সতীপীঠঃ করবীরে পতিত হয়েছিল দেবীর ত্রিনেত্র

‘পীঠনির্ণয়তন্ত্র’-গ্রন্থে দেবী সতীর দ্বিতীয় পীঠ হিসেবে ‘করবীর’ প্রদেশের কথা বলা হয়েছে। লেখা হয়েছে—

 ‘করবীরে ত্রিনেত্রং মে দেবী মহিষমর্দিনী

  ক্রোধীশো ভৈরবস্তত্র…।’

অর্থাৎ, করবীরে দেবীর ত্রিনেত্র পতিত হয়েছিল। এখানে দেবী ‘মহিষমর্দিনী’ নামে খ্যাতা, তাঁর ভৈরবের নাম ‘ক্রোধীশ’।

কিন্তু গোল বেধেছে ‘করবীর’ কোথায় অবস্থিত তাই নিয়ে। তা থেকে উঠে এসেছে দুটি মত।

একঃ

মহারাষ্ট্রের কোলহাপুরের অধিবাসীরা মনে করেন যে, কোলহাপুরই প্রাচীনকালের করবীর। অনেকেই এখনও ‘কোলহাপুর’ বোঝাতে ‘করবীর’-ই বলেন। এই করবীরে যেখানে পাঁচটি নদীর ধারা এসে মিশেছে,  সেই মিলনস্থলেই একদা গড়ে উঠেছিল প্রাচীন মন্দির। মন্দিরটি আজ থেকে প্রায় তেরশ বছর আগে চালুক্য রাজাদের হাতে নির্মিত হয়েছিল। সুরম্য এই মন্দিরের উজ্জ্বল ধূসর পাথরের ওপর অসাধারণ কারুকাজ আজও এই মন্দিরকে দর্শনার্থীদের কাছে বিস্ময়ের বস্তু করে রেখেছে। মন্দিরের বাস্তুকারেরা এই মন্দির নির্মাণে অসাধারণ প্রযুক্তিবিদ্যার পরিচয় দিয়েছেন। সূর্যের বিশেষ অবস্থান মেপে মন্দিরটি এমনভাবে তৈরি, যাতে কেবলমাত্র বছরে তিনদিন দেবীর অঙ্গে সূর্যের আলো পড়ে। জানুয়ারির শেষ দিন দেবীর পায়ে সূর্যের আলো পড়ে, ফেব্রুয়ারির প্রথমদিন দেবীর বুক অব্দি সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়; আর দ্বিতীয়দিন সারা অঙ্গ সূর্যালোকে স্নাত হয়। দেবীর এই সূর্যস্নান উপলক্ষে চলে উৎসব, হয় দারুণ ভক্তসমাগম।

আস্ত কালো পাথর কুঁদে দেবীর মূর্তি নির্মিত হয়েছে। দেবীর উচ্চতা তিন ফুট। দেবী একই আধারে শাক্ত ও বৈষ্ণবের চিরকালীন দ্বন্দ্বের মাঝে এক ঝলক মিলনের লীলা ঘটিয়ে দিয়েছেন। একই মন্দিরে দুই সম্প্রদায়কেই মাথা নোয়াতে বাধ্য করেছেন। কেননা, দেবী বৈষ্ণবদের কাছে ‘মহালক্ষ্মী’, শাক্তদের কাছে আদ্যাশক্তি ‘অম্বাবাঈ’। তাই মন্দিরটি কারও কাছে ‘মহালক্ষ্মী মন্দির’, কারও কাছে ‘অম্বাবাঈ মন্দির’।

দেবীর মাথায় রত্নময় মুকুট। মুকুটে পাঁচটি সাপের মাথা। দেবী চতুর্ভুজা। এক হাতে জামির জাতীয় ফল, দ্বিতীয় হাতে গদা, তৃতীয় হাতে বর্ম, চতুর্থ হাতে পানপাত্র। দেবীর পেছনে দাঁড়িয়ে বাহন সিংহ। দেবীকে প্রণাম করা হয়, ‘ওঁ করবীরা নিবাসিনীয়ে নমঃ’- মন্ত্রে। চালুক্য রাজারা তো বটেই এমনকি মুঘল সম্রাটেরা এবং ছত্রপতি শিবাজীও এই মন্দিরে পুজো দিতে আসতেন বা দেবীর জন্য ভেট পাঠাতেন।

শাক্তভক্তেরা এই মন্দিরকে দেবী সতীর দ্বিতীয় পীঠ হিসেবে দাবি করলেও অনেকেই তার বিরোধিতা করে বলেন যে, এখানে দেবীর ত্রিনেত্র পতিত হয়নি। এ পীঠ একান্তই দেবী লক্ষ্মীর পীঠ।  দেবীর পিছনে বাহন সিংহ থাকলেও এই পীঠ দুর্গার পীঠ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এবং একান্নপীঠের একটি তো কিছুতেই নয়। কারণ, এই মন্দিরের উদ্ভব প্রসঙ্গে দেবী সতীর কাহিনি নয়, অন্য একটি কিংবদন্তী রয়েছে। সেটি হলঃ

কোলাসুর নামের এক দৈত্য বর পেয়েছিল যে, কোন নারী যদি তাকে যুদ্ধে পরাজিত করতে পারে, তবে একমাত্র তার হাতেই সে বধ্য হবে, অন্য কারও হাতে নয়। বর পেয়ে সে যখন অত্যাচার শুরু করল ত্রিলোকে, তখন দেবতাদের অনুরোধে স্বয়ং বিষ্ণু মহালক্ষ্মীর রূপ ধরে সিংহের পিঠে চেপে তার সঙ্গে গেলেন যুদ্ধ করতে। ঘোরতর যুদ্ধে কোলাসুরকে পরাজিত করলেন। তারপর তাকে যখন বধ করতে গেলেন, তখন সে একটি বর প্রার্থনা করল। বলল যে, বধের স্থানটি যেন তার নামে প্রসিদ্ধ হয়। মহালক্ষ্মীরূপী বিষ্ণু তার ইচ্ছা পূর্ণ করলেন। সেই থেকে করবীরক্ষেত্র কোলাসুরের নামে ‘কোলহাপুর’ হিসেবে প্রসিদ্ধ হল। বিষ্ণু মহালক্ষ্মীরূপে চিরদিনের জন্য সেখানেই অবস্থান করতে মনস্থ করলেন। দেবী মাহাত্ম্যে স্থান প্রসিদ্ধ হল, গড়ে উঠল মন্দির। দেবী পূজনীয়া হলেন ‘কোলাসুরমর্দিনী’ নামে।

মতান্তরের স্রোত বেয়েই উঠে এসেছে দ্বিতীয় একটি দাবি।

দুইঃ

দ্বিতীয় মতের সমর্থকদের বক্তব্য হল, ‘পীঠনির্ণয়তন্ত্র’ গ্রন্থে যে করবীরের কথা বলা হয়েছে, তা পাকিস্তানে অবস্থিত। পাকিস্তানের করাচির পারকাই ও সুক্কুর স্টেশনের কাছে ‘করবীরপুর’ নামে একটি স্থান সত্যিই আছে। তাঁদের মতে, এটিই প্রাচীন ‘করবীর’। অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থে দ্বিতীয় সতীপীঠস্থান হিসেবে ‘শর্করা’র নামও আছে। ‘সুক্কুর’ স্টেশনই হল প্রাচীন গ্রন্থকথিত ‘শর্করা’। সুতরাং, এখানেই দেবীর ত্রিনেত্র পতিত হয়েছিল।

আগেই বলেছি ‘পীঠনির্ণয়তন্ত্র’র শ্লোকে করবীরের দেবীর নাম ‘মহিষমর্দিনী’ বলা হয়েছে। পাকিস্তানের করবীরপুরের দেবীর নামও তাই। শোনা যায়, দেবী এখানে দশভুজারূপে অধিষ্ঠিতা। করাচিবাসীদের কাছে এই দেবী ‘করাচিওয়ালী’ নামে প্রসিদ্ধা।

কিন্তু স্থাননাম বা দেবীর নামের মিল খুব একটা সন্তুষ্টি দেয় না আপামর ভক্তকে। কেননা, করাচিওয়ালী দেবীর ছবি একেবারেই লভ্য নয়। দেবীর কথা, দেবীর মন্দিরের বিবরণ কিছুই সহজলভ্য নয়। দেবীর ভৈরবের কথাও জানা যায় না।

সত্যি বলতে কী, পাকিস্তানের হিংলাজ যতটা শাক্তদের কাছে তীর্থ হয়ে উঠতে পেরেছে; পাকিস্তানের করবীরপুরের এই পীঠ সেভাবে ভক্তদের টানতে পারেনি। আসলে ভক্তদের মধ্যে পীঠের প্রামাণিকতা নিয়ে সংশয়-ই হয়তো এই পীঠকে শাক্তদের অবশ্যগম্য তীর্থ হয়ে উঠতে দেয়নি। পাকিস্তানের বাইরের ভক্তদের কাছে এই পীঠ সম্পর্কে সম্যক সংবাদ নেই। প্রাচীন তীর্থভ্রমণের বিবরণে, ভক্তদের মুখে এই পীঠ সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য প্রচারিতও হয়নি।

সুতরাং, এই পীঠ এখনও প্রামাণ্য বিবরণ তুলে আনার মতো নিবিষ্ট কোন ভক্ত-লেখকের অপেক্ষায়; যার বিবরণে দেবীর সাজ-আভরণের কথা, দেবীর ভৈরব ক্রোধীশের মন্দিরের কথা, দেবীর মন্দিরের বর্তমান অবস্থা, মন্দির গড়ে ওঠার ইতিহাস বা কিংবন্তির পরত উন্মোচিত হবে…       

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...