বিখ্যাত বাবার বিখ্যাত ছেলে, লাইন শুনতে আমরা খুব একটা অভ্যস্ত নই। বাবা-ছেলের পথটি যদি এক হয়, তখন চলে আসে নানান সমস্যা। বাবা-ছেলে এক পেশায় থাকলে এবং বাবা বিখ্যাত হলেই ঢাকা পড়ে যায় ছেলে। মেধাও সেখানে স্বজনপোষণের নাম পেয়ে যায়।
ইতিহাস তাইই বলে, মনে করেই দেখুন রথী ঠাকুর চিরদিন ঢাকা পড়েই রইলেন রবির আড়ালে, রোহন গভাস্কার কোনদিনই সুনীলের উপরে উঠতে পারলেন না, সিনেমার ক্ষেত্রে বচ্চন পরিবারেও তাই। আসলে আমাদের স্বভাব তুলনা টেনে নিয়ে আসা। দর্শকদেরও দোষ দেওয়া যায় না, কিংবাদন্তী এমন একটা জায়গায় শেষ করে যান, যে উত্তরপুরুষেরা সেখান থেকে শুরু করতে পারে না। বা অনেক ক্ষেত্রে পারলেও আমরা উপেক্ষা করে যাই নূতনকে। তবে ব্যতিক্রমও আছে, ক্রিকেটেই দেখুন না অমরনাথ বাবা-ছেলে!
ডাক্তারের ছেলে ডাক্তার হবে, উকিলের ছেলে উকিল, শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক, এ জিনিস আমাদের কাছে স্বানন্দে গৃহীত হয়। সহ্য হয়না কেবল অভিনেতার ছেলের অভিনেতা হওয়া।
সে চলচ্চিত্রে চরিত্র পেলেই স্বজনপোষণ বলে দেগে দিই আমরা। আর নয়ত লাগিয়ে দিই স্টার কিডের তকমা। এও এক মিথ! তবে মিথ ভাঙার কান্ডারিও কেউ কেউ আছেন। যেমন চট্টোপাধ্যায় বাবা-ছেলে।
শাশ্বতের বাবা সম্পর্কে একটি কথা বলা যায়, বাংলা সিনেমার উত্তম-সৌমিত্র থাকার পরেও তিনি শাশ্বত। আমরা যারা ছোট, তারা ওঁর বাবা হওয়া চরিত্রগুলো দেখেছি, কিন্তু অরণ্যের দিনরাত্রি, চৌরঙ্গী, গণশত্রু এমন আগুনীত ছবি, ভুললে চলে না। তিনি হয়ত চাইলেই ছেলেকে লঞ্চ করতে একটা ছবি বানাতে পারতেন, কিন্তু তা করেননি তিনি। তবে বাবা-ছেলে অনেক পরে একই ছবিতে বাবা-ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, গৌতম ঘোষের আবার অরণ্যে।
বাংলা ছবির অন্যতম শক্তিশালী-সুদর্শন-সুপুরুষ অভিনেতা হয়েও শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন থিয়েটারের দলে, অভিনেতা তৈরির আখড়ায়। জোছন দোস্তিদারের কাছেই অভিনেতা হওয়ার প্রথম পাঠ নেওয়া শুরু জুনিয়ার চট্টোপাধ্যায়ের।
যদিও ছেলেবেলায় মা চুল কাটিয়ে দেওয়ায় সত্যজিতের ছবি মিস করেছেন শাশ্বত। মিসেস চট্টোপাধ্যায় তেমনটা না করলে জয়বাবা ফেলুনাথের রুকু হিসেবে আমরা শাশ্বতকেই পেতাম। স্টার কিড, কিড স্টার হয়ে যেতেন। কিন্তু সে যাত্রায় মা ক্যামেরা আর অপুর সামনে এসে দাঁড়ায়।
কিন্তু ভাগ্য! রায় সাহেবের লেন্স না সই; কলম তো বটেই, সিনিয়ার রায়েই কলম আর জুনিয়ার রায়ের ক্যামেরার যুগলবন্দীতে বাক্স রহস্যে তোপসে হয়ে এলেন শাশ্বত। সত্যজিত নিজেও একবার শাশ্বতকে বলেছিলেন তুমি ভালো তোপসে হতে পারতে। শাশ্বত বেশ কয়েকটি গল্পে তোপসের ভূমিকায় কাজ করেছেন।
অজস্র টেলি ছবি, টেলিভিশন সিরিজ শাশ্বতের জয়যাত্রার গল্প বলে। 'এক আকাশের নীচে' তো কালোত্তীর্ন একটি সিরিজ, আজও বাঙালির ছোট পর্দার অন্যতম সেরা কাজ। কয়েক বছর আগে ফের টেলিভিশনে ফিরেছিলেন শাশ্বত। তবে এবার অভিনেতা নয়, সঞ্চালকের ভূমিকায়। সেলিব্রিটি চ্যাট শো, তার নামেই শো; অপুর সংসার।
এবার আসছি বড় পর্দায় আমার প্রিয় ছবি দিয়েই শুরু করি। যে ছবিতে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন শাশ্বত, মেঘে ঢাকা তারা, কী অসামান্য অভিনয়।
বাংলার দুই হার্টথ্রব গোয়েন্দা ফেলু আর ব্যোমকেশ দুজনেরই সহকারী হয়েছেন শাশ্বত। অজিত তোপসের পরে, তিনি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের শবরকে নিয়ে এসেছেন পর্দায়। এবার তিনিই গোয়েন্দা তবে পুলিশের, শবর দাশগুপ্ত। আবার গুন্ডাও হয়েছেন, এক্কেবারে ঠান্ডা মাথার খুনি কাহানির বব বিশ্বাসকে মনে পড়ে! নমস্কার আমি বব বিশ্বাস। এক মিনিট ব্যস্ এইটুকুই তাতেই কামাল।একটা চরিত্র কোন পর্যায়ে পৌঁছলে এমন হয় যে, সেই চরিত্রকে দিয়েই মানুষ সিনেমাটিকে মনে রেখে দেয়।
আবার মজার ভিলেনও হয়েছেন, ভূতের ভবিষ্যতে হাতকাটা কার্তিক। এমন অসামান্য সব চরিত্রাভিনয় করে মুগ্ধ করেছেন বাংলার দর্শককে, বরফিতে আসমুদ্রহিমাচল দেখেছে এই বঙ্গতনয়ের অভিনয়। হাল আমলে দেখলাম হবুচন্দ্র রাজাকে, রূপকথার চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলা কিন্তু কম কথা নয়। তবুও কী অপূর্ব সাবলীল অভিনয়।
আজ ১৯শে ডিসেম্বর এ প্রজন্মের অসামান্য এক অভিনেতার জন্মদিন। আজ আমাদের অজিত-তোপসের জন্মদিন। শুভ জন্মদিন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। ভাল থাকুন আপনি। আপনার সাফল্যের সঙ্গেই বাংলা চলচ্চিত্রের ঐতিহ্যকে এগিয়ে চলুক। সমৃদ্ধ হই আমরা, বাঙালির চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ মজবুত হাতেই রয়েছে, তাই আমরা নিশ্চিন্ত।