কথায় বলে "মর্নিং শোজ দ্য ডে"! সেটাই অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়ে গিয়েছিল সতীনাথ ভাদুড়ীর জীবনে। নিজের প্রথম উপন্যাসেই ছক্কা হাঁকিয়ে ছিলেন তিনি। ঢোঁড়াই চরিত মানসের অনেক আগেই তাঁর কলমে লেখা হয়েছিল 'জাগরী'। আদ্যন্ত একটি রাজনৈতিক উপন্যাস ছিল জাগরী এবং একটি সার্থক রাজনৈতিক উপন্যাস। এই উপন্যাসই সতীনাথ ভাদুড়ীকে পৌঁছে দিয়েছিল চরম শিখরে।
আদ্যপান্ত রাজনীতির মধ্যেই এ উপন্যাসের চরিত্রগুলি পূর্ণ রূপ লাভ করেছে, হয়ে উঠেছে সময়ের দলিল। প্রবাসী বাঙালি একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে সতীনাথ ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের এক রূপ তুলে ধরেছেন এই লেখায়। ‘জাগরী’ নিঃসন্দেহে তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি উপন্যাস। স্বাধীনতা আন্দোলন, কংগ্রেস, কমিউনিস্টদের পদের সংঘাতকে উপজীব্য করেই কাহিনী রচনা করেছেন লেখক। ভাগলপুর জেলে বসেই রাজনৈতিক বন্দী সতীনাথ ভাদুড়ী লিখেছিলেন জাগরীর পাণ্ডুলিপি।
বাংলা রাজনৈতিক উপন্যাসের সূচনা হয়েছিল সম্ভবত ১৮৮২ সালে 'আনন্দমঠ'-এর হাত ধরে। তবে 'আনন্দমঠ' আদৌ রাজনৈতিক উপন্যাস কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। রবীন্দ্রনাথের 'ঘরে-বাইরে', শরৎচন্দ্রের 'পথের দাবী' রাজনীতিকে আশ্রয় করা উপন্যাস। বঙ্কিম-রবীন্দ্র-শরৎ উত্তর বাংলা সাহিত্যে রাজনীতি সচেতন ঔপন্যাসিকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সতীনাথ ভাদুড়ী। ১৯৪২-এর আগস্ট আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছিল 'জাগরী'। আঙ্গিক বিশ্লেষণে জাগরী' শুধু একটি সময়ের রাজনৈতিক দলিল নয়, এর সাহিত্যমূল্যও যথেষ্ট। এই উপন্যাসই বাংলা সাহিত্যে সতীনাথের আগমন ঘোষণা করে।
উপন্যাস কেবলমাত্র একটি রাত্রিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। ৪২-এর আন্দোলনে নেতৃত্বদানের জন্য সোশ্যালিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী বিলু জেল বন্দী ফাসীর আসামী। ফাসীর পূর্ববর্তী রাত্রে সে সারাজীবনের হিসাব নিকাশ করতে বসেছে। এই গোটা হিসেবে নিকেশ, পরিসংখ্যান করা হয়েছে কেবল চারটি অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে। ফাসী সেল, আপার ডিভিশন অফার্ড, আওরাত কিতা, জেল গেট, এই স্মৃতি চারণের ইতিবৃত্ত, এতেই শেষ হচ্ছে উপন্যাস। বিলুর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছে ছােটভাই নীলু।
একই জেলের আপার ডিভিশন ওয়ার্ডে বন্দী বিলুর গান্ধীবাদী বাবা। জেলের মহিলা ওয়ার্ড বা আওরত কিতায় বন্দিনী বিলুর মা। চারটি চরিত্রের আত্মচিন্তার সূত্রে স্মৃতিপথ ধরে উঠে আসে সময়ের ইতিবৃত্ত, রাজনৈতিক অস্থিরতা, রাজনীতি এবং মানবতার টানাপােড়েন, কর্তব্য ও হৃদয়ধর্মের সংঘাত, এক অপুর্ব আত্মমগ্ন ভাষায় 'জাগরী' উপন্যাসকে বুনেছেন সতীনাথ ভাদুড়ী। জাগরী ৪২-এর আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা হলেও, কোথাও গিয়ে যেন সতীনাথ ভাদুড়ীরই জীবনের খানিকটা মিলে গিয়েছে জাগরী-তে।
১১ই আশ্বিন, ১৩১৩, বৃহস্পতিবার বিজয়া দশমীর সন্ধ্যায় কোশী নদীর পাড়ে পূর্ণিয়ার ‘সবুজকুন্তলা’ ভাট্টাবাজারে ইন্দুভূষণ ভাদুড়ী ও রাজবালাদেবীর ঘরে ষষ্ঠ সন্তান হয়ে এসেছিলেন সতীনাথ। ঘটনাচক্রে সতীনাথের ‘জাগরী’ উপন্যাসের বিলুরও জন্মও বিজয়া দশমীর দিনেই। এক সপ্তাহের ব্যবধানে মা এবং বড় বোন করুণাময়ী মারা গেলেন, স্নেহ হারা হলেন সতীনাথ। পূর্ণিয়ার দাক্ষায়ণী দেবী, কুসুমকুমারী দেবীরা স্নেহ সম্পর্কে হয়ে উঠলেন তাঁর মা। সতীনাথ এঁদের কথাই লিখেছেন জাগরীতে। লেখালেখি ছিল তাঁর রোজকার রাতের অবসর যাপন। নবশক্তি পত্রিকায় স্যাটায়ারধর্মী লেখায় হাতেখড়ি। পূর্ণিয়া দর্পণে লিখতেন চুটকি।
প্রথম গল্প জামাইবাবু প্রকাশিত হল বিচিত্রায়। ছকে বাঁধা জীবন তাঁর ভাল লাগেনি, মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে বাড়ি ছাড়লেন। কংগ্রেস নেতা বিদ্যানাথ চৌধুরীর টিকাপট্টি আশ্রমে যোগ দিলেন। খাদির ধুতি, পাঞ্জাবি, চাদর আর শীতে গলাবন্ধ কোট, পায়ে চপ্পল সঙ্গী হল তাঁর। স্বাধীনতার লড়াইতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, গ্রাম থেকে গ্রাম চষে ফেললেন।
এই জীবনই তাঁর জাগরীর উপাদান জুগিয়েছিল। বাবা ইন্দুভূষণ ছেলের এই জীবন সহ্য করতে পারেননি, কোনও বাবাই তা পারেন না। ছোট ছেলে যাতে ফিরে আসে, তার জন্য বড় ছেলে ভূতনাথকে কলকাতায় টেলিগ্রাম করলেন বাবা। সতীনাথের দুই বন্ধু দ্বারিক সুর ও কমলদেও নারায়ণ সিংহের সঙ্গে ভূতনাথ গিয়েছিলেন ভাইকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু ভাই ফিরল না, হয়ত জাগরী লেখা হবে বলেই তাঁর ফেরা হয়নি।
কিন্তু শুধু কংগ্রেস স্কুলের মাস্টার হিসেবে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবেন সতীনাথ, এমনটা কিন্তু হওয়ার কথা নয়। হলও না তাই! আশ্রম ছেড়ে খেটে খাওয়া ভারতবাসীর সঙ্গে মিশে গেলেন সতীনাথ; তাৎমা, ধাঙ়ড় পরবর্তী সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে কাজ করতে শুরু করলেন। জাগরীর রসদ সংগ্রহ চলছিল। ভারতবাসীর গলায় আগুনের স্লোগান দিলেন - ‘সরকার জুলুমকার। আংরেজ জুলুমকার।’ পিকেটিং করলেন ভাট্টাবাজারের বিলিতি মদের দোকানের সামনে। পুলিশ আসল, অনেকেই পালালেন জমায়েত থেকে। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন সতীনাথ।
সতীনাথের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ঝুলি ততদিনে কানায় কানায় পূর্ণ। কংগ্রেসী নেতা থেকে জেলা সেক্রেটারি, বাগ্মী, একাধিকবার জেল খাটা বিপ্লবী, জেল ভাঙার চেষ্টা থেকে শুরু করে অস্থির সময়ে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা, এত গুলো তাঁর পরিচয়, যাবতীয় গুণে তিনি পরিপক্ক। আসলে এগুলোই জাগরী তৈরি করেছিল।
পূর্ণিয়ার আদালত চত্বরের ছোটবাবু সতীনাথ হয়ে উঠলেন ভাদুড়ীজি। ৪২-এর আগস্ট আন্দোলনে আবার সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় আগত। শুরু হল গণ আন্দোলন। হরতাল, মিছিল, কিষাণগঞ্জ আদালতে বিলিতি পতাকা টেনে নামানো, রেললাইন উড়িয়ে দেওয়া, সব হল। জাগরীর বিলু অর্থাৎ বাস্তব জীবনের সতীনাথও শরিক হলেন আন্দোলনে, এত তাঁর নিজের কথাই।
তাই তো জাগরীর উৎসর্গপত্রে লেখা ছিল ‘যে সকল অখ্যাতনামা রাজনৈতিক কর্ম্মীর কর্ম্মনিষ্ঠা ও স্বার্থত্যাগের বিবরণ, জাতীয় ইতিহাসে কোনোদিনই লিখিত হইবে না, তাঁহাদের স্মৃতির উদ্দেশে-’ কিন্তু কেবল মাত্র অখ্যাতদের সঙ্গে নয়, পরবর্তী জীবনে বিখ্যাত অনেকের সঙ্গেই পূর্ণিয়া ও ভাগলপুর জেলে একসঙ্গে বন্দীজীবন কাটল সতীনাথের। সেই তালিকায় ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ, বিহারের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিংহ-সহ একঝাঁক প্রথম সারির দেশনেতা। জেলের মধ্যেই সারাদিন দেশ, সমাজ, রাজনীতি ও আন্দোলনের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা চলত তাঁদের।
কিন্তু সতীনাথের মন ওতে তেমন ছিল না। জেল জীবনে কখনও লৌহকপাটের ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যরেখায় তুলসীদাসের ‘রামায়ণ’ পড়তেন, আবার কখনও উর্দু-ফারসি ভাষা রপ্ত করতেন। আবার কখনও জেলের ‘টি’ সেলে স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়ে মোটা মোটা গাঢ় সবুজ রংয়ের দুইখানা খাতায় কী যেন লিখে চলতেন সতীনাথ। ওই লেখাটিই হল ‘জাগরী’! সতীনাথ ভাদুড়ীর প্রথম উপন্যাস ‘জাগরী'। যার পাণ্ডুলিপি নানা প্রকাশকের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে শেষ পর্যন্ত এক অখ্যাত প্রকাশকের আনুকূল্যে ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত হয়। এই ভাবেই ইতিহাস তৈরি হয়, জাগরীও ইতিহাস তৈরির যাবতীয় ইঙ্গিত দিয়েছিল অনেক আগে থেকেই। তাই তো মহাকালকে জয় করে আজ জাগরী বাংলা সাহিত্যের কালোত্তীর্ণ এক বিস্ময়।