিশেষ কৃপা। সেই প্রার্থনার সময় নিবেদিতপ্রাণ ভক্তদের অন্তর থেকে উৎসারিত হয় দেবীর বীজমন্ত্র, ‘ওঁ হ্রীং...’।।